চেনা পথ অচেনা পথিক, লেখক: এম.এ. কাশেম। (২য় পর্ব)
নানার বিশাল বাড়ি। মাটির দেয়াল, টিনের ছাউনি। দেড়তলা। ইটের
বাঁধানো পাকা দাওয়া ঘরের চারপাশে। কাঠের উপর হাতের কাজ করা, চমৎকার
নকশাদার দরোজা, জানালা। জানালার গরাদগুলোও
দৃষ্টিনন্দন। বাড়ির সামনের দিকে প্রায় মাঝামাঝি মাটির সিঁড়ি। সিঁড়িতে যত্নের
অভাব যে কোনো অর্বাচীনের চোখকেও পীড়া দেবে। সিঁড়ির ধাপে ধাপে গর্ত। আর পুরোটাই
এবড়ো-খেবড়ো। নামে মাত্র একটা দরোজা আছে। দিন-রাত অষ্টপ্রহর হাট করা। বাড়ির যতো
বেওয়ারিশ কুকুরের নিরাপদ আস্তানা। মাঝে-মধ্যে দুয়েকটা বিড়ালের গতায়াতও চোখে
পড়ে। অসংখ্য জালালি কবুতরের নিরাপদ আশ্রয় আবুলের নানাবাড়ির বিশাল ছাদটা। ছাদের
মেঝে পুরু কাঠের। কাঠের উপর মাটির স্তর এক ফুটেরও বেশি পুরু। তাতে মাঝে মাঝে গর্ত।
মাঝে মাঝে ফাটল। কিশোর আবুলের অত্যন্ত পছন্দের স্থান এটি। বিশেষত বর্ষাকালে। নীল
আসমান যখন তার সব দরোজা খুলে দিতো, কালো
মেঘের চাদরের তলায় ঢাকা পড়ে যেতো নীলের অসীমত্ব, বিষাদগ্রস্ত
আকাশের অগুনতি চোখে ঝরতো অশ্রু অবিরল; তখন চুপে
চুপে এসে আবুল ঠাঁই নিতো ছাদের এক কোনায় চারদিক কেমন আবছা-আঁধারে ঢাকা, কী এক
বিষাদের সুরে মেঘে বাজে ডম্বুর, হাজার ঘোড়ার খুরের শব্দ
টিনের চালে, দূরের ডোবায়, উঠোনের
জমা জলে ব্যাঙের আনন্দ সংগীত— সব মিলিয়ে রহস্যময় পরিবেশ। এই পরিবেশ কিশোর।
আবুলকে কেমন বিমোহিত করে দিতো। সে ভুলে যেতো তার বর্তমান, ভুলতো
অতীত, হতো আত্মবিস্মৃত। এখনো
বর্ষার কথা ভাবলে নানুবাড়ি, আর নানুবাড়ির কথা ভাবলেই সে
গর্তে ভরা, এবড়ো-খেবড়ো ছাদের কথাই মনে
পড়ে আবুলের। আর স্মৃতিকাতরতায় বুকের মাঝখানটায় গুরু গুরু করে ওঠে।
নানুদের বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। উঠোনের প্রায় মাঝামাঝি দেওয়া বাঁশের বেড়া
এটাকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। সামনের অংশের পূর্ব প্রান্তে চলাচলের রাস্তার ধার ঘেঁষে
কয়েকটা ভালো জাতের আমগাছ। গাছগুলো আকারে বিশাল, বয়সে
প্রাচীন। বাকি পুরোটাই সবুজ ঘাসে ঢাকা। উঠোনের ভেতরের অংশের উত্তর পাশে ডজনখানেক
পাতিলেবুর গাছ। পাতা আর ফল নিয়ে অনেকগুলো ডাল মাটি ছুঁয়ে আছে। বাকিটায় অযত্নে
বেড়ে ওঠো
দূর্বা। গাঢ় সবুজ। উঠোন থেকে ঘরে ঢোকার দুটো বাঁধানো পাকা সিঁড়ি। একটি পুবমুখী এ
বাড়িটার এক্কেবারে দক্ষিণে, অন্যটি উত্তরে । ঘরের উত্তর
পাশের দাওয়া দিয়ে অনায়াসে পেছনে যাওয়া যায়। আর পেছনে গেলেই আবুলের নানুবাড়ির
বিশালত্বটা চোখে পড়ে। মূলঘর থেকে হাত বিশেক পশ্চিমে পুবমুখী মাঝারি আকারের
রসুইঘর। ঘরটি বাঁশের বেড়ার ছনের ছাউনির । এ ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি বিশাল
কাঁঠালগাছ। এ গাছটি যেন আবুলের নানাবাড়ির ঐতিহ্য। এ গাছের কাঁঠাল যেমন আকারে
বিশাল তেমনি কড়া মিষ্টি। ধরেও প্রচুর। গাছের মগডাল থেকে শুরু করে মাটির ভেতরের
শেকড় পর্যন্ত। পাকলে পরে মাটি ফেটে কাঁঠালের পাকা গন্ধ বেরিয়ে আসতো ভুরভুর করে। এ ঘটনা
অবশ্য আকসার ঘটতো না, ঘটতো মাঝে-মধ্যে। তখন খোঁড়ো
মাটি, পাড়ো কাঁঠাল। এ কাঁঠালের
স্বাদই আলাদা। ররুইঘরের সামান্য দক্ষিণে হাত পঞ্চাশেক পশ্চিমে গোলাঘর। মামারা চাষ
করতেন না, জমি বর্গা দিতেন।
বর্গাচাষিরা যে ধান দিতো তা দিয়ে আবুলের মামি সংসারের সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করতেন।
মামা বলতে আবুলেরা ছোটো মামাকে বুঝতো। বড় মামার কথা মনে পড়তো বছরে একবার। তাও
যতদিন মা বেঁচে ছিলেন। ঐ দিন আবুলের মা নীরব চোখের জলে গণ্ড ভাসিয়ে বড় একটা মোরগ
জবেহ করে, হুজুর ডেকে আবুলের মামার
ফাতেহা দিতেন। হুজুরকে দিয়ে মরহুমের আত্মার মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করাতেন। ছোটো
মামাকে কোনোদিন কোনো কাজ করতে আবুল দেখেনি। তাঁর মন ছিল যাযাবর। কাজ বলতে ছিলো
ক্লাব, নাটক আর আড্ডা। বেজায়
রশভারী মানুষ ছিলেন তিনি। কেন জানি কিশোর আবুলের মনে হতো, তার ছোটো
মামা ভীষণ দুঃখী মানুষ। নাটক আর আড্ডার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখে তিনি যেন এই দুঃখ
গোপন করতেন।
উত্তর-পশ্চিম পাশ জুড়ে বিস্তীর্ণ খালি জায়গা। অন্তত বিঘে পাঁচেকের কম নয়। এখানে
বাগান, আম-কাঁঠালের গাছ, সফেদা, কামরাঙ্গা
গাছ ছাড়াও বিভিন্ন বনস্পতি, বিশাল বিশাল বাঁশঝাড় অনেকটা
আরণ্যক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। জায়গাটার কোল জুড়েই পিছনের পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ, পশ্চিম ও
উত্তর পাড় ঘিরে গড়ে উঠেছে আবুলের স্বপ্নের তপোবন। জায়গাটার মালিক আবুলের নানু।
আর এটি ছিলো নানুবাড়িতে আবুলের বিস্ময়। বর্ষাকালে গোটