চেনা পথ অচেনা পথিক, লেখক: এম.এ. কাশেম। (১ম পর্ব)

Mofizur Rahman
0

উপন্যাস: চেনা পথ অচেনা পথিক
লেখক: এম.এ. কাশেম
চেনা পথ অচেনা পথিক, লেখক: এম.এ. কাশেম। (২য় পর্ব)

স্বর্ণের পালঙ্ক দেওয়ার স্বপ্ন ছিলো
হলো না
তারা হয়ে চলে গেলে
অসীমের পার
দিয়ে গেলে
তোমার কল্পনার উত্তরাধিকার।
অগুনতি জোছনামাখা রাতে
রূপকথার জীয়নকাঠি
তুলে দিয়েছিলে হাতে।
আজ পেলো রূপ তোমার সুপ্ত ইচ্ছার।
চেনা পথ অচেনা পথিক- শুরু:
রাস্তাটা এখানে এসে ভাগ হয়ে গেছে। রেলের রাস্তা। বাণিজ্য রাজধানী চট্টগ্রামের বটতলী ইস্টিশন থেকে ষোলশহর হয়ে দোহাজারি, অন্যটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হাটহাজারি হয়ে নাজিরহাট। বন গবেষণাগারের প্রথম রেল গেইট পেরিয়ে তাই তৈরি হয়েছে একটি ত্রিভুজ আকৃতির বড়সড় খালি জায়গা। কেননা দুদিকে ছুটে চলা দু রাস্তার প্রান্ত ছুঁয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল বিস্তর এক বস্তি। এর অধিকাংশই রেলের জায়গা, ক্ষমতাবানেরা জবরদখল করেছে। তবে শোনা যায় উঁচুমহলের সাথে তাদের আঁতাত না থাকলে, তারা টিকতে পারতো না।
বেলা পড়ন্ত। লোকটা একা মনে হাঁটছে। হাতে ব্যাগ। ব্যাগের গায়ে সাদার উপর কালো কালিতে লেখা: “প্রটেক্টিং হিউম্যান রাইটস (পিএইচআর) প্রোগ্রাম জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে কার্যক্রম।” এটা তাঁর স্ত্রী তাঁকে দিয়েছেন, লোকটার চোখ আটকে যায় ত্রিভুজ আকৃতির খালি জায়গাটায়, এখন আর জায়গাটা খালি নেই। যেন এক ঝাঁক প্রজাপতি অনিন্দ্য আনন্দে উড়ছে আর উড়ছে। লোকটা প্রতিদিন এ সময়ে ফেরার পথে এদের দেখে। আজ কিন্তু কে যেন পা দুটোতে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। কিছুতেই পা সরছে না। 
চোখ দুটো আটকে আর দুটো নিষ্পাপ সহজ-সরল ডাগর ডাগর চোখে। আর মন বলছে চার দশকেরও আগের পড়া একটি কবিতার একটি অনবদ্য পক্তি: “কিশোরীরে দু বছর পর তুই পাড়ায় লাগাবি আগুন”। মনে মনে ভাবে পঙক্তিটি কি সে ঠিকঠাক ভাবলো? আজকাল সবকিছুতেই বিশ্বাস আর আস্থার বড় অভাব। হঠাৎ পালটে যায় দৃশ্যপট। আশপাশের সব দৃশ্য ভেনিশ হয়ে, মিলিয়ে যায় কোন সুদূরে। লোকটা পষ্ট দেখতে পায়, পড়ন্তবেলা, বাতাসের ঝাপটায় দুরন্ত এক কিশোরের হাত থেকে ছিটকে পড়ে মুড়িসমেত এক বিশাল নাটাই। বড় বড় মায়াভরা চোখ, দু চোখে অসীমের স্বপ্ন, কানের লতি ছুঁয়ে ঝুলে পড়েছে কুচকুচে কালো চুল; খালি পা, খালি গা, নাভির নিচ থেকে হাঁটু অবধি আতি সস্তা একটি হাফপ্যান্ট, ভীষণ বিবর্ণ, কিন্তু তার অনিন্দ্য-সুন্দর বদনে যেন বাসা বেঁধেছে গোটা জগতের সবটুকু রঙ। নিজেকে সামলে নিয়ে, ঘুড়িটা কুড়িয়ে আবার ছুট দে ছুট। বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে, পুকুরপাড়। শত বছরের প্রাচীন বিশাল পুকুর, এখন প্রায় মজে এসেছে, ফাগুনের এই দিনে পুকুরের মাঝ অবধি হেঁটে যাওয়া যায় অনায়াসে। অনেকগুলি শাপলার লতা। বর্ষায় ফুলে ফুলে অন্য রূপ। এখন কেমন বিবর্ণ। এ লতার পাশে পুকুরের তলায় হাত দিয়ে গর্ত করে রাখে পাড়ার ছেলে-বুড়ো সকলেই। তারপর গোসল করতে পুকুরে নামলে ডুব দিয়ে এ গর্ত থেকে কতো রকমের মাছ ধরে তারা। এটা তাদের জীবিকা নয়। এটা তাদের জীবন। আর এ কাজে কিশোরটির জুড়ি মেলা ভার। এ জন্যেই পাড়ার সকলেরই ঈর্ষার পাত্র সে।

পুকুরপাড়ের যেখানে পত্রবিহীন বিশাল ৰাদি গাছটা নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে, তার কোল ঘেঁষে ঘুড়ি হাতে, দিগন্তবিস্তৃত বিলে পা রাখে সে। এ এলাকায় এতো বিশাল বিল আর নেই। এখন শূন্য, ধূসর। কিন্তু গোটা বিল জুড়ে আশ্বিনে যখন সবুজ ধানের গাছ বাতাসের সাথে খেলায় মাতে, তখন গোটা গ্রামটাই যেন হয়ে ওঠে এক অনবদ্য কবিতা। নাটাইটা হাতে নিয়ে অদ্ভুত কৌশলে ঘুড়িটা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েই আশপাশ দেখে সে। দেখে এর মধ্যে অনেকেই এসে গেছে। ভয় রাফিকে। তার সুতার মাঞ্জা ভীষণ ধারালো, একবার বাগে পেলে ভোঁ-কাট। ঘুড়ি উড়ানোর ছলে কিশোরটি নিজের মনটাকে উড়িয়ে দেয় অসীমে। সেখানে কেবল তার স্বপ্ন ভাসে। এ স্বপ্নের পুরোটা জুড়ে থাকে তার মা। তার কেবলই মনে হয়, মা তার বড় দুঃখী। কীসের দুঃখ, কেন দুঃখ, কোন দুঃখ কিছুই সে বুঝে না। সে কখনো তার মাকে তার বাবার সাথে হেসে কথা বলতে দেখেনি। তার ছোট্ট মনে কেবলই প্রশ্ন জাগে এরই নাম কী সংসার! হঠাৎ কানে বাজে সায়াহ্নের মন কেমন করা আজানধ্বনি। ছোট্ট দুটো পাখায় ভর দিয়ে ছোট্ট কটি পাখি উড়ে চলছে কোন অজানার ঠিকানায়। আকাশ যেখানে মাটি ছুঁয়েছে, যেখানে সাঁঝের আঁধার অনেক গাঢ়, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে কম্পমান আলোর শিখা। হয়তো কোনো বাড়ির সাঁঝবাতি তার সাথে পাল্লা দিয়ে মিটি মিটি হাসছে আকাশ পারের অগুনতি তারা। প্রতিদিনের চেনা ছবি। তারপরও এ চিত্র প্রতিদিন কিশোরটিকে অজানা আবেশে করে তুলে আপ্লুত। নিজের মনে সে হাতড়ে ফিরে এ রহস্যের কিনারা। কী এক অমোঘ আকর্ষণে তার মন ছুটে যায় “অসীমের অজানা ঠিকানায়।' রাফির বেরসিক কণ্ঠে চমক ভাঙে কিশোরের: কী রে আবুল, বাড়ি যাবি না? কিশোরটি কোনো জবাব দিলো না। নাটাইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আনমনা কিশোরটি হিপনোটাইজড মানুষের মতো বাড়ির পথ ধরলো।

আবুল শব্দটাই আবুলের এলার্জি। আবুল তার নাম নয়, নামের আদ্যি অংশ। গোটা নামটা বাদ দিয়ে কখন সে কেবল আবুল হয়ে উঠেছে জানে না। আবুলও অনেকেই ডাকে না, ডাকে 'আবুল্যা', শব্দটা শুনলেই তার মধ্যে কেমন এক রোখ চেপে যায়। হাত দুটো লোহার মতো শক্ত হয়ে লোকটার কন্ঠে চেপে বসে, যতক্ষণ পর্যন্ত না লোকটার প্রাণপাখি ফুভূত করে আর না ফেরার দেশে উড়াল দেয়। এ পর্যন্ত কত অগুনতি মানুষের প্রাণ নিয়েছে সে, তার শুমার নেই। মায়ের উপরও বড় অভিমান হয় তার। আবুল জানে কোনো এক হুজুর দিয়ে তার নাম রাখা হয়েছে। বদনার পানিতে পাতাসমেত আমের ডাল, তার উপর কুপিবাতি, ঐ বাতির আগুনে এক একটা পানের বোটা পোড়ানো, তারপর নাম নির্বাচন, অথবা পবিত্র কোরআনের একটা পৃষ্ঠা আন্দাজমতো উলটে তা থেকে একটা নাম পছন্দ করা, আবুল জানে না কোন পদ্ধতিতে তার নাম রাখা হয়েছিলো। মার কাছে জানতে চাইলে কোনো জবাব দেয় না, কেবল মিটি মিটি হাসে আর আবুলকে বুকের মাঝখানে টেনে নিয়ে মাথায়, মুখে, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতেন: "মানিক আমার, মন খারাপ করিস না, মানুষের পরিচয় নামে নয়, তার কাজে। আমার সোনা ছেলে এমন কিছু কর, যাতে তোর অপছন্দের নামটা সকলের পুজ্য হয়ে যায়।”

মায়ের অতো কঠিন কঠিন কথা আবুল বুঝতো না। কিন্তু তার সারা মন-প্ৰাণ দিয়ে চোখ বুজে পরম তৃপ্তিতে মায়ের হাতের স্বর্গীয় পরশ অনুভব করতো। বিস্মৃত হতো সকল দুঃখ। মনে মনে শপথ করতো নামটাকে সে এমন এক উচ্চতায় উঠাবে যার নাগাল পাওয়া কারোরই সাধ্য থাকবে না। না, আবুল তা পারেনি। 'আবুল' আস্ত একটা আবুলই রয়ে গেছে। তার সকল স্বপ্ন, সকল সাধ, বলা নেই, কওয়া নেই, একদিন ফুভূত করে উড়াল দিয়ে সাঁঝ আকাশের তারা হয়ে গেল। আর কোথা থেকে এক একচোখা দৈত্য এসে তার এমন নরম-কোমল বাপটাকে এক্কেবারে কবজা করে নিয়ে আবুলকে অনাথ করে দিলো। আবুল ভাবে, আবুলের মেয়েটা আবুলের চেয়ে অনেক ফাস্ট; সে কত্তো সহজে তার মায়ের স্বপ্নে দেখা 'সাধ'কে 'স্পৃহা'য় পরিণত করে নিলো। না, আবুলকে দিয়ে কিছুই হবে না, না প্রেম, না ঘৃণা; খুন! সেও মনে মনে।

কেউ বলেন আরাকান সড়ক, কেউ বলেন সুজাউদ্দৌলা সড়ক। এখন বলেন বিশ্বরোড। বিশ্বরোড চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ অবধি গিয়েছে। কথিত আছে, সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে, ১৬৫৯ সালের ৪ জানুয়ারি শাহ সুজা, এলাহাবাদের নিকটে, খাজওয়ার যুদ্ধে, আওরঙ্গজেব প্রেরিত মীর জুমলা-বাহিনীর নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সদলবলে ঢাকা হয়ে চাটগা আসেন। অবশেষে চাটগাঁ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আরাকানের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে এ সড়কের পত্তন। এ দলের একজন, কয়েকজন সঙ্গী-সাথী ও পরিবারসহ চাটগা থেকে প্রায় ১৫-১৬ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে যে স্থানে বসতি স্থাপন করেন, তার বর্তমান নাম এয়াকুবদণ্ডী।

গাজী দরফ নামক একজন পাণ্ডাগোছের সৈনিক এ বসতি স্থাপন করেন বলে গ্রামটি গাজীর পাড়া নামে পরিচিত। এ পাড়ায় এখনও মুঘলদের ঐতিহ্য বহন করছে মুঘলপাড়ার বাসিন্দারা। কিশোর আবুল আর দশজনের মতো ছিল না, যা শুনতো তা সে বিশ্বাস করে বলতো না। পড়ালেখার তেমন প্রচলন না থাকলেও, কেমন করে যেন আবুলের মা মাইনর স্কুল পাস করেছিলেন, পুঁথি আর ইতিহাস তাঁর প্রিয় বিষয় ছিলো। অবশ্য ঘরকন্নার কাজে তিনি ছিলেন লবডঙ্কা। মায়ের কাছেই আবুল সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, মুরাদ, পারা, মুজা, নূরজাহানের কথা শুনেছিলো। তার কিশোর মনে জেগেছিলো প্রশ্ন— দিনের পর দিন, রাতের পর রাত প্রাণ বাঁচানোর দায়ে যারা পালিয়ে ফিরছিলো তাদের একজন কীভাবে গাজী হয়। তাই নবম শ্রেণিতে নিবন্ধনের সময় সে তার নামের 'গাজী' অংশটা বাদ দিয়েছিলো।

এলাকাটা সমতল এবং বিস্তীর্ণ। এর বিস্তৃতি দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করেছে। দিগন্তছোঁয়া সমুদ্রের মাঝখানে এক চিলতে সবুজ উঠোনের মতো মনোরম এ ক্ষুদ্র জনপদ। অবশ্য এখন আর নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এ অঞ্চলটাকেও সংক্রমিত করেছে। যত্রতত্র গড়ে ওঠেছে বসতবাড়ি। ক্রমশ গ্রাস করছে সুন্দর-শূন্যতাকে। এখন একটি গ্রামের মানুষ তিনটি আলাদা আলাদা গ্রামে বিভাজিত। চট্টগ্রাম থেকে ১৫-১৬ মাইল পুবে, আর মহকুমা শহর পটিয়ার মাইল চারেক পশ্চিমে আরাকান সড়কের উপরই একটি বাজার। নাম নয়াহাট। সপ্তাহে দুদিন বিষাদ আর সোমবার বাজার বসে। বাজারের পশ্চিমে, রাস্তার উত্তর ধারে এক বিশাল পুকুর, তার কোল ঘেঁষে এক বিরাট বাদামগাছ, গাছের তলায় এ হাটের সবচেয়ে বড় মুদি দোকানটি অবস্থিত। তার পাশে হরিপদের একমাত্র সেলুন, সেলুনের একাংশে ধীরেন্দ্র কাকার লন্ড্রি। এছাড়া ছোট-বড় গোটা তিনেক চা দোকান এবং কয়েকটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান। আবুলের বাবার একটা ধান-গম ভাঙার কল, যা তার ছোট চাচা দেখতো, এ এলাকার ঐতিহ্য। এখন অবশ্য একটি পাকা বেদি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সরকারি দপ্তরেই কেবল 'নয়াহাট' নামক সাপ্তাহিক বাজারটার অস্তিত্ব আছে। বাস্তবে একটি গ্রেট জিরো। 

নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা কল্পনাও করতে পারবে না, এককালে এখানে এক জমজমাট বাজার ছিলো। নিমের হাওয়া, ইলিশের আঁশটে গন্ধ, পান, সুপারি, চুনের ভাসমান দোকান; ইব্রাহীম চাচার সুঁই-সুতো আর টুপির দোকান, চালের দোকান, জাদুকরের জাদু প্রদর্শনী, সর্বোপরি আট পৃষ্ঠার কবিতা নিয়ে কবিতাওয়ালার অনিবার্য উপস্থিতি, তাঁর সুরেলা কন্ঠের কবিতা পাঠ—যার রেশ এখনো এইখানে, এই পড়ন্ত বেলায় আবুলের কানে বাজে, অজান্তে ভিজে যায় দু চোখের পাতা, উপরন্তু বাজারের পুব পাশে শত বছরের প্রাচীন রেইন ট্রির তলায় আমিন বন্দার বিখ্যাত বুক-স্টল, যেখানে আবুলের গল্প-বই পড়ার হাতেখড়ি। এলাকার সবাই আমিন বদ্দাকে কেন যে জেঠা আমিন ডাকতো তা এখনো আবুলের অজ্ঞাত। বড্ড সরল মানুষ ছিলেন তিনি ।

এ বাজারের দক্ষিণ পাশেই আবুলদের বাড়ি, নাম সওদাগর বাড়ি। বাজার থেকে যে বড় মেঠো রাস্তাটি এঁকেবেঁকে সর্পিল গতিতে আবুলদের বাড়ি ছুঁয়ে অনেক দূরে, দিগন্তের অন্য পাড়ে, স্বপ্নের দেশ পর্যন্ত পৌঁছেছে, বর্ষায় কাদা আর পানিতে, শুকনা মৌসুমে ধুলোসমুদ্রে ডুব দিয়ে ঘূর্ণি বায়ুতে আবুলের অমন কুচকুচে কালো চুলে, আর মন ভোলানো ডাগর ডাগর চোখে ধূলির প্রলেপ বুলাতো এখন তা পিচঢালা। বাজার থেকে মাত্র শ খানেক কদম দূরে পাশাপাশি দুটো মাঝারি আকারের পুকুর, সুপারি আর নারিকেল গাছে ঘেরা, দুয়েকটা ভাল, শিমুল আর মাদার গাছও আছে। পুকুরের পুব-পাড় ছুঁয়ে চলে গেছে রাস্তাটা। খানপাচেক ঘর নিয়ে বাড়িটা, নাম নোয়াবাড়ি। কেউ কেউ চেয়ারম্যান বাড়িও বলেন। প্রথম পুকুরের উত্তরপাড় ঘেঁষে এলাকার একমাত্র নলকূপটি অবস্থিত। এ পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি চমৎকার শানবাধানো ঘাট। ঘাটের দু পাশে দুটো বিশাল বিশাল কৃষ্ণচূড়া। পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোনায়ও একটা ফাগুনে যখন আগুনে কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালগুলো লাল হয়ে যায়, তখন অনেক পথিক চলতি পথে থমকে দাঁড়িয়ে এক লহমা না দেখে পারে না। কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো যেন আবুলের শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।

নোয়াবাড়ি পেরিয়ে কদম কয়েক পর পেশকারবাড়ি। ছিমছাম সাজানো গোছানো। গোটা তল্লাটের গর্ব। এ বাড়ির মানুষগুলোও কেমন যেন আলাদা। শিক্ষিত, রুচিবান। সারিবদ্ধ কয়েকটা মাটির ঘর, চালে টিন, আটচালা; সামনে বিশাল পুকুর, পুকুরের দক্ষিণ পাড় এতই বিশাল, যেন খেলার মাঠ। সবুজ ঘাসে ঢাকা, পুব পাড় ছুঁয়ে গেছে বাজার থেকে আসা বড়ো মেঠো রাস্তাটি। পাড়জুড়ে সোনালো গাছের সারি। গাছগুলো কোনো কাজের না। কিন্তু বসন্তে যখন সোনারঙ ফুলে গাছগুলো ছেয়ে যেতো, আবুলের মনে হতো, এ তার স্বর্গ। নোয়াবাড়ি আর পেশকারবাড়ির ঠিক মধ্যিখানে গ্রামের প্রধান মেঠো রাস্তাটার পূর্ব পাশে ছিলো জোড়া শিমুলবৃক্ষ। আবুলেরা বলতো তুলাগাছ। এমন বিশাল, ডালপালা ছড়ানো শিমুলবৃক্ষ শিল্পীর আঁকা ছবিতেও দেখেনি আবুল। বসন্তের শুরুতে এখানে রঙের মেলা বসতো, খেলায় মাততো যত মধুমক্ষিকা। ঝরে পরা শিমুল কুড়াতে গিয়ে বন্ধুতে বন্ধুতে কত্তো ঝগড়া ভাবতেই হাসি পায় আবুলের। পেশকার পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোনায় ছিলো তিন-চারটে বিশালকায় তালগাছ। ভাদ্র মাসে টসটসে রসে ভরা পাকা তাল ঝুপঝাপ করে ঝরে পড়তো। একবার তো একটা পাকা তাল প্রায় আবুলের মাথায় পড়েছিলো, খুশিতে আটখানা হয়ে সে বিশাল ভালটি নিয়ে একছুটে চলে গিয়েছিলো মায়ের কাছে। ভয়? না তা সে পায়নি। কিন্তু এখন সে কথা ভাবতেই সারা গায়ের সব কটা লোম এক্কেবারে খাড়া হয়ে যায়। আর মাত্র কদম খানিক পেরুলেই আবুলদের বাড়ি। অবশ্য দু-বাড়ির মাঝখানে এক বিশাল মজাপুকুর । নাম বড় পুকুর। তিন পাড়জুড়ে প্রাচীন কবরস্থান। আগাছা আর জংলায় ভরা। সাপ আর বনবিড়ালের বাসা। রাত-বিরাতে চলতে গিয়ে এখানে অনেকেই বিপাকে পড়তো। বর্ষাকালে ভয়টা বেশি। হাটু অবধি কানা, বিষাক্ত সাপের ভয় নিয়ে বড় পুকুরের পুব-পাড় পার হওয়া তখন চাট্টিখানি কথা ছিলো না। অনেকেই হাতে তালি বাজিয়ে, জোরে জোরে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে জায়গাটা পার হতো। আবুলদের রসুইঘর থেকে সে আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যেতো। এ আওয়াজ শুনে ছোটো আবুল ভয়ে জড়সড় হয়ে মায়ের আঁচলের নিচে নিজেকে লুকিয়ে নিতো।

বাজার থেকে আরাকান সড়ক হয়ে আসা বড় মেটো রাস্তাটি আবুলদের বাড়ি ছুঁয়ে দক্ষিণে ধানি জমির মাঝখান দিয়ে অনেক দূর অবধি চলে গেছে। বড় পুকুর ঘেঁষে একটু পুবে-দক্ষিণে আরেকটি পুকুর: নাম ছোট পুকুর। পুকুরটিও মজা। তবে হরেক রকম ছোট-বড় গাছগাছালিতে ঠাসা। ডালে ডালে অগুনতি পাখ-পাখালির বাসা। গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুরে ঘুঘুর মন উদাস করা ডাক কিশোর আবুলকেও কেমন উতলা করে তুলতো। বড় পুকুরের ঠিক মাঝ বরাবর একটি ছোট্ট মেঠো রাস্তা, আবুলদের বাড়ির দক্ষিণ-পাশ ছুঁয়ে চলে গেছে পুব দিকে; যার এক প্রান্ত ছুঁয়ে আছে চৌধুরী বাড়ি, এলাকার সবচেয়ে ধনী লোকদের বাস এখানে। এ বাড়ির প্রায় সকল পরিবারেরই পেশা তেজারতি। ব্যবসা তাদের পূর্ব-পাকিস্তানের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র চাকতাই, খাতুনগঞ্জ। এ ব্যবসা তাদের পূর্বপুরুষের, ইংরেজ বেনিয়াদের আমলের। বাড়ি দুটো দাঁড়িয়ে আছে ঘেঁষাঘেঁষি করে; কিন্তু এ দু-বাড়ির কাজকর্মে, চলাফেরায় বিস্তর ব্যবধান। মিলটা বেশি পেশকার ও নোয়াবাড়ির সাথে। কেন? না, তার হদিস আবুল জানে না। চৌধুরী বাড়িতে ঢোকার মুখে রাস্তার একটা প্রান্ত উত্তর দিকে মুখ ঘুরিয়ে আবুলদের পুকুরের পুব-পাড় হয়ে এলাকার একমাত্র বড়ুয়া পাড়ার মাঝখান দিয়ে বিশাল বৌদ্ধবিহারের কোল ঘেঁষে আরাকান সড়কে গিয়ে মিশেছে।

আবুলদের বাড়িতে চারটি মাত্র ঘর। আবুলের বাবার কথা ছেড়ে দিলে, আর সকলই গৃহস্থ। জনসংখ্যার তুলনায় বাড়ির সামনের পুকুরটা সত্যি বড়সড়। বলা যায় একটি ছোটোখাটো দিঘি। এটি কিশোর আবুলের গর্ব। এ পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় খান চারেক ঘর নিয়েই সওদাগর বাড়ি। অবশিষ্ট বিস্তীর্ণ জায়গা খালি। খালি জায়গা পূরণ করেছে কেজো অকেজো রকমারি গাছপালা। চার সারির ঘর তাদের, মূল ঘর যার নাম বড় ঘর, সামনে খালি জায়গা, নাম উঠোন; পেছনে রসুই ঘরের পর বিস্তীর্ণ খালি জায়গা, আগাছা আর বেভসবনে ভরা, এখানেই খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কার্যাদি সম্পন্ন করা হতো, এখন যা ভাবলেই আবুলের গা ঘিনঘিন করে ওঠে। শুকনো মৌসুমে

তাও চলতো, কিন্তু বর্ষাকালে? না, আবুল আর ভাবতে পারে না। বাড়ির এ জায়গার নাম বারিচা। এ অবস্থাটা কেবল আবুলদের নয়। ধরতে গেলে গোটা দেশের। স্যানিটেশন সম্পর্কে তখন দেশের জনগণের ধারণা ছিলো শূন্য। উঠোনের পর এক সারিতেই ছিলো দহলিজ। আবুলদের দহলিজ প্রায় সত্তর হাত লম্বা ছিলো। বড় ঘর আর দহলিজ উভয়েই ছিলো মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনি। দহলিজের সামনে পুকুর পাড় অবধি ঝকঝকে পরিষ্কার খালি জায়গা, আবুলেরা বলতো 'চড়ান'। এটা আবুলদের খেলার জায়গা। বড়সড় মজলিশ, মাহফিল, বিয়েশাদির অনুষ্ঠানাদিও অনায়াসে সম্পন্ন হতো এখানে। তারপর একটু ব্যবধানে, পুকুর পাড়ে প্রত্যেক পরিবারের আলাদা আলাদা গোয়ালঘর, তার সাথে লাগোয়া আটচালা এবং একটি করে ঢেঁকিঘর। দহলিজটা আবুলদের ক্ষেত্রে পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সকালে আরবি- ধর্মীয় শিক্ষা এবং সাঁঝের বেলা থেকে এশা অবধি স্কুলের পড়া বাংলা, ইংরেজি, গণিত পড়তো আবুলেরা। আবুলদের যৌথ পরিবার। মা বাবা পাঁচ ভাই-বোন এবং চাচা-চাচি ও পাঁচ চাচাতো ভাই-বোন নিয়ে চৌদ্দজনের এক বিরাট পরিবার। দাদা-দাদি কেউই বেঁচে ছিলেন না। আবুলের বাবার এক আশ্রিতা, আবুলের বয়সী এক মেয়েকে নিয়ে ওদের সাথে থাকতো। একজন হুজুর, একজন লজিং মাস্টার, একজন বছর চুক্তিতে কাজের লোক নিয়ে আবুলের পরিবারের লোকসংখ্যা ছিলো এক কম বিশ।

গোলার ধান, পুকুরের মাছ আর পারস্পরিক মিলমিশ নিয়ে আবুলদের সুখের সংসার। মায়ের চেয়ে চাচির নিকটই আবুলের বেশি আবদার খাটতো। অন্য ভাই-বোনেরা যখন একখানা পিঠে-পুলি নিয়ে খুশিতে ধেই ধেই, চাচি তখন আরো দু খানা পিঠে-পুলি আঁচলের তলা থেকে বের করে, আবুলকে ধরিয়ে দিতো। আবুলের তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হতো না। কেন যেন তার ধারণা জন্মে এটা তার প্রাপ্য, তার অধিকার। তার ছোট্ট মনে এর একটা ব্যাখ্যাও সে দাঁড় করিয়ে নিয়েছিলো। আবুলের বাবা তার চাচার চেয়ে অন্তত বছর দশেকের বড়। বিয়েও করেছেন চাচার অন্তত এক যুগ আগে। কিন্তু সন্তানের বাবা হয়েছেন ছোটো ভাইয়ের অনেক পরে। তা-ও কন্যাসন্তান। একে একে তিন তিনটি বোনের পর আবুলের জন্ম। আবুলের পিঠাপিঠি বড় বোনটি জন্মের সাথে সাথে মারা যায়। উপরন্তু আবুলের পরের সন্তানটিও ছেলে, তাই সকলের কাছে আবুলের একটা আলাদা স্থান ছিলো। আবুল ভাবতো

মায়ের কোলজুড়ে সে তার বাপের বংশরক্ষা করতে আল্লাহর রহমত হয়ে এসেছে। তাই পরিবারে তার অবস্থান আলাদা কিন্তু চাচির অপত্য স্নেহের হেতু অন্য। আবুলেরই বয়সী, মাস ছয়েকের বড়, তার এক চাচাতো ভাই ছিলো, মায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে এ চাচাতো ভাইয়ের সাথে চাচির স্তন্যপান করেই আবুল বেড়ে উঠেছে। তাই আবুলের প্রতি চাচির এম মমতা। এ ভাইটি বড় হয়েও আমৃত্যু আবুলের ছোটো হয়ে ছিলো, আবুল এতো বিশ্বাস, এতো ভালোবাসা আর কারোর কাছ থেকেই পায়নি। কৈশোরে একসাথে বেড়ে উঠেছে তারা। এখনো অনেক ঘটনা মনে হলে আবুল মনে মনে হাসিতে ফেটে পড়ে।


সওদাগর বাড়ির এক্কেবারে দক্ষিণের ঘরটা আবুলদের। মাটির দেয়াল, কাঠের ছাদ, আটচালা টিনের ছাউনি। পুবমুখী। দক্ষিণে জানালা। জানালায় চোখ রাখলে মাঝে মধ্যে দু-একটা সবুজের ছায়া দেখা বৈ দৃষ্টিসীমার মধ্যে দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না; আকাশ যেখানে গাঢ়-সবুজের রেখা ছুঁয়েছে, সেখানেই থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় এখানে বাসা বেঁধেছে গাঢ় অন্ধকার। বাড়ির দক্ষিণে একবন্দ নাল জমি। তারপর পূর্ব-পশ্চিম দীর্ঘ মেটো রাস্তা। রাস্তার পর ধানি জমি। এরপর ছোট পুকুর। ছোট পুকুরের পুব পাড় ঘেঁষে বিশাল চৌধুরী বাড়ির পশ্চিমাংশ। এদিকে লতাপাতায় ঘেরা এক বিশাল জঙ্গল। এখানে অনেক রকম পাখপাখালির সাথে আছে অগুনতি ডাহুক। গাছের ডালে ঘুঘুর বাসা। কেয়াঝাড়, বাঁশঝাড় বেতসবন যেন ডাহুকের স্বর্গরাজ্য। শীতের দিনে তালগাছের শক্ত আঁশ দিয়ে তৈরি এক প্রকারের ফাঁদ পেতে অনেকেই এ ডাহুক ধরতো। আবুলের মায়ের মায়ার শরীর, কিন্তু এ ডাহুকের মাংস তার বড় প্রিয়। ফাঁদওয়ালাদের নিকট থেকে ডাহুক কিনে, জবেহ করে রান্না করে খেতো। আবুল বুঝে না এমন সুন্দর পাখির মাংস মানুষ খায় কী করে! আবুলের বড় কষ্ট হয়।

আবুলদের ঘরের সাথে প্রায় লাগানো এক বিশাল বয়স্ক মাদার গাছ। ডালপালা কম। কাণ্ডটা প্রকাণ্ড। আর এ কাণ্ডটা জড়িয়ে এক বিশাল বুনো লতা গাছটার চূড়া অবধি উঠে গেছে। এটা যেমন মোটা তেমন শক্ত। লতাটা দিয়ে প্রকৃতি যেন নিজের খেয়ালে বানিয়ে নিয়েছে একটি চমৎকার দোলনা। এটি ছিলো আবুলের একার সম্পত্তি। আবুলকে তুষ্ট করে তবেই অন্য কারো পক্ষে এ দোলনায় চড়া সম্ভব হতো। কয়েকটা ভালো জাতের আম গাছ--একটা সুপারি গাছ, একটা লিচু গাছ আবুলদের বাড়ির পশ্চিম ৩ দক্ষিণ পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। লিচুগুলো ছিলো যেমন বড় তেমনি মিষ্টি। ফলতোও প্রচুর। পাকার সময় হলে পাখপাখালি আর বাদুরের ভয়ে গোটা লিচু গাছটাই জল দিয়ে ঢেকে রাখতো। দক্ষিণের লতার দোলনাটায় বলতে গেলে আবুলের গোটা কৈশোরটা কেটেছে। আবুলের চাচাতো ভাই

আলম, সে আবুলের মাস ছয়েকের বড়। দুজনে ছিলো হরিহর আত্মা। দোলনায় আবুলের পরেই তার অধিকার। এ আলমের সাথেই আলমের মায়ের স্তন্য ভাগাভাগি করে খেয়ে বড় হয়েছে আবুল। আবুল ভাবে, হয়তো তাই গোটা জীবনটাই আবুলের প্রতি আলমের অপত্য প্রশ্রয়, প্রশ্রয় পেয়েছে বেশুমার। আবুলের যখন থেকে তার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ে, তখন তার বয়স সাত বছরের বেশি। এর আগের কোনো কথা তার মনে নেই, মায়ের মুখে শোনা। তার মা চমৎকার সুন্দর করে কথা বলতো। সংসারের আটপৌরে কথাও তার কণ্ঠে গল্প হয়ে যেতো। মা, পুঁথি, রূপকথা, জায়নামাজ, তসবির ছড়া আর ঈষৎ দাঁত দেখানো স্বৰ্গীয় হাসি কিশোর আবুলের নিকট সমার্থক ছিলো। মা যখন রাতের শেষ নামাজ শেষ করে ডান হাতের তর্জনীও বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে অপূর্ব কৌশলে তসবির ছড়ায় সমুদ্রের ঢেউ তুলে তসবি শুনতো, তখনই গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আবুল জায়নামাজের উত্তর-পূর্ব কোণটায় বসে মাথাটা আলতো করে মায়ের কোলে এলিয়ে দিতো। আর মা-ও তার বাম হাত দিয়ে ছেলের লম্বা-কালো-ঘন কুন্তলে পরম আদরে বিলি কাটতো। এক সময় গোনা শেষ হলে পরম ভক্তিতে তসবির ছড়াটায় চুমো খেয়ে জায়নামাজের শিয়রে রেখে দিয়ে কেমন এক মন-পাগল করা মধুর কণ্ঠে বলতো: “কীরে পাগলা কিছু বলবি?” আবুলের কণ্ঠে তখন ভাষা থাকতো না। সব কথা এসে আবুলের মায়াময় দু চোখেই ঠাঁই নিতো। নিষ্পলক চোখে সে মায়ের মুখে কী যেন খুঁজতো। ততক্ষণে জায়নামাজের পশ্চিম, উত্তর আর পূর্ব দিকে খালি জায়গায় গোটা বাড়ির ছেলে-মেয়ে বৃদ্ধাদের মেলা বসে যেতো। জায়নামাজের দক্ষিণ ধরে, দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে বিছানো বলে, সেদিকে কেউ বসতে পারতো না। কেউ পিঁড়িতে, কেউ মাদুরে আর কেউ নিঃসঙ্কোচে মাটিতেই বসে পড়তো ।


তিন কামরার ঘর আবুলদের। রসুইঘর মূলঘর থেকে পৃথক। সামনের কামরায় আবুলের বাবার বার্মা থেকে আনা একটি বিশাল পালঙ্ক। পালঙ্কের গায়ের হাতের কাজ সত্যিই দেখার মতো। মাঝখানের কামরায়, যেখানে তার মা নিয়মিত নামাজ পড়তো, একটি বিশাল আকারের সিন্দুক। এটিও বার্মা থেকে কেনা। এর মধ্যে পাঁচ ফুট দীর্ঘ একজন মানুষ অনায়াসে দাঁড়াতে পারতো। তার পাশ ঘেঁষে একটি কাঠের বড়সড় আলমারি; এছাড়া গোটা ঘরে খানকয়েক হাতলযুক্ত চেয়ার—এ-ই ছিলো আবুলদের আসবাবপত্র।

অবশ্য তখনকার দিনে এটুকুও অনেকের ছিলো না। আবুলদের আরেকটি মহার্ঘ্য বস্তু ছিলো “কলের গান'। ভীষণ শৌখিন বস্তু। গোটা এলাকায় দ্বিতীয়টি আর কারো ছিলো কিনা তা আবুলের জানা ছিলো না। সপ্তাহে কেবল বিষ্যুদ-শুক্র এ দু দিন এ মহার্ঘ্য-বস্তুটি তার ঘোমটা খোলতো, যখন আবুলের বাবা শহর থেকে গ্রামে আসতো। অবশিষ্ট পাঁচ দিন কালো কাপড়ের এক আবডালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। আবুলের বাবা রাতের খাবার খেয়ে যন্ত্ররটা নিয়ে বসতো। বসতো একটা মাদুর বিছিয়ে। মাঝখানে যন্ত্ররটা, পশ্চিম দিকে মুখ করে যন্ত্ররটার সামনে বাবা, চারদিকটা ঘিরে কচি কাঁচারা। তারপর যন্ত্ররটা খুলে সাপের বিশাল মাথার মতো একটা অংশে এক মুখ ভোঁতা, অন্য মুখ ধারালো একটা পিন একটি ছিদ্রে ঢুকিয়ে আটকে দিতো। এরপর সামনের দু পায়ে ভর দিয়ে পাছার উপর বসা কুচকুচে কালো কুকুরের ছবিওয়ালা একখানা 'রেকট' কাগজের মোড়ক হাতে বের করে, যন্ত্রটার মাঝখানে উঁচু হয়ে থাকা একটি পিনের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে, পিন লাগানো সাপের মোটা মাথাটা তার উপর বসিয়ে, যন্ত্ররটা চালিয়ে দিতো। 1 যন্তরটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতো কালবিজয়ী সব স্বর-সুর-গান। 

এখনো যার রেশ অলস মুহূর্তে আবুলকে আনমনা করে তোলে। কোনো দিন সে ঘরের কোনো মেয়েকে গানের এ আসরে দেখেনি। তবে তার মাকে সে তখন ঘরের মাঝখানের কামরার দক্ষিণের জানালার গারদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। রাতের বেলা। কামরায় বাতি নেই। জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক আলোতে মায়ের মুখে বিষাদ আর অশ্রুর কেমন আবছায়া ছায়া মাঝেমধ্যে আবুলের নজরে আসতো। ছোট্ট আবুল তখন কিচ্ছুই বুঝতে পারতো না। এখনও কী পারে। এ আসরের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সময়টা ছিলো পিন কালেকশন। সাপের মাথায় লাগানো পিন ভোঁতা হয়ে গেলে বাতিল হয়ে যেতো। এ বাতিল হওয়া পিনের দখল নিয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেতো। এ প্রতিযোগিতায় আবুলের অবস্থান সকলের পেছনে। তবে আবুলরা একটা কলের গান'-এর মালিক হওয়ায় সমবয়সীদের কাছে আবুলের অবস্থান একটু উঁচুতে  ছিলো। কেন জানি গান নয়; গল্পই কিশোর আবুলকে টানতো বেশি। আর এ আসর বসতো তাদের ঘরে সপ্তাহে পাঁচ দিন, রাতের খাবারের পর, মায়ের জায়নামাজকে ঘিরে। মায়ের ঝুলিতে কতো রূপকথা ছিলো তা আবুল এখনও
আন্দাজ করতে পারে না। আবুল অনেক কিছু ভুলেছে
, কিন্তু
মায়ের কণ্ঠে শোনা রূপকথাগুলো এখনো স্মৃতিতে অম্লান
, জীবন্ত।
আজ থেকে অর্ধ শত বছর আগে একজন গেঁয়ো অর্ধ-অশিক্ষিত মহিলা জায়নামাজে বসেই গল্প
বলছে—ভাবতেই আবুলের গা এখনো শিহরিত হয়ে ওঠে। এ আসরের একজন নিয়মিত বালিকা সদস্য
ছিলো। ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত
, অমাবস্যা পূর্ণিমা কোনো
প্রাকৃতিক অবস্থাই তাকে বাধা দিতে পারতো না। আবুলের চেয়ে বছর চারেকের বড়। তার
ছোট দাদার মেয়ে। মক্তবে যেতো কিন্তু তাকে স্কুলে দিতো না। তার সারা অঙ্গে যেন
জগতের সব রূপ-লাবণ্য ঠাঁই নিয়ে ছিলো। আবুলকে ভীষণ মায়া করতো। আবুলদের ঘরে এসেই
সে প্রথমে আবুলকেই দখল করে নিতো। তাকে কোলে নিয়েই তবেই তার গল্প শোনা। আবুল তাকে
রাঙা ফুফু বলে ডাকতো। রাত বেশি হলে সে আবুলের মায়ের সাথে—থেকে যেতো। সকালে ঘুম
ভাঙলেই আবুল দেখতো সে তার রাঙা ফুফুর বুকের মাঝেই ঘুমিয়ে আছে



'লুকোচুরি' ছিলো
কিশোর আবুলের প্রিয় খেলা। অবশ্য আবুলেরা বলতো
'ফুলুক' খেলা।
বর্ষার বারি যখন ঝরতো নির্ঝরে
, টিনের চালে ঘোড়া ছুটতো
অবিরাম
, কচুখেত, ধানক্ষেত
যখন জলে টইটুম্বুর
, ধান আর কচুখেতে টাকি আর শোল
মাছ তাঁদের সুন্দর সুন্দর লাল লাল পোনার ঝাঁক নিয়ে নিবিঘ্নে বিচরণরত
, পুকুরের
পাড় উপচে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি
, দিনের
বেলা সাঁঝের আঁধার ঘিরেছে চারিধার
, স্কুলে
যাওয়ার ঝক্কি নেই। মা বাস্ত রসুইঘরে চাল আর ছোলা ভাজায়
; তখনই জমতো
এ খেলা। ঢেঁকিঘর
, গোয়ালঘর, দহলিজ এমন
কী বড়ঘরও এ খেলার এলাকা থেকে বাদ যেতো না । খেলতে খেলতে আবুল যদি দেখতো শোল মাছ
তার পোনার ঝাঁক নিয়ে গোয়ালঘরের পাশের নতুন পুকুরে ঢুকে পড়েছে
, তা হলে
কেল্লা ফতে। খেলা খতম
, খেঁজো জাল। আবুলের বাবা সে
আদ্যিকালে আবুলের জন্মের অনেক আগে
, যখন তার
ব্যবসা তুঙ্গে তখনই উঠোন-সংলগ্ন এ পুকুরটি খনন করেছেন। নাম নতুন পুকুর। আবুলের
যখনকার কথা বলছি
, তখন পুকুরটি আর পুকুর নেই, মজে কুয়ো
হয়ে গেছে। কচুর দামে ভরা। সুদিনে শুকনো
, বর্ষায়
জল কানায় কানায়। আবুলের শোল মাছ ধরার ফাঁদ। চারদিকে উঁচু পাড়। পশ্চিমের পাড়ে
মাঝ বরাবর একটি জান। এ জান দিয়ে বিলের পানি অনায়াসে ঢোকে আর বের হয়
আর এর
সাথে চরতে চরতে পোনাসহ শোল



ও টাকি
মাছ বিহারে এসে অঘোরে প্রাণ হারায়। মাছের অস্তিত্ব টের পেলে আবুল চুপে চুপে একটি
মাছ ধরার জাল এনে
, অভ্যস্ত হাতে পুকুরে জানটা
ঘিরে দেয়। তারপর পুব দিক থেকে পুকুরের পানিতে নেমে বারবার গোলা দিতে থাকে। এতে
কাজ হয়। ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে মাছটা লাফ দিয়ে জালের উপর পড়ে। এবার জালটা
গুটিয়ে নিলেই হলো। বর্ষাকালে এ দৃশ্য অত্যন্ত চেনা। তারপরও প্রতিবার গোটা বাড়িটা
পুকুর পাড়ে ভেঙে পড়ে। আবুলের মা-ও হাতের সব কাজ রেখে ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায়
বাঁধানো দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়



এই
স্মৃতিটি কি লজ্জার না আনন্দের তা এখনও স্থির করতে পারেনি আবুল। শুকনো মৌসুম।
আবুলেরা বলতো সুদিন। হেমন্তের ধান উঠেছে। নবান্ন শেষ। এবার আবুল এগারোয় পা
রেখেছে। রাঙা ফুফুর পনেরো। বছরের তুলনায় শরীর বাড়ন্ত। দেখে মনে হয় আঠারো বছরের
পূর্ণ যুবতী। গায়ের রঙ দুধে-আলতা। মাথার চুল
, কুচকুচে
কালো। ঘন এবং লম্বা। কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু ছোঁয় ছোঁয়। প্রশস্ত ললাট
, চিকালো
নাকের দু পাশে বড় বড় বোকা বোকা চোখে যেন বাসা বেঁধেছে গোটা বিশ্বের বিস্ময়।
স্ফীত বক্ষ
, ক্ষীণ কটি। দু চোখের
কৃষ্ণ-কালো ঘন ভ্রূ জোড়া লাগানো। যেন স্বর্গ থেকে ভুল করে নেমে আসা কোনো উর্বশী।
হেমন্তের পড়ন্ত বিকেল। দিগন্তজোড়া শূন্য মাঠে বসেছে অনেকগুলো ফুটবল খেলার আসর।

 আবুলেরও একটা দল আছে। কিন্তু সেদিন কেন জানি আবুলের রোখ চেপেছে, ফুটবল নয়, লুকোচুরি
খেলবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বাড়ির সকলে মিলে মাতলো লুকোচুরি খেলায়। এবার
আবুলদের লুকানোর পালা। আবুল একটা নিরাপদ গোপন জায়গার সন্ধানে ব্যস্ত। হঠাৎ বলা
নেই
, কওয়া নেই, কোত্থেকে
রাঙা ফুফু এসে হাজির। সে আবুলের হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেলো বাড়ির
সামনের পুকুরের পশ্চিম পাড়ের মাঝ বরাবর বিশাল তেঁতুলগাছটার তলায়
; যেখানে
পর্বতপ্রমাণ একটি খড়ের স্তূপ। ফুফু নিজ হাতে খড় সরিয়ে শূন্য জায়গায় আবুলকে
বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর সরানো খড়গুলো তাদের গায়ের উপর টেনে নিয়ে বললো:
“দেখিস আজ আমাদের কেউ খুঁজে পাবে না।” খেলার উত্তেজনায় আবুল পরম নিশ্চিন্তে খড়ের
গাদার মধ্যে রাঙা ফুফুর উষ্ণ বুকে মুখ রেখে শুয়ে থাকলো। কিন্তু তার অজান্তে কখন
ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি তার দু চোখের পাতা এক করে দিয়েছে তা সে
 



বুঝতেই
পারেনি। রাস্তা ফুফুর হাতের ধাক্কায় যখন তার ঘুম ভাঙে
, তখন খেলা
শেষ
, খেলার সাথীরা উধাও, কেবল
দূরের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে সায়াহ্নের আজানের সুমধুর ধ্বনি। আবুল চোখ খুলে
, মুখ তুলে
রাঙা ফুফুর মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক। সে দেখে রাঙা ফুফুর গোটা মুখ কে
যেন আবির দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে। চোখের পাতাগুলো কেমন ভারী ভারী। দু ফোঁটা অশ্রু
চোখ থেকে গড়িয়ে ঠিক নাকের ডগার দু পাশে দুটো মুক্তো হয়ে আটকে আছে। ফুফুকে
কিচ্ছুটি না বলে
, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো
আবুল একছুটে রসুইঘরে এসে মাকে ঝাপটে ধরে ছিলো।

এমনিতেই আবুলকে তার মা বকাঝকা করতো
না। তারপরও সাঁঝ অবধি একটানা বাইরে থাকার অপরাধবোধ
, আর
রাঙাফুফুর ব্যাখ্যাতীত রহস্যঘন কাণ্ডটি ছোট্ট আবুলকে কেমন ভীত-সন্ত্রস্ত করে
তুলেছিলো। মা শুধু বললো: “কীরে পাগলা
, এতক্ষণ
কোথায় ছিলি
?” আবুল কোনো জবাব না দিয়ে
মাথাটা মায়ের কোলে গুঁজে দিয়ে ওখানেই মাটিতে বসে পড়লো। এখনো মাঝে-মধ্যে রাঙা
ফুফুর কথা আবুলের মনে পড়ে। অন্তত চার দশক আবুলের তার সাথে দেখা হয়নি।
'লুকোচুরি' খেলার
বছরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। রাঙা ফুফুর কথা মনে হলেই আবুলের কেবল গলা ছেড়ে গাইতে
ইচ্ছে করে: তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম



সে এখন
ঘোমটা পরা কাজলবধূ দূরের কোন গায়



পথের মাঝে
পথ হারালে আর কী পাওয়া যায়...



আবুল একটা
বোকার হদ্দ। কিচ্ছুটি তার মনে থাকে না। কিন্তু মনে মনে তার ছিলো অনেক স্বপ্ন। সে
কেবল তার নিজের
; কাউকে তার শেয়ার দিতে
পারেনি। মুক্তাকে তো নয়ই
, এমনকি মাকেও না। তবে শৈশবের
যতো কথা তার মনে আছে তার মধ্যে একটা হলো: দু চোখের পাতা এক হলেই সে স্পষ্ট দেখতে
পেতো রঙ-বেরঙের অগুনতি জীবন্ত বিন্দু
, উড়ছে আর
উড়ছে
, তাকে ঘিরে তার চারপাশেই
উড়ছে। আর এই বর্ণিল জগতে ছোট্ট একটি পাখির মতো হাত দুটোকে ডানা করে
, পরম
নিশ্চিন্তে
, বর্ণনাতীত আনন্দে সাবলীলভাবে
আকাশের বাতাসে ভাসছে সে। সে তার আরেক জগৎ
; সুখ দুঃখের
অতীত স্বপ্নের জগৎ।

আবুল এ জগৎ হারিয়ে ফেলেছে। আবুল অনেক কিছু হারিয়েছে, কিন্তু
স্বপ্নের জগটা
? আবুল, বিষণ্ণ
আবুল ভাবে
, মৃত্যুর আগে আরেক বার কি তা
ফিরে আসতে পারে না
? অনেক বার তার মনে হয়েছে তার
সাংবাদিক বন্ধু এখন যার দেশ জোড়াখ্যাতি বিশিষ্ট কলামিস্ট
, সমাজ
পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে যাঁরা নিরলস কলমযুদ্ধে নিয়ত মশগুল তাঁদের একজন আবুলের
প্রিয় ব্যক্তিত্ব
, নূরুল মোমেন ভাইয়ের হাত ধরে
যার এ জগতে পদার্পণ – সে ইকবাল
; যার একটু-আধটু রঙিন পানির
অভ্যেস আছে—তার কাছে জানতে চাইবে
, এ পানি পান করে আবুল কি তার
শৈশবের সে হারানো স্বপ্নের জগটা ফিরিয়ে আনতে পারবে
? লোকলজ্জা, ভয় আর
ভীরুতা আবুলের কন্ঠ রোধ করে দিয়েছে। জানে
, কোনোদিন
আবুল তা পারবে না। আবুল পারেনি
, তার গায়ের সাথে গা ঘেঁষে
বসা—মুক্তার গণ্ড থেকে তার কুন্তলগুচ্ছ পরম আদরে সরিয়ে দিতে
, পারেনি
তার মনে গভীর গহিনে লুকানো
, মুক্তার মাঝে, স্বর্গ
থেকে নেমে আসা প্রথম
'ইভ'কে দেখার
বাসনার কথা বলতে।

 সবকিছু সহজে ভুলে যাওয়া মানুষটি ইস্কুলের পাঠ কিন্তু ভুলতো না।
পরীক্ষায় গোটা গোটা অক্ষরে সবগুলোর প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর
, উত্তরপত্রে
লিখে দিয়ে আসতো। ফলাফলে সহপাঠীদের সকলের উপরই তার নাম থাকতো। আলম
, তাদের
বাড়িতে আশ্রিতা জরিমন ফুফুর মেয়ে
, সেজো
দাদার দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে আর আবুলের তিন বছরের বড় বোন জাহান একই ইস্কুলের একই
শ্রেণিতে 
পড়তো।
নয়াহাটের ঈষৎ-পশ্চিমে
, আরাকান সড়কের দক্ষিণ পাশে
খোলা জায়গায় ছিলো আবুলদের ইস্কুল। সামনে প্রায় রাস্তার উপরেই বিশাল বিশাল
ডালপালা ছড়ানো এক বিরাট তুলাগাছ—ভাই আবুলদের ইস্কুলকে তুলাতলী ইস্কুলও বলতো।
শ্রেণিকক্ষের অভাবে তুলা গাছতলার মুক্তাঙ্গনে উদার আকাশের নিচে আবুলদের হাতে খড়ি।

এখানে আবুল প্রাণের আনন্দে সুর করে উচ্চেস্বরে শতকিয়া, গণ্ডাকিয়া
আয়ত্ত করছে। ইস্কুলের সবকিছু ভুলে গেলেও মৌলভি স্যারের ডাণ্ডার মারের কথা কবরে
গেলেও ভুলবে না।
'হুক্কার ব্যাটা হুক্কা, হুক্কার
বেটি হুক্কা
'—এ-ই ছিলো মৌলভি স্যারের
সার্বক্ষণিক জিকির। তাঁর প্রহারের ভয়ে অনেকেরই পড়ালেখায় প্রথম শ্রেণিতেই পড়েছে
পূর্ণযতি। তারপরও কেন জানি তিনি গোটা এলাকার মানুষের প্রিয়পাত্র ছিলেন
, বিশেষত
মেয়েদের। শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর তাবিজ-কবজের জমজমাট ব্যবসা – তিনি নাকি
জিন-পরির আছর সারানোর ওস্তাদই ছিলেন। আবুল এই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত
পড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মার্বেল খেলা ছিলো আবুলের নেশা। তার ছিলো জাদুকরী
হাতের টিপ। এই খেলায় হার-জিত নিয়ে অনেকের সাথে তার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে
, যার জের
মধ্যবয়স পর্যন্ত আবুলকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। এ কথা ভাবলেই এখন তার হাসি পায়।
তখন পঞ্চম শ্রেণিতে আলাদা বৃত্তি পরীক্ষার রেওয়াজ ছিলো। যে ইস্কুল বৃত্তি আনতে
পারতো এলাকায় শিক্ষা দপ্তরে তার সুনাম বৃদ্ধি পেতো।

চতুর্থ শ্রেণি থেকে প্রথম
হয়ে আবুল পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বৃত্তি পরীক্ষার
জন্য আবুলকেই মনোনীত করেন। এবং তাঁরা প্রায় নিশ্চিত হন সে বছর আবুল তাঁদের
প্রত্যাশা পূরণ করবে। বিশেষত ‘ছবুর
' স্যার।
আবুলদের একই গ্রামের মানুষ। শিক্ষক হিসেবে গোটা মহকুমায় তাঁর নামডাক ছিলো।
মানুষের হাতের লেখা এতো সুন্দর হতে পারে তা ছবুর স্যারের হস্তলিপি না দেখলে কল্পনা
করাও দুরূহ। শেষ পর্যন্ত কিন্তু এই স্কুল থেকে আবুলের পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায়
বসার সুযোগ হলো না। এই নিয়ে ছবুর স্যারের ক্ষোভের কোনো অন্ত ছিলো না। আবুলকে
উদ্দেশ্য করে শ্রেণিকক্ষে তিনি অনেক কটুকাটব্য করেছেন
, যা আবুল
তার সহপাঠীদের নিকট থেকে শুনেছিলো। আর তার শিশুমনে এর একটা বিরূপ প্রভাবও
পড়েছিলো। এখনো যা আবুল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাঝে-মধ্যে স্যারের সাথে দেখা হলে এ
বয়সেও আবুল কেমন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে



আবুলের
এখন ঠিক মনে নেই
, কার পরামর্শে সে গ্রামের
ইস্কুল ছেড়ে মাইল দুয়েক দূরের হাবিলাস দ্বীপ উচ্চবিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে
ভর্তি হয়েছিলো। সে সময় গোটা বৃহত্তর চট্টগ্রামের গুটিকয়েক নামকরা স্কুলের মধ্যে
এটি ছিলো অন্যতম। তখন এর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। রাস্তাঘাট
ছিলো না বললেই চলে। আবুলদের বাড়ি থেকে সোজা উত্তরে বিশাল চোরা বিলের এক প্রান্তে
কালিচরণ দিঘির প্রশস্ত দক্ষিণ-পাড়ে ইস্কুল ঘরটি অবস্থিত। পাকা দালান
, দ্বিতল ও
একতল নিয়ে বিশাল স্কুলঘর। প্রধান শিক্ষকের আলাদা কক্ষ। তার সামনে দুষ্প্রাপ্য সব
ফুলের গাছ নিয়ে মোটামুটি মাঝারি আকারের একটি দৃষ্টিনন্দন পুষ্পকানন। প্রতি মৌসুমে
ফোটে এমন একাধিক ফুলের গাছ এখানে লাগানো ছিলো। তাই জায়গাটা ছিলো চির-বসন্তের এক
চিলতে ফুলেল বর্ণিল উঠোন।

কিন্তু একচোখো দৈত্যের মতো প্রধান শিক্ষকের পেয়ারে
পিয়ন গফুর চাচার সদা সজাগ দৃষ্টি এড়িয়ে এ পুষ্পকাননের ধারে-কাছে ঘেঁষাও
কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় আরোহণের মতো দুরূহ ছিলো। ইস্কুলের ভর্তির প্রথম দিন থেকেই
আবুলের মন-প্রাণ আত্মা এখানেই বসতি গড়ে ছিলো। ইস্কুলের বিল্ডিংয়ের এক্কেবারে
পশ্চিমে
, দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে
বাঁশের বেড়া টিনের ছাউনি
, মূল স্কুল-ঘর থেকে আলাদা
একটি জীর্ণ-শীর্ণ কক্ষেই পঞ্চম শ্রেণির শ্রেণি কার্যক্রম চলতো। পুবমুখী এ
শ্রেণিকক্ষের পশ্চিমের বেঞ্চিতে বসলেই দৃষ্টিজুড়ে থাকতো এ পুষ্পকাননটি। তাই প্রথম
থেকে শেষ দিন অবধি আবুলের আসন ছিলো কক্ষের পুবের জানলা বরাবর পশ্চিমের বেঞ্চির
দক্ষিণের কোনায়
 



পঞ্চম
শ্রেণি ছিলো এই ইস্কুলের সর্বনিম্ন শ্রেণি। ছাত্রসংখ্যা সাকুল্যে উনিশ। কথিত আছে
একদা এ ইস্কুলে সহশিক্ষার প্রচলন ছিলো। কিন্তু একজন ছাত্রী ভালোবেসে বিদ্যালয়ের
একজন সুদর্শন শিক্ষকের গলায় মালা পরিয়ে তার সন্তানের জননী হওয়ার গর্হিত অপরাধে
গোটা উত্তর প্রজন্মকে তাদের একটি অনিবার্য মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
আবুলের অনেক সহপাঠীকে এর জন্যে আফসোস করতে শুনেছে আবুল। কিন্তু সে ভাবতো অন্য রকম।
এমনিতেই সে কৈশোর থেকে উল্টো স্রোতের পথিক ছিলো



গাছের
ফুলকে হাত নয়
, গাছেই তার পছন্দের ছিলো
বেশি। পাখি আর পাখির গান
, নদী আর নদীর স্রোত, গাছ আর
গাছের পাতা
, ফুল আর ফুলের গন্ধ তাকে
ব্যাকুল করতো। যেখানে পাহাড়ের পায়ে নদীর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে
, সেখানেই
আবুলের স্বপ্ন মেলে পাখা। ফুল ভালো
; রঙ ভালো, সুবাস
ভালো কিন্তু ভোমরা
? সে যতই কৃষ্ণ-কালো হোক, তাকে
লুটেরা বৈ অন্য কিছু ভাবতে পারে না সে। পঞ্চম শ্রেণির উনিশ জন ছাত্রের মধ্যে মোটে
দুজনই ছিলো মুসলমান। একজন আবুল
, অন্যজন পিয়াস। পেশকার
বাড়ির ছেলে। যেমন দুরন্ত তেমনি শক্তিশালী। ফুটবল খেলোয়াড়। ঐ বয়সেই বেশ নামডাক
ছিলো তার। আবুলের বন্ধু। আবুলের টানেই সে গ্রামের ইস্কুল ছাড়ে। বড় ইস্কুল।
নামকরা সব শিক্ষক পড়ান- এ লোভেই গ্রাম ছেড়ে এসে দূরের ইস্কুলে নাম লিখিয়ে ছিলো
আবুল। যার জন্যে সবুর স্যারের অনেক বক্র উক্তি তাকে শুনতে হয়েছিলো। কিন্তু দু দিন
না যেতেই বুঝলো যে
, বড্ড ভুল করেছে।

এই স্কুল
ভালো
, দক্ষ এর শিক্ষকমণ্ডলী, পরিবেশ
চমৎকার
, অবকাঠামো মনে আনে আকাশের
উদারতা। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিটা বড় অবহেলিত। আবুলেরাই ছিল এ শ্রেণির সর্বশেষ
ব্যাচ। তার উপর এ সময়েই তার খতনা করানো হয়। তখন আবুলের বয়স ছিলো নয়
, বেজোড়
বছর। খতনার আদর্শ সময়। জোড় বছরে নাকি এ কম্মোটি করা চলে না। একজন হাজামকে দিয়ে
আসুরিক পদ্ধতিতে আবুলের খতনা করানো হয়
, ঠিক
অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার পরপর। আবুলের খতনা স্থানে ঘা হয়ে গিয়েছিলো। তখন আবুল
বুঝতো না
, এখন বোঝে তা ছিলো ইনফেকশন, ফলে দীর্ঘ
দু দুটি মাস তার ইস্কুলে যাওয়া হয় না। দু মাস পর যখন সে লুঙ্গি পরে স্কুলে। গেলো
, তখন
ক্লাসের সবচেয়ে জ্যাঠা ছেলে মিন্টু দত্ত
, খতনা কী
তা দেখার জন্যে আবুলের লুঙ্গি ধরে ভীষণ জোরে টান মারে
; এতে
আবুলের লুঙ্গি তো খোলে
, উপরন্তু খতনা স্থান ছিঁড়ে
গোটা নিম্নাঙ্গ রক্তাক্ত হয়ে যায।

মিন্টুর কী শাস্তি হয়েছিলো আবুল তা জানে না, কেননা আরো
মাসখানেক তার ইস্কুলে আসা হলো না। এমনি ভাবে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ায়
, প্রত্যাশার
সোনার হরিণছোঁয়া আবুলের আর হলো না। ব্যর্থ আবুলের ব্যর্থ জীবনের এমনি ভাবেই সূচনা
। সে সময় হাবিলাস দ্বীপ উচ্চবিদ্যালয়ের সুনামের উৎস ছিলো ডজন দেড়েক
আত্মোৎসর্গিত
, সুশিক্ষিত, নিষ্ঠাবান
দায়িত্বশীল শিক্ষক। ইস্কুলের উত্তর পাশ ঘেঁষে দিগন্ত বিস্তৃত
, স্ফটিক
স্বচ্ছ জলের 
আধার-কালীচরণ
দিঘির চার পারের আকাশ স্পর্শ অগুনতি কাউগাছের উচ্চতাকে অতিক্রম করেছিলো
, এসব
শিক্ষকের জ্ঞানের ব্যাপ্তি আর মহত্ত্বের বিস্তৃতি। তখনকার আবুল এতোটা বুঝতো না
, কেবল
শুনতো ঝাউয়ের চিরল পল্লবের শ্রুতি আকর্ষক মন-মাতানো ধ্বনি। এখনো অলস নীরব মুহূর্ত
আবুল শোনে শোঁ শোঁ শোঁ।

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রদের পক্ষে প্রধান শিক্ষকের দর্শন
স্বর্গ-দর্শনের সমতুল্য ছিলো। পুরো নাম আবুল এখনো জানে না। তিনি হরিবাবু নামেই
খ্যাত ছিলেন। তাঁর পদবিও আবুল জানে না। এমন চিকন পাতলা মানুষ তিন কুড়ি বছরের
আবুলও দেখেনি। কিন্তু ইস্কুলের সকলের নিকট তিনি ছিলেন স্বয়ং বিষ্ণু। একদিন কথা
নেই বার্তা নেই এ বিষ্ণু মহাশয় সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে
এসে হাজির। আবুলের যতদূর জানা ছিলো
, প্রধান
শিক্ষক কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকত্তোর
, ইংরেজিতে।
পিয়াস
, আবুলের পাশেই ছিলো। সে
বরাবরই এখানে বসতো। ক্লাসটা ছিলো সারদা বাবুর। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র। আবুলের ধারণা
, এন্ট্রান্স
পাস এ শিক্ষক বিশ্বের এক অনাবিষ্কৃত বিস্ময়। শিক্ষক শব্দের আদ্যোপান্ত এক জীবন্ত
আদর্শ। উনার অনুপস্থিতিতেই বিষ্ণুর আগমন। তিনি এলেন কিন্তু আসনে বসলেন না
, কেবল
হাতের ইশারায় আবুলকে তাঁর কাছে ডাকলেন এবং নারকেলের শলার মতো হাতের পাঁচ আঙুলে
ভীষণ জোরে আবুলের তুলতুলে বাম গণ্ডে চড় কষলেন। না কোনো প্রশ্ন
, না কোনো
অজুহাত।

তারপর গটগট করে হাড়ের কাঠামোটা নিয়ে অগস্ত্যযাত্রা। কারণ পঞ্চম শ্রেণিতে
তাঁর আর শুভপদার্পণ ঘটেনি। এ ঘটনায় গোটা শ্রেণিকক্ষ কতক্ষণ নির্বাক ছিলো সে নিকাশ
এখনো গণিত বিশারদ আবুলের মেলেনি। তবে ঐ দিন স্কুল ছুটির পর বিষ্ণুর বাহন গফুর চাচা
আবুলকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল হরিরূপ শমনালয়ে। তিনি আবুলকে কাছে ডাকলেন
, আঙুলের
দাগ বসা বামগণ্ডে ভীষণ মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন: “মনে রেখো অসৎ সঙ্গ
সর্বদা পরিত্যাজ্য। পিয়াস তোমার পাশে বসার যোগ্য নয় কথাটা গোটা জীবনের জন্যে।
যাও।” এ কথা এখনো আবুল তার বুকের বাম পাশে অত্যন্ত সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছে। তবে
সেদিন ব্যর্থ আবুল আকাশের সূর্যটাকে তার ছোট হাতের মুঠোয় পেয়েছিলো



 



বাড়ি
থেকে ইস্কুল হাঁটা পথের রাস্তা। নয়াহাট পেরিয়ে কিছুটা স্থানজুড়ে পুকুর গাছপালা
বাড়িঘর নিয়ে একটি ছোট্ট লোকালয়। নাম দক্ষিণ হুলাইন
। তারপর
গোটা প্রান্ত ধানি জমি। কখনো কচি সবুজ ধান গাছ আবুলের শিশু মনকে হাতছানি দিয়ে
ডাকতো। বলতো "এসো বাতাসের সাথে দোল খাই
, আকাশের
সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে চাঁদের বুড়িকে ছুঁয়ে আসি
, দেখে আসি
আকাশের ওপারের আরেক আকাশ।” কখনো সোনারঙ ধানে পুরো ক্ষেতজুড়ে কৃষাণের হাসি
, আবুলের
অধর ওষ্ঠকে করতো স্ফীত আর কেমন এক অজানা ভরসা তার অবুঝ মনেও বিশ্বাস জোগাত
অফুরন্ত। যখন ক্ষেতে ধান
, তখন অনেক ঘুর পথে যে পথ মাঝে
মাঝে সাপের মতো মোচড় খেয়ে খেয়ে এঁকেবেঁকে কোথাও বিলের মাঝের নিঃসঙ্গ পুকুরের
পাড় ঘেঁষে
, কোথাও বয়স্ক কোনো আমগাছের
একটুখানি ছুঁয়ে দিয়ে
, কোথাও ভুতুড়ে কোনো প্রকাণ্ড
বাঁশঝাড়ের মধ্যিখান দিয়ে
, শের আলী পেশকারের বাড়ির
সামনের বাংলোকে একবার উকি দিয়ে দেখে অগুনতি আগাছায় ভর-দুপুরেও গা-ছমছম ভয়ের
দরগাহ বাড়ি পেরিয়েই স্কুলের বড় রাস্তা
; পাশেই
সওদাগর দিঘি।

তারপর নাক বরাবর পুবদিকে মিনিট পনেরো হাঁটলেই আবুলদের স্কুল। এ পথে
ছ-ছটি বছর আবুল স্কুলে গিয়েছে
, আর বাড়িতে ফিরেছে। দেখেছে
ঋতুবদলের বদলে যাওয়া রূপ। কখনও রাস্তা কাদা আর পানিতে একাকার
, দু ধারে
কেয়া আর কদমের রঙ আর গন্ধে প্রাণের আবাহন। কখনও শের আলী পেশকারের শখের শেরের
নিঃশব্দ তাড়া
, প্রাণ বাঁচাতে বইপত্রশুদ্ধ
বিলের গলাপানিতে ঝম্প। তারপরও নিস্তার নেই
, সামনের দু
পায়ে ভর দিয়ে বসে এক হাত লম্বা জিভ বের করে দিয়ে লালা ঝরানোর বীভৎস দৃশ্য
অবলোকন ততক্ষণ
, যতক্ষণ না, পেশকার
বাড়ির কেউ এসো বাবা বলে আদুরে গলায় ডেকে নিয়ে যায়। একটা ‘ঘেউ
' শব্দে
বোকা আবুল বুঝতে পারে রাস্তা শঙ্কামুক্ত। এবার পানিতে জবজব কাপড়-চোপড়
, বইপত্র
নিয়ে জবুথবু আবুলের বাড়ি ফেরা। আর এ ফেরা যদি চলতি পথের উলটো দিকে হতো তাহলে
আবুলের কচি প্রাণে বড্ড বাজতো। বড় বড় বোকা বোকা দুটো চোখের ঘন-কালো ভ্রূতে
অজান্তেই জমতো না ঝরা দু ফোঁটা শরতের শিশির। অবশ্য ক্রমে বদলে যায় দৃশ্যপট। কালে
আবুলের জীবনে এ ঘটনা বালার্কের রক্তিম হাসি নিয়ে আসতো। তখন স্কুলে পরীক্ষা ছিলো
দুটো। ষান্মাষিক ও বার্ষিক। পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার রেজাল্টে আবুলের নাম যেন কী
করে সবার উপরে উঠে এলো। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ইকবাল স্যারের গণিত বিষয়ে
আবুলের অভূতপূর্ব সাফল্য। গোটা স্কুলে



'ইকবাল' স্যার
অনুপম সুদর্শন একজন মানুষ:
'সত্যের জয়' নামে
খ্যাত। উত্তরপত্রে কম নম্বর দেওয়ার খ্যাতিতেও যিনি ছিলেন অদ্বিতীয়
; তাঁর
বিষয়ে আবুলের শতভাগ নম্বর প্রাপ্তি
, সেবার
স্কুলে তুলকালাম কাণ্ড সৃষ্টি করেছিলো। তাঁর ধর্মপ্রীতি এ কারণে অনেক ঈর্ষাকাতর
শিক্ষিত মূর্খদের মধ্যে জন্ম দিয়েছিলো এক লজ্জাজনক হীনম্মন্যতার। তবে এক্ষেত্রে
বোকা আবুল তাঁর স্বর্গীয় স্যারের মাথা হেঁট হতে দেয়নি। যতদিন সে এ স্কুলে ছিলো
, আর
পরীক্ষায় বসেছিলো
, ততদিন কাউকে গণিতে সর্বোচ্চ
নম্বরটির ধারেকাছেও যেতে দেয়নি। আবুলের ব্যর্থ জীবনের এই একটি গোপন তৃপ্তি। অনুপ
রায় নামে পঞ্চম শ্রেণিতে আবুলের এক সহপাঠী ছিলো। ছিলো নয়
, বলা চলা
এলো। এলো অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার পর। এক ধনীর নন্দন। ধনে বড় হলেও মনে ছিলো
যারপরনাই সঙ্কীর্ণ। এলো আবুলের জীবনের শনি হয়ে। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের বংশধর
এবং প্রভাবশালী একজন শিক্ষকের ভাগনে। কোলকাতায় ছিলো।

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে
পূর্ব-পাকিস্তানের এক অজপাড়া গাঁয়ে তার নির্বাসন। সব গেছে কিন্তু গুমর যায়নি।
উজ্জ্বল শ্যামল গায়ের রঙ। কণ্ঠস্বর মসৃণ। চোখ দুটো বড় বড় কিন্তু লম্বায় বামন
বলা চলে। কথা বলে কম। তাও যেন কথা নয়
, খেজুর
কাঁটার খোঁচা। তারপরও তার বন্ধুত্বের জন্যে গোটা ক্লাস হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
শ্রেণিকক্ষে প্রথমে দিন পা রেখেই আবুল এবং পিয়াসকে কেন জানি ঠেলে দিলো বিরোধী
দলে। তখন কিচ্ছুটি বুঝতে না পারলেও ক্রমে বুঝেছিলো বোকা আবুল
, শ্রেণিতে
সংখ্যালঘু হওয়াই ছিলো তাদের একমাত্র অপরাধ। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি প্রদান করা
হতো।

বিভাগীয় কোটায় কিংবা জেলা কোটায় এখন আবুলের ঠিকঠাক মনে নেই। এক-আধটা স্কুল
থেকে এক-আধজন বৃত্তি পরীক্ষায় বসার অনুমতি পেলেও অধিকাংশ স্কুল থেকে একজনও এ
পরীক্ষার জন্যে মনোনীত হতো না। যান্নাসিক পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভর করে মনোনয়নের
বৈতরণী পার হওয়ার ক্ষীণ আশা ছিলো আবুলের। কিন্তু অনুপ রায় নাকি আগে-ভাগে মনোনীত
হয়েই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। হিটলার প্রধান শিক্ষক আবুলের টানা তিন মাসের
অনুপস্থিতিকে আমলে নিয়ে তার ষান্মসিক পরীক্ষার ফলাফলকে বিবেচনায় নিতে চাইলেন না।
বৃত্তি পরীক্ষায় ভালো স্কুল থেকে বসার জন্যে আবুলের গ্রামের স্কুলত্যাগ। অনুপ না
এলে হয়তো মন্দের ভালো হিসেবে আবুল এ পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত 
হতো। জন্মসংস্কার কোলকাতার প্রতি টানঅমন কড়ানীতির মানুষ হরি বাবুকেও টলিয়ে দিলো। কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তে আবুল অনেক কেঁদেছিলোযার সাক্ষী কালিচরণ দিঘিদিঘির গগনস্পর্শী ঝাউবৃক্ষ আর মাথার উপরের অক্ষয় আকাশ। 

বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপকে অনেক নম্বরের পিছনে ফেলে কেবল প্রথম স্থান ধরে রেখে আবুল তার শোধ তুলেছিলো। ঐ বছর বৃত্তি পরীক্ষায় অনুপ প্রশ্নপত্র অত্যন্ত জটিল হয়েছে এ অজুহাতে গণিত পরীক্ষার দিন অর্থ সময়ে পরীক্ষার হল ত্যাগ করে নির্বাচকমণ্ডলীর মুখ উজ্জ্বল করেছিলো। এরপর থেকে কেন জানি 'সত্যের জয়ইকবাল স্যারের অপত্য স্নেহ অঝোরে ঝরতে শুরু করলো আবুলের মাথায়। এ স্নেহ বর্ষিত হয়েছিলো স্কুলের শেষ ধাপ অবধি। ব্যর্থ আবুল ইকবাল স্যারের দানের মর্যাদা শেষ পর্যন্ত দিতে পারেনি। ইকবাল স্যার ছিলেন মূলত 'ক্রীড়া শিক্ষক'। আবুলদের সময় ফুটবল ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রতি বছর জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হতো আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার নাম ছিলো 'জুনের খেলা'। থানাজেলাবিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে এ প্রতিযোগিতা চলতো। অনেক স্কুল প্রতিযোগিতায় জেতার জন্যে পেশাদার খেলোয়াড়কে স্কুলের ছাত্র হিসেবে দেখিয়ে প্রতিযোগিতা জিতে যেতো

আবুলদের স্কুলের ফান্ড দস্তুরমতো ঈর্ষণীয় ছিলো। জুনের খেলার জন্যে ব্যয়ের মানসিকতা ও পরিচালনা পরিষদের ছিলো ষোলআনা। কেবল প্রয়োজন ক্রীড়া শিক্ষকের সম্মতি। কিন্তু তিনি থাকতেন স্বীয় সিদ্ধান্তে হিমাচলের মতো অটল। মিথ্যাচারকে তিনি ভীষণ ঘৃণা করতেন। বলতেন : 'দেখিস আমাদেরই জয় হবে। সত্যের জয় কেউই রুখতে পারবে না।” তাই সকলেই আড়ালে-আবডালে তাঁকে ডাকতেন ‘সত্যের জয়স্যার। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছেআবুলদের সময়ে বড় সব ম্যাচে দেশের নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলে ইকবাল স্যারের পিচ্চি ফুটবলারেরা অনেকবার শেষ হাসি হেসেছে। এবং বিপক্ষের সমর্থকদের ইট-পাটকেলের তোয়াক্কা না করেএক কোমর কাদা ভেঙেআকাশ ছেঁড়া বৃষ্টি মাথায় শিশু নিয়ে মিছিল করে স্কুলে ফিরেছে। তবে মাঝে-মধ্যে এর ব্যত্যয় হলেই বিশ্রী সব মন্তব্য শুনতে হতো স্যারকে। কষ্টে আর লজ্জায় আবুলের চোখে অশ্রু ঝরতো। কিন্তু ইকবাল স্যারের মুখে তখনও আবুল দেখেছে বিশ্বাসের অটল পাহাড়। আবুল বুঝতে পারতো সব কথা স্যারের শ্রুতিকে আঘাত করছে

নিবন্ধরতবে স্বর্গীয় তৃপ্তিভরা সুন্দর হাসিকে এতটুকুন মলিনতা স্পর্শও করতে পারতো না। তিন কুড়ি বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ব্যর্থ আবুল ভাবেএখনও কৃষ্ণচূড়ার রঙ লালএখনও কোকিলের কন্ঠে স্বর আর সুর আছেনদীতে জোয়ার-ভাটা হয়গাছের পাতা সবুজপরিচর্যা পেলে মাটিও উপরে দেয় শস্য। তবে কেন বদলে গেল মানুষ (?) সত্যের জয়" স্যারের বস্ত প্রয়োজন আজ এই নষ্ট পৃথিবীর কোনো ভাষার প্রতিই আবুল বীতশ্রদ্ধ নয়। তবে তার কাছে 'বাংলানিছক ভাষা নয়তার আত্মাতার না পাওয়া অফুরন্ত ভালোবাসাআকাশের সবটুকু নীলবিশ্বনিখিলের সমুদয় সবুজশরৎ পূর্ণিমার দুধসাদা জোছনাসাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে সৃষ্ট শুভ্র ফেনার অনুপম কাশফুল। তার কেন যেন মনে হতো সারদা বাবুর সাথে 'স্যারশব্দটা যায় না। কেমন ছাড়া ছাড়া। চালচলনেকথাবার্তায়সোহাগে শাসনে তাঁর উপমা তিনিই স্বয়ং। যেন কোনো তপোবনের স্বয়ংসিদ্ধ শুরু। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েই আবুল সারদা বাবুর বাড়িতে গিয়ে ইংরেজি পড়তো। তাঁর বাড়িটা আবুলের মনে হতো তপোবন। স্কুলের পুব-পাশে কয়েক বন্দ ধানি জমির পরই সারদা বাবুর বাড়ি। বাড়ির চারপাশে রকমারি বৃক্ষের মেলা। উঠোন থেকে অন্তত ফুট চারেক উঁচু মাটির বাঁধানো দাওয়া কম করে হলেও পনের হাত দৈর্ঘ্যদশ হাত প্রস্থ। তার সাথে লাগানো বাঁশের বেড়া টিনের ছাউনির তিন কামরাবিশিষ্ট একটি ছিমছাম বাড়ি। বাড়িজুড়ে কেমন এক স্বর্গীয় শুভ্রতা ছড়ানো

মাটির বাঁধানো তিন তিনটা সোপান পেরিয়ে দাওয়ায় পা রাখলেই আবুলের ভেতরটা যেন কেমন কেমন করতো। সে যতক্ষণ ঐ দাওয়ায় মাদুরে বসে পাঠাভ্যাস করতো ততক্ষণ তার চারপাশে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসতো জুই ফুলের মৌ মৌ গন্ধ। সারদা বাবুরা খুব উঁচু স্তরের ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামির এতটুকুন কলুষ তাকে কোনো দুর্বল মুহূর্তেও স্পর্শ করতে পারেনি। আবুল অনেক বার দেখেছে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তিনিফলে পেছনে আবুলকেও দাঁড়াতে হয়েছে। এ ঘটনা ঘটতো যখন দূর কোনো মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। আজান শেষচলা শুরু। এসব হতো বাংলার পালটে যাওয়া ঋতুর মতো নিঃশব্দে। পরিজ্ঞাতা সারদা বানুর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ছিলো। গাছপালা আর জীবজন্তুর প্রতি তাঁর ছিলো প্রাণের টান। যে দাওয়ায় বসে

আবুলেরা পড়তো তার এক পাশ ঘেঁষে প্রায় গণ্ডাতিনেক জায়গা জুড়ো ছিলো তাঁর শখের বাগান। ফুলের সাথে ছিলো নানা রকম ফলের গাছ আর লম্বা ঘাস। এ ঘাসের মধ্যে ছিলো ডজনখানেক নানা বয়সের খরগোশের বসবাস। সারদা বাবুর পোষা খরগোশ। ছোটো ছোটো তুলতুলে দু পায়ে ভর দিয়ে মিটিমিটি চোখে চেয়ে চেয়ে আবুলদের দেখতো এরাআবার পলকে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যেতো। এগুলো দেখার লোভেই একদিনের জন্যেও সারদা বাবুর বাড়িতে যাওয়া কামাই করেনি আবুল। মাকে অনেক বলে কয়ে আবুলও দুটি সাদা রঙের ইঁদুর কিনেছিলো। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যে আবুলকে এদের মায়া কাটাতে হয়। ঘরে তো আর গর্তের অভাব ছিলো নাতার কোনটাতে তারা প্রেমের নীড় গড়েছে তার হদিস আবুল অদ্যাবধি পায়নি

আবুলদের পাশের চৌধুরীবাড়ির একজন আবুলদের একই স্কুলের উপরের ক্লাসে পড়তো। নাম আরিফ। সচ্ছল কৃষক পরিবারের ছেলে। বেশ নম্র ও বিনয়ী । পড়লোখায় আহামরি ধরনের ভালো না হলেওদস্তুরমতো পরিশ্রমী। সবচেয়ে ঈর্ষার ব্যাপার ছিলো ঐ বয়সেও সে একটা গোটা ঘরের মালিক ছিলো। আর তার আয়ত্তে ছিলো এক মহামূল্যবান সম্পদ যা সে সময়ে কল্পনা করাও কষ্টকর ছিলো। সে ছিলো আস্ত এক রেডিও এবং একটি এয়ার গানের অধিকারী। শুক্রবার জুমার নামাজের পর অনুরোধের আসরের সে ছিলো নিয়মিত শ্রোতা। আর নজরুলের অগণিত রোমান্টিক গান আবুল আরিফের রেডিওতেই প্রথম শুনেছে। এ গানের টানে প্রতি শুক্রবার আরিফদের বাড়িতে আবুলের উপস্থিতি ছিলো অনিবার্য। অবশ্য আবুল মাকে মিথ্যে করে বলতো সে পড়া দেখে নেওয়ার জন্যেই আরিফদের বাড়িতে যায়। আরিফের পড়ালেখা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই এই বাইরের ঘরে হতো। হতো দরোজা বন্ধ করে। পাখি শিকারেও এখানেই আবুলের হাতেখড়ি। আবুলের হাতের টিপ আরিফের চেয়ে ভালো ছিলো। ফুল-পাখি-পাতার প্রতি আবুলের যে একটা দরদি মন ছিলোআরিফের সংস্পর্শে এসে তা ধীরে ধীরে মরে যেতে বসলো। 'মাআবুলকে পাখি শিকারে যেতে প্রতিবারই না করতেন। বলতেন: “শিকারিদের ফরজন্দ হয় না। বংশের প্রদীপ দেয়ার মতো কেউ থাকে না।” তিন কুড়ি বছরের আবুল তার মায়ের সে কথা এখনো ভোলেনি। নিজের তিন তিনটি মেয়ের মুখে তিন তিনজন 'মা'কে সে দেখতে পায়। আর ভাবে মেয়েরা কী বংশের প্রদীপ

হতে পারে না। তখনও আবুলের রবি ঠাকুরের সাথে তেমন করে পরিচয় ঘটেনি। রোমানা আফাজবিদ্যুৎ মিত্রশরৎচন্দ্র এঁদের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই আরিফের দরোজা বদ্ধ ঘরের ফাঁদে ধরা দিয়েছিলো সদ্য পাখা গজানো পতঙ্গের মতো। সে আগুনেই আবুলের জীবনে প্রথম দহন। তখনও তো আবুল জানতো না, 'যা গুপ্ত তা দুষ্ট হতে বাধ্য। এ বন্ধ ঘরের আবছায়ায় আবুলের সামনে আরিফ আরেকটি বদ্ধ ঘরের দরোজা খুলে দেয়। জীবনের এ অনিবার্য দিকটি এতোদিন আবুলের নিকট অজানা ছিলো। কিশোর আবুল যেন একদিনেই যুবা পুরুষে পরিণত হলো। এটা কী ভালো হলো না মন্দ হলো অদ্যাবধি আবুল সন্ধান করতে পারেনি। আরিফের নাসারন্ধ্রে সর্দির ছিলো নিত্য বাস। কথা বলার সময় মাঝেমধ্যে তা তার স্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে বাইরের জগতে উঁকি দিতো। নাকের ছিদ্রপথে মুখের দরোজা পর্যন্ত নেমে আসা সে সাদা লাভাস্রোত অপূর্ব কৌশলে আরিফ তা স্বস্থানে টেনে নিতো। এটা ছিলো আবুলের কাছে সাংঘাতিক বীভৎস দৃশ্য। বিবমিষা ঠেকানোর জন্যে আবুল স্বীয় নয়নযুগল বন্ধ করে ফেলতো। কিন্তু ভীতু আবুলমুখচোরা আবুল কিছুতেই তার সিনিয়র বন্ধুকে বলতে পারতো না: “ ঐ বস্তু একান্তই বর্জ্যওটি ত্যাগই মঙ্গল মঙ্গল স্বাস্থ্যের জন্যমঙ্গল আবুলের আরেকটু তার বন্ধুর সাহচর্য সুখ ভোগের জন্য। "

 

আরিফের আর্থিক সচ্ছলতা তার অনেক গরিব বন্ধুর উপকারে এসেছে। তবে এ ধরনের কোনো সাহায্য স্কুলজীবন পর্যন্ত আবুলকে কারো কাছ থেকে নিতে হয়নি। সুন্দর এবং অসুন্দরসুর এবং অসুরহ্রী এবং বিশ্রীর এমন সহবাস আরিফ বৈ আর কারো মাঝে আবুল দেখেনি। কলেজের তৃতীয় বর্ষে পা দিয়েই আরিফ ও পাট চুকিয়ে দেয় চিরতরে। তারপরে লক্ষ্মীর পেছনে ধাওয়া। ঔষধের দোকান-টোকান দিয়েছিলো চট্টগ্রাম শহরের রাজাখালিতে। বিয়ে থা করেনি। এখন নাকি বাড়ির মসজিদের নিয়মিত খাদেম। নামাজ পড়ে আর মুসল্লিদের দেয়া দান-খয়রাতের টাকার হিসেব-নিকেশ সংরক্ষণ করে। ইকবাল স্যারের হাজারো প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়ে আবুল ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকেস্কুল কামাই অভ্যাসে পরিণত হয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এ পতন ঠেকানো গেল না। তবে বছরের একটি দিন আবুলের সরব উপস্থিতি বিদ্যালয়ের অন্য ছাত্রদের মধ্যেও সংক্রমিত হতো। সেদিন সিনিয়র-জুনিয়রছাত্র-শিক্ষক কোনো ভেদাভেদ থাকতো না। আর এ দিনের সূচনা হতো আগের রাতের বারোটা এক মিনিটে। শুরু হতো।

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি”- এ অমর সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। এ দিনটি আবুলকে পাগল করে দিতোঅন্যদেরও সে পাগল করে তুলতো। কী এক স্বর্গীয় আবহ গোটা দেশটাকে ঘিরে থাকতো। নগ্ন পাহাতে অশ্রু আর শোণিত লেখা পোস্টারমুখে কান্নাভেজা আগুনপরনে শ্বেতবাস: শিশু-কিশোরপ্রৌঢ়বৃদ্ধনারী-পুরুষধনী-দরিদ্র হাঁটছেহাটছে মন্থরমৌন মুখতারপরও নিঃশব্দের কোলাহলমন্থরের জঙ্গমতা আবুলকে কেমন ব্যাকুল করে তুলতো। অত্যন্ত দীন-হীন এক স্মৃতিসৌধে গিয়ে শ্রদ্ধায় আনত হতো গোটা মিছিল। শিমুলকৃষ্ণচূড়া এবং আরো আরো পুষ্পহারে ঢাকা পড়ে যেতো সকল দীনতা। আবুল সকলের অলক্ষ্যে স্বীয় হৃদয়টি নিবেদন করে আসতো একটি মাত্র লাল গোলাপ অর্ঘ্য দেয়ার ছলে। এখন আবুলের কোথাও যাওয়া হয় না। আনুষ্ঠানিকতাকে তার বড্ড ঘৃণা। আবুলের স্কুলজীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর একটি মুহূর্ত বই পোড়ানো। গোটা স্কুলটাই সেদিন ভেঙে পড়েছিলো কালিচরণ দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণে বকুল তলায়। নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রদের হাতে একটি করে চমৎকার মলাটের বইনতুন বইনাম ‘পাকিস্তানি দেশকৃষ্টি'। কেমন করে যেন আবুলও একটি জোগাড় করে নিয়েছিলো। সেদিন সারা পূর্ব-পাকিস্তানে ছিল ছাত্র-ধর্মঘট।

এ দেশের ছাত্রদের উপর ভিন্ন সংস্কৃতির বোঝা চাপানোর হীন কৌশলকে গোটা দেশের ছাত্রসমাজ একজোটে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছিলো। বইটি ছাপাতে গিয়ে পাকিস্তান সরকার কার্পণ্য করেনি। অনেকগুলো চার রঙের ছবিশক্ত মলাটচমৎকার বাঁধায়ভালো কাগজ নিয়ে ছাত্রদের আকৃষ্ট করার অপচেষ্টার কোনো ঘাটতি ছিলো না। তাই বইটা ছিঁড়তে গিয়ে কোমলমতি শিশু-কিশোর ছাত্ররা দস্তুরমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। যতগুলো বই আবুলদের সংগ্রহে ছিলো সব একে একে ছিঁড়ে স্তূপ দেয়া হলো। স্তূপটাকে মোটামুটি একটি ছোটো-খাটো খড়ের গাদার মতো দেখাচ্ছিল। প্রথমে কয়েক বোতল কেরোসিন তার উপর ঢেলে দিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। সৃষ্টি হলো এক অভিনব অগ্নিকৃত। চারপাশে আদিম উল্লাসে দু হাতে তালি বাজাতে বাজাতে তালে তালে নৃত্য শুরু করলো আবুলদের দল। আবুলতিন কুড়ি বছরের ব্যর্থ আবুল এখনো ভাবে সে কী জাতিপ্রেম। সে কী জোশ

সেদিন কিন্তু কিশোর ছাত্রদের মধ্যে কোনো বিভাজন দেখেনি। ভিন্ন বিশ্বাসের ছাত্ররাও মৌমাছির এক অভিন্ন মৌচাকে সেদিন চাক বেঁধেছিলো। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত। ইকবাল স্যারের বাহন প্রায় বুড়িয়ে যাওয়া একটি দ্বিচক্রযান। এই যান ছাড়া ইকবাল স্যারের দর্শন কেউ কোনো দিন পেয়েছে তা তাঁর কোনো ছাত্রের পক্ষেও বলা অসম্ভব। ঝড়-বৃষ্টি-বাদল কোনো পরিস্থিতিতেই যানটি স্যারের হাত বদল হতো না। একদিন বলা নেইকয়া নেই ইকবাল স্যারের বিচক্রযানটি হাজির আবুলদের বাড়িতে। আবুল তখন বাড়ির পেছনে বিশাল আমগাছের মগডালে। 'স্যারবাড়ির ঘাটা থেকেই আবুলদের ঘরে সংবাদ পাঠালেনদীর্ঘদিন আবুল স্কুলে অনুপস্থিত। তাই তিনি খবর নিতে এসেছেন। আবুলদের বাড়ির অনেকেই ইকবাল স্যারকে চিনতেন এবং সমীহ করতেন। তারা স্যারের মুখে আবুলের বৃত্তান্ত শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন। আবুলের বাবা শহর থেকে এলে তাঁকে সব জানানো হবে এ আশ্বাস পেয়ে স্যার তাঁর বাহনে চড়ে উল্টো দিকে যাত্রা করলেন। স্যারের এ আগমনের জের পোহাতে হয়েছিলো আবুলের মাকে।

তাঁর গায়ে হাত ওঠেনি ঠিকই কিন্তু কথার চাবুকের আঘাতে যে স্থানটি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলো তার নাম আশাতার নাম ভরসা। আবুলকে মা কেবল বলেছিলো: “কী রেমাকে খুব ভালোবাসিস নাএ তোর ভালোবাসার নমুনাকীসের ভরসায় আর আমার বেঁচে থাকা।” মায়ের কথাগুলো আবুলকে কতটুকু স্পর্শ করেছিলোএখনো ভেবে উঠতে পারে না। তবে তার মনে হয়েছিলোছেলে-মেয়ের অপরাধের শাস্তি মাকে পেতে হয় কেনএক্ষেত্রে শাস্তি দেয়া ছাড়া বাবার কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই। আবুলের অনেক ব্যর্থতার মধ্যে একটি ব্যর্থতা হচ্ছেকখনো কোনো অজুহাতেই তার কোনো নিকটজন তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাননি। এমন কী পরীক্ষাকেন্দ্রেও না। অথচ আবুলদের সময় পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের আত্মীয়-স্বজনেরা দস্তুরমতো মেলা বসিয়ে ফেলতো । স্কুলে যাক আর না যাক পরীক্ষায় আবুল বরাবরই ভালো করতো। স্কুলজীবনে তৃতীয় স্থানের নিচে তার নাম কোনো পরীক্ষায় আসেনি

দেখতে দেখতে আবুল অষ্টম শ্রেণিতে উঠল। বিদ্যালয়ে উপস্থিতিতে আবুল শূন্য পেলেওশেষরাতে জেগে নিয়মিত পাঠাভ্যাসে তার আলস্য ছিল না। মা বলতেন আধোয়া মুখে শেষ রাতে ওঠে যারা পড়ালেখা করেতারা তা সহজে ভোলে না। বিষয়টির কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আবুল কারো কাছে জানতে চায়নি। সরল বিশ্বাসে মায়ের এই কথাটা কেবল মেনে চলেছে। এ বিশ্বাসের ফলও পেয়েছে হাতে হাতে। আফসোস। এমনি করে মায়ের আর সব কথা যদি আবুল মেনে চলতো! শৈশবে আপুদের আবদারে আবুলের ঘন কৃষ্ণ-কুন্তল সহজে নরসুন্দরের কাঁচি স্পর্শ করতে পারতো না। কান ঢেকে ঘাড় অবধি নেমে এলে মায়ের পীড়াপীড়িতে নরসুন্দরের আবির্ভাব ঘটতো আবুলদের ঘরের ইটে বাঁধানো দাওয়ায়।

কালেচুল লম্বা-রাখা আবুলের ৰাতিকে পরিণত হয়। আবুলদের ইতিহাসের শিক্ষকছাত্র পেটানোর জন্য যার স্বঘোষিত বিদেশি ডিগ্রি ছিলোএকদিন কী করে নজর গেল আবুলের চুলে। তারপর যা হওয়ার হলো। ততক্ষণ তাঁর হাতের বেত আবুলের পিঠে সপাং সপাং সুরের ঝংকার তুললোযতক্ষণ না আবুলের চেতনা বেসুরো ধপাস শব্দে জানান দিলোতিনি আর আবুলের মধ্যে নেই। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা, 'হর-ফন মোল্লাইকবাল স্যারের বটিকা পানিতে গুলে সেবন আর ঐদিনের জন্যে ছুটি- সব মিলিয়ে আবুল চোখ খুলে তাকালো। লজ্জা এবং ক্ষোভে সে শারীরিক কষ্টের কথা ভুলে শ্রেণিকক্ষের ছাদের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলো নিষ্পলক। এমন সময় পিয়াস এসে বললো, "স্যারআবুল কি একা এতটুকু পথ যেতে পারবে?” তাকে আর বেশি কিছু বলতে হলো না। ঐ দিনের জন্যে পিয়াসও ছুটি পেয়ে গেল। চেনা পথ। পথের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে আবুলের পরিচয়।

রাস্তার কোন মোড়ে বিশাল বাঁশঝাড়যার মধ্যে অসংখ্য বকের বাসাসওদাগর দিঘির পানিতে কটা শাপলালতা পাতা মেলেছেদিঘিরপাড়ের কোন বাড়ির বউ এক হাত ঘোমটা টেনে কোন রঙের শাড়ি পরে দিঘিতে ঘট ভরতে আসেকাদের বাড়ির সামনে কটা নারকেল আর সুপুরির গাছ আছেএদের কটিতে ফুল এসেছেফল ধরেছেকখন হঠাৎ মন-কেমন করা স্বরে বৃদ্ধ আমগাছটির মগডাল থেকে ডেকে উঠবে ঘুঘুপেশকারবাড়ির কোন মেয়েটি এখন তার লম্বা কালো চুল কাঁধের দু পাশে ছেড়ে দিয়েবাধানো পাকা দাওয়ায় বসে বিদ্যুৎ মিত্র পড়ছে—সব আবুলের জানা। কিন্তু আজ আবুলের কোনো হিসাব মিলছে না। বই-খাতার ব্যাগ পিয়াসের হাতে। মাঝ সময়ে ছুটি পেয়ে সে এখন ভীষণ মজায়। আবুলের লজ্জাআবুলের ভাবনা তাকে সামান্যও স্পর্শ করছে না। আজ যেন আবুলের পা মাটির পরশ পাচ্ছে নাশরীরটা যেন কেমন পলকা পাটকাঠি। হাঁটছে না উড়ছে সে অনুভূতিও নেই। কী এক ব্যর্থতার গ্লানি লজ্জার চাদর হয়ে

আবুলকে অক্টোপাশের ফাঁসে বেঁধেছে। কখনও চাপা-আক্রোশকখনও বিষাদক্লিষ্ট মাতৃমুখ এ দুয়ের টানাপোড়েনে আবুল দিশায় পাওয়া মানুষের মতো হাঁটছিলো। পিয়াসের কথায় তার সম্বিত ফিরলো। বইয়ের ব্যাগটা আবুলের দিকে এগিয়ে সে দার্শনিকের মতো বললো: “সব কথা মা-বাবাকে বলতে নেই। বলিস আছাড় খেয়ে ব্যথা পেয়েছিস।" আবুল পিয়াসকে কিছুটি বললো না। ঈষৎ হেসে ব্যাগটি হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বাড়ির পথ ধরলো

দেখতে দেখতে অনেকগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা যেন একসাথে ঝাপিয়ে এলো। গোটা পূর্ব-পাকিস্তান এসব ঘটনায় এমনভাবে জড়িয়ে গেলছেলে মেয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলো কিনা তাকে ছাপিয়ে উঠলো জাতীয় প্রয়োজন। সত্তরের নির্বাচনপশ্চিমা বাহিনী তার ফলাফল কেবল বিস্মিত হলো না তারা ইতিহাসের এক হীনতম গোপন ষড়যন্ত্রে মাতলো। এ সময় আবুলও স্কুলে যাওয়ার ঝক্কি আর পোহালো না। ছুটলো মামাবাড়ি। আবুলের কাছে মামাবাড়ি মানেই স্বর্গ। কেবল ভয় ছোট মামার ভীষণ বড় বড় চোখ দুটোকে। একবার এ রাডারে ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। তখন একমাত্র আশ্রয় মায়ের চেয়েও বাড়া মামিমার আঁচল। এ আঁচল এমন উদারএমন বিস্তৃতএমন অসীম এখানে সকল প্রকার অশুভ শক্তি শূন্য হয়ে পড়ে। ছোট মামার দৃষ্টি কোন ছার!

 

এবার আবুল মামাবাড়ি পৌঁছলেই মামি তাকে কাছে ডেকে মাথায় আর মুখে পরম স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন। মামিমার হাতের পরশ পেলেই আবুলের দু চোখ ব্যাখ্যাতীত সুখের আমেজে মুদে আসতোআর মনের ক্যানভাসে ধরা দিতো গোটা নীলাকাশ। যার উদার নীলে কল্পনার পাখনা মেলে আবুল ভেসে বেড়াতো তার স্বপ্নের দেশে। আবুলের মামি হয়তো বুঝতেন কিশোর আবুলের মনের অবস্থা। কারণ তিনি যেমন ছিলেন বিদূষীতেমনি হৃদয়বান। হয়তো তাই তিনি সহজে অবুঝ আবুলের এ সুখস্বপ্ন ভেঙে দিতেন না।

দু হাতের মাঝখানে আবুলকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখতেন। তারপর একসময় আবুলের গাঢ় কালো লম্বা চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলতেন, “কিরে পাগলাঘুমিয়ে গেলি নাকি।” আবুলের মুখ লজ্জায় মেয়েদের মতো টকটকে লাল হয়ে যেতো। সে মুখে রা-টি না কেড়ে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে যেতো যেখানে তার জন্যে অপেক্ষমাণ নানুবাড়ির আরেক বিস্ময়। আজ মামিমা এসব কিছুই করলেন নাকেবল বললেন: “দেখতো মিজানটা কোথায়তাকে আমি ডাকছি বল মিজান আবুলের মামাতো ভাই। বড় মামার বড় ছেলে। গায়ে-গতরে দুজন সমানে সমান। তার চুলটা কদমছাঁট। চেহারায় বাড়তি জেল্লাঅনেকটা আভিজাত্যের ছাপবাকি সব যেন এক রকম। দেখলে মনে হয় সহোদর। বয়সে ছোটশ্রেণিতে আর বিচক্ষণতায় উপরে। কিন্তু সম্পর্কে ভাই নয়বন্ধু। এক্কেবারে হরিহর আত্মা। মিজানকে পাওয়া গেল বিন্ধ্যা পুকুরের উত্তর পাড়ের পশ্চিম কোনায়। সাথে আরো অনেকজন। আড্ডায় মত্ত। আবুলকে দেখেই বললো: “কী রে কখন আসলি?” জবাবে আবুল বললোঃ “মামি তোকে ডাকছেন।”

 

মিজানকে নিয়ে ফিরলেই মামি বললেন: “মিজান তোকে একবার তোর নানাবাড়িতে যেতে হবে। সাথে আবুলকে নিয়ে যা। কয়েক দিন থাকার মতো কাপড়-চোপড় সাথে নিস। যাতাড়াতাড়ি সবকিছু গুছিয়ে নে। তোর বড় নানুর জন্য কাঁকরোলের তরকারি রেঁধেছিটিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে যাস।” আবুল তার বাচ্চা বয়স থেকেই জেনে এসেছেমিজানের নানাবাড়ি তারও নানাবাড়ি। পরন্তু মিজানের নানার বিশাল ব্যক্তিত্বতাঁর রাশভারী চালচলনসিংহের আভিজাত্য আবুলকে কী এক অমোঘ আকর্ষণে মোহাবিষ্ট করে রাখতো। সকলে তাঁর সান্নিধ্য থেকে পালাই পালাই করলেও আবুলের মন তাঁর চারপাশে কেবলই ঘুরঘুর করতো। তাই সে বাড়িতে যাওয়ার মওকা পেলেই হাতে সাত আসমান পেতো। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না

 

পটিয়ার মহকুমা সদরেই মিজানদের বাড়ি। যে আরাকান সড়কটি আবুলদের গ্রামের গা-ঘেঁষে সুদূর কক্সবাজার টেকনাফ হয়ে নাফ নদী ছুঁয়েছেতা মিজানদের শহরের ঠিক মাঝ বরাবর দিয়ে তার গন্তব্য করে নিয়েছে। এ রাস্তা থেকে দক্ষিণ দিকে মিজানদের বাড়ি এক নিঃশ্বাসের পথ। আর রাস্তার উত্তর-পাশে অনেক অনেক দূরে খানমোহনা নামক এক পল্লী গাঁয়ে মিজানদের নানাবাড়ি। যাওয়ার দুটো বিকল্প পথ। এক পায়ে চলা মেঠো পথঅন্যটি রেল। ‘রেলচলে ঘড়ি ধরে দিনে দু-একবার। অগত্যা তার জন্য অপেক্ষা আহাম্মকির আরেক নাম। অতএব চলো পায়ে হেঁটে। আবুলের মনে হতো তার মামাবাড়ি থেকে খান মোহনা পর্যন্ত গোটা এলাকাটা এক নিরবচ্ছিন্ন গ্রাম। মাঝখানের আরাকান সড়কখানমোহনা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের ঠিক আগে গেঁয়ো নদীর সাঁকোটির পর কিছু জায়গা বাঁধ দিলে

অবশিষ্ট পুরোটাই ঘনবসতির একখণ্ড জনপদ। মাঝখান দিয়ে সাপের মতো মোচড় খেয়ে খেয়ে ধেয়ে চলছে প্রাচীন মেঠোপথটি। এ পথের দু ধারের অগুনতি গাছপালাঝোপঝাড়বিশেষত বড় বড় বাঁশের বিশাল বিশাল ঝড়আম-জাম-কাঁঠালের বাগাননারকেল আর সুপুরির গাছের বীথি ঠিক বিপ্রহরের সূর্যকেও মাটি ছুঁতে দেয় না। গাছের পাতার ফাঁকে-ফোকরে জায়গা করে নিয়ে দিনের আলো পরম ভালোবাসায় গেঁয়ো মেঠোপথে বিচিত্র সব আলপনা আঁকে। পুরো পথটা কেমন শীতলকেমন ছায়া-সুনিবিড়।

পথের বাঁকে বাঁকে বড়-ছোট কত শত পুকুর। বসতবাড়িকত ঘরকত জাতবর্ণধর্মের মানুষ। পুকুরে কচিকাঁচা ছেলেমেয়ের সাঁতার কাটাঘোমটা দেওয়া কুলবধূর চুপচাপ ডুব দেওয়াবয়স্ক মানুষের গোসল সেরে গামছা দিয়ে গা মোছাপুকুর পারের সাদা গাভিটার চরম আলস্যে জাবরকাটাহঠাৎ হঠাৎ গাছ-গাছালির ঘন-পল্লবের মধ্যে গা-টা লুকিয়ে চেনা-অচেনা পাখির কুজন আর আচমকা হাওয়ায় আবুলের লম্বা কালো চুলের শূন্যে পাখনা-মেলা সব মিলিয়ে কেমন এক নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো বোকা আবুল কখন খানমোহনার সীমার সাঁকোটা পেরিয়ে আসতো বুঝতেই পারতো না। তার পথের সাথী মিজানের অস্তিত্ব সে পথে নেমেই ভুলে যেতো। এখানে এলেই মিজান বলতো, “দেখ নানার বোর্ড”। মিজানের এ কথায় আবুলের সম্বিত ফিরতো। মোটামুটি বড়-সড় একতলা বিল্ডিং। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়। নানা এ পরিষদের চেয়ারম্যান। প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেলিস্ট।

এক সময় ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে প্রেসিডেন্ট বলতোতখনো তিনিই এ ইউনিয়নের প্রধান ছিলেন। শিক্ষান্যায়-নিষ্ঠাকর্ম দক্ষতাসততাউন্নয়ন কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে গোটা পূর্ব-পাকিস্তানে যে কজন চেয়ারম্যানের নাম সরকারের দপ্তরের সাথে সাথে জনগণের মন-মন্দিরেও সুবর্ণ অক্ষরে খচিত ছিলোতিনি তাঁদের অন্যতম। বোর্ড ঘরের সামনে উত্তর-দক্ষিণ দীর্ঘ মোটামুটি চাওড়া বাঁধানো রাস্তা। তারপর রেলওয়ে পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জমি। ধানতরমুজফুটিগোল আলুমিষ্টি আলুক্ষীরা প্রত্যেক প্রকারের শস্য এ জমিতে ফলে বেশ। উর্বর জমিএ জমিকে কোনোদিনই আবুল শস্যশূন্য দেখেনি। হয় হরিৎ নয় পাকা ফসলে সোনারঙের মনোরম এক উঠোন। এ স্থানটা পেরিয়ে খানমোহনা রেল ইস্টিশন ডানে রেখে উত্তর পশ্চিমে মিনিট ত্রিশেক ইটিলেই চেয়ারম্যান নানাদের বাড়ি।

চেয়ারম্যান বাড়ি নামে খ্যাত এ বাড়িটা আবুলের কাছে ছিলো 'রাজবাড়ি'। বাড়ির সামনে বিশাল পুকুর। একটি ছোটখাটো দিখি বলা চলে। লিথির তিন পাড়ে বাড়িউত্তর পাড় খালি। ঘনবসতি। গাছপালা আর জীর্ণ ঘরগুলো পাল্লা দিয়ে ঠাসাঠাসি করে আছে। প্রায় প্রতিটি পরিবার প্রান্তিক। দক্ষিণ পাড়ে কয়েকটা মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের টিনের বাড়ি। এগুলোর একটি আবুলের ফুফুদের। গোটা পশ্চিম পাড়জুড়ে আছে আবুলের 'রাজবাড়ি। বাড়ির সামনে পুকুরে শান-বাঁধানো ঘাট। বিশাল এবং কারুকাজ খচিত। তার পশ্চিমে একমাথা উঁচু সীমানা প্রাচীর। 

প্রাচীরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় সদর দরোজা। দরোজা দিয়ে ভিতরে পা দিলেই বিশাল উঠোন। উঠোনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে প্রায় বিদেখানেক জায়গা জুড়ে বিভিন্ন দেশীয় ফলমূলের গাছ। এসব গাছের ডালে ডালে কতো পাখ-পাখালির বাসা তার ইয়ত্তা নেই। রাজবাড়ির এ ছায়াময় মায়াভরা জায়গাটা আবুলের বড় প্রিয়। একবার এখানে পা রাখলে তার আর পাত্তা পাওয়া যেতো না। সে যেন বৃক্ষের ছায়ায়ঘন পল্লবের আবডালেপাখির নীড়েবাঁশঝাড়ের অন্ধকারেনারকেল-সুপুরি গাছের ওপারে আকাশের নীলে লীন হয়ে যেতো। বড় নানু অনেক খুঁজে তারপর তাকে ঘরে তুলতো। 'বসতবাড়িবলতেই 'রাজবাড়ি'। মাটিকাঠ আর টিনের উপর দ্বিতল অট্টালিকা। ছোট আবুলের মনে হতো- এ বাড়ি দৈর্ঘ্যে একচোখের পথ। মাটির চাওড়া দেয়ালরঙ করামাঝ বরাবর কাঠের ছাদউপরে টিনের ছাউনি। উপরের তলার চারপাশে খোলা বারান্দা। বারান্দায় কারুকাজ খচিত মেহগনি কাঠের বেড়া। প্রত্যেকটা দরোজা জানালার কাঠ যেমন পুরু তেমনি এমন সব নকশা কাটা যা চোখের সাথে মনকেও টানে। দ্বিতলে ওঠার সিঁড়িটাও কাঠের। ঘরের এক্কেবারে উত্তরের কামরায় পুবের দেয়াল ঘেঁষে সরু সিঁড়িটা বাড়ির সাথে বড্ড বেমানান। 

এখানে এলেই আবুলের মনটা খারাপ হয়ে যেতো। সে কিছুতেই বুঝতে পারতো নাএত্তো বড় বাড়িটা বানাতে যাদের কোনো কিছুর কমতি হলো নাসিঁড়ির বেলায় এমন কার্পণ্য কেন! আবুল ভাবতো: “তাহলে কি বাড়িটা বানাতে গিয়ে ছেলে নানু এতোটাই ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন যে সিঁড়িটা মানানসই করে বানানোর টাকাটাই ছিলো না!” এ বাড়িটাকে নিয়ে আরেকটা ভাবনা আবুলের মনে চুপে চুপে উঁকি দিতো: “নানু তাঁর বাবা-মার একমাত্র ছেলে। নানুরও উত্তর প্রজন্ম বলতে একমাত্র মেয়েযাঁর বিয়ে হয়ে গেছে আবুলের মামার সাথে। ছেলের আশায় নানু দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বড় মেয়ে নানু একটি ছেলে দত্তক নিয়েছেন। এখন তাঁরা সাকুল্যে চারজন। চারজন মানুষের জন্যে এত্তো বিশাল বাড়ি।” মূল ঘরের সাথে সংলগ্ন পূর্ব-পশ্চিম লম্বাদক্ষিণমুখী রসুইঘর। ঘর নয় যেন হা-ডু-ডু খেলার মাঠ। মূলঘর পুবমুখী। এ ঘরের পশ্চিম পাশে কোনো দরোজা নেই। আছে বেশ কটি জানালা। ঘরের পশ্চিম পাশে যেতে হলে রসুইঘর দিয়ে যেতে হয় । না হয় মূল ঘরের দক্ষিণ অথবা উত্তর পাশে ঘুরে। পশ্চিম পাশে কিছুটা খালি জায়গাতারপর পুকুর।

পুকুরটা বিঘেখানেক জায়গাজুড়ে। পুকুরের তিন পাড়েই বিভিন্ন জাতের গাছপালা। রসুইঘর ছুঁয়েই একটি শানবাঁধানো ঘাট। পানি স্ফটিক স্বচ্ছ। পুকুরে রকমারি মাছের চাষ। এ পুকুরের পশ্চিম পাশে দৃষ্টিসীমা ছুঁয়ে আছে জমি আর জমি যার অনেকটারই মালিক আবুলের চেয়ারম্যান নানু। এ জমি নিচু ও উর্বর। এ জমিতে কেবল ধান হয়। এর বুক চিরে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত 'চাঁনখালি'। যার একপ্রান্ত ছুঁয়েছে কর্ণফুলি অন্য প্রান্ত শব্দ। বাতির নিচের আঁধারের মতো রাজবাড়ির গা ঘেঁষে উত্তর পাশে একটি জীর্ণ কুটির। আবুল শুনেছে এটিও রাজবাড়ির অংশ ছিলো। কী এক সম্পর্কের সূত্র ধরে বর্তমান মালিক দখল করেছে। ঘরটা দেখলেই আবুলের মনে হতো : “ভীষণ সুন্দরনাদুসনুদুস কোরবানির ষাড়ের পায়ের ক্ষত।" মূল ঘরের গা ঘেঁষে পশ্চিম পাশে একটা বেলেম্বু গাছ (এক প্রকার টকজাতীয় ফল) দ্বিতলের বারান্দা স্পর্শ করেছে। চেয়ারম্যান নানুর বাড়িতে গেলে আবুলের তাদের বড় নানুর সাথে দ্বিতলের একটা ঘরে থাকতো। সেখানে ওয়াশরুমের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছোট কাজটা সারতে হতো মাটির শানকিতে।

দ্বিতলে উঠলেই কেন যেন জলের নিম্নচাপটা বেড়ে যেত অকারণ। তখন তারা শানকি ব্যবহার না করে সরাসরি পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেলেম্বু গাছটার গায়ে মনের আনন্দে জলত্যাগ করতো । বড় নানুর আদরমাখা বকুনি আবুল-মিজানদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিত শতগুণ। বড় মেয়ে নানুর মতো এমন নরমএমন স্নিগ্ধ মূর্তিমতি মাতৃরূপ সত্যিই বিরল। স্নেহ আর মমতার পাশাপাশি আভিজাত্য যেন আবুলের বড় নানুর সারা অঙ্গ থেকে ঝরে ঝরে পড়তো। আর ছোট নানুথাকতার কথা না হয় নাই বা বললাম আবুলেরা যখন রাজবাড়ির রাজতোরণে পা রাখলোতখন ক্লান্ত দিনদের পশ্চিম গগনে হেলান দিয়েছে। তার তেজও গেছে মরে। তবে তাতে ধরেছে রঙ। আধির অনেক বাধা পেরিয়ে কেমন করে এক ফালি আবির রঙে আলো চেয়ারম্যান বাড়ির সদর দরোজার বিশাল কৃষ্ণচূড়ার ডালের ফাঁ গলে সামনের পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়েছে। যেন দিনের কাজ শেষ করে স্নানে নেমেছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য তারকুলবধূদের ঘটের ঘায়ে সৃষ্ট ঢেউয়ে তার গায়ে ধরেছে কাঁপন। ভেতরে ঢুকেই আবুলের সারা গায়ের কেশ খাড়া হয়ে গেলো। কী এক অজানা শঙ্কায় তার অন্তর-আত্মা বারবার কেঁপে উঠলো। মিজানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে আবুল মিজানের মুখে চোখ রাখলো। নাসেখানে আবুল কিচ্ছুটি বুঝতে পারলো না। গোটা গ্রামটাই যেন ভেঙে পড়েছে চেয়ারম্যান বাড়িতে। চেয়ারম্যানকে মাঝখানে নিয়ে সকলে কী যেন আলোচনায় মশগুল। আবুলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মিজান বললো: “ভাবিস নাও কিচ্ছু না। নানু জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেনতাই গ্রামের লোক অভিনন্দন জানাতে এসেছেন। মিজানের কথায় আবুল বুঝলো সে বিষয়টি আগে থেকেই জানতো একে একে সকলেই চলে গেলো।

চেয়ারম্যান নানু একা। মোটা কাপড়ের আরাম চেয়ারে আধ-শোয়া অবস্থায় তাঁর শখের বাঁধানো গড়গড়ায় তামাক সেবনে মত্ত। দু চোখ বোজা। ডানহাতে গড়গড়ার নল ধরাবাম হাত উল্টো করে আড়াআড়ি ভাবে কপালের উপর অসহায়ের মতো পড়ে আছে। চোখের চশমার পুরু গ্লাসে প্রায় মরে আসা সূর্যালোক যেন পরম অবহেলায় লুটোপুটি খেলছে। আবুলেরা টিফিন ক্যারিয়ারটা এক পাশে রেখে ধীর পায়ে গিয়ে তাঁর পা-ছুঁয়ে সালাম করলো। চোখ না খুলেই তিনি বললেন: “যা ঘরে যা। তোর বড় নানু উপরে আছে।” এ মানুষটাকে সকলেই ভয় পায় । এবং যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলে । কিন্তু আবুলের কেন জানি মনো হতোযা তিনি দেখাতেন তা তিনি নন। তিনি একজন ভীষণ বর্ণচোরা। কেবল খোলসটা দেখা যেতোমানুষটাকে নয়। হয়তো ভেতরের ভয়টাকে গোপন করার জন্যেই বাইরের এমন কাঠিন্য।

এতো বিষয়-আশয়এতো লেখাপড়াএতো ক্ষমতাএতো দাপট তারপরও কীসের এতো ভয়! বংশের বাতিনাকিশোর আবুল আর ভাবতে পারতো না। নিজের মনে নিজেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়তোতবে এই তিন কুড়ি বছরের আবুলের কাছেও চেয়ারম্যান নানু একজন ভীষণ মজার মানুষ। এখনো অলস কোনো মুহূর্তে তাঁর দরাজ অভিজাত কন্ঠস্বর আবুলের কানে বাজে। তিনি যেন ডাকছেন: "মধুও মধু!” যখন থেকেই আবুল বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই জেনে এসেছে তার নিকটাত্মীয় বলতে মামারাই আপন। আবুলের মায়ের কোনো বোন ছিলো না। ছিলো দুই ভাই। দুজনই আবুলের মায়ের ছোট। আবুলের কিশোরী মায়ের কাঁধে সংসারের অলিখিত দায়িত্ব দিয়ে আবুলের নানা-নানি যখন বেহেশতবাসী হনতখন আবুলের দু-মামা মাটির সাথে কথা বলছে। আবুলের নানা ছিলেন প্রথম সারির ঠিকাদার।

বিত্ত-বৈভবও কম ছিলো না। কিন্তু এসব দেখাশোনা করার মতো আপনজন কেউ না থাকায় দু-ভাইকে নিয়ে আবুলের মা অথৈ সাগরে পড়লেন। পরন্তু জায়গা সম্পত্তি যা ছিলো তাও বেহাত হবার জোগাড়। এমন বৈরী হওয়ার উত্তাল তোড়ের হাল ধরে সংসারটিকে কোনোমতে বাঁচিয়ে দেন যিনিতিনি আবুলের মায়ের দূর সম্পর্কের এক চাচা। আবুলেরা তাঁকে দেখেছে। কাঁচা হলুদ গায়ের রঙমাঝারি গড়নএক মুখ শ্বেতশুভ্র শুশ্রু নিয়ে এক ঈর্ষণীয় সুপুরুষ। আবুল মায়ের মুখে শুনেছেএতো বিষয়-আশয় থাকতেও আবুলের মামারা স্কুলে যেতেন লঙ্কামাখা পাস্তা খেয়ে পরিধানের জন্যে তাদের ভালো কাপড় চোপড় জোটেনি। আবুলের বড় মামা ভীষণ মেধাবী ছিলেন। স্বভাব ও মেধার জন্যে গোটা এলাকায় তাঁর খ্যাতি ছিলো। জলপানি পেয়ে স্কুল কলেজের সোপানগুলো পেরিয়ে গেলেন টপাটপ ।

চাকরি নিলেন ব্যাংকে। ভালো চাকরিসুদর্শনমেধাবীবংশও ভালোএমন পাত্র হাতছাড়া করলেন না আবুলের চেয়ারম্যান নানু। তাঁর একমাত্র সন্তান জয়নবকে পরম আগ্রহে তুলে দিলেন তাঁর হাতে। সুখ আর শান্তি যমজ ভাই-বোনের মতো বাসা বাঁধলো আবুলের বড় মামার সংসারে। কিন্তু বিয়ের বছর পাঁচেকের মাথায় অকস্মাৎ পড়লো বাজ। দু ছেলে দু মেয়ে রেখে আবুলের বড় মামা চলে গেলেন আর না ফেরার দেশে। বড় মামার কথা ভাবলে আবুলের কেবল একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি আর তার মায়ের মূর্ছা যাওয়া ছাড়া কিছুই মনে পড়ে না। অবোধ শিশুদের কথা ভেবে ময়মুরব্বিরা আবুলের ছোট মামার সাথেই তার বড় মামির বিয়ে দেন। তাই আবুলের দু মামাএক মামি

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!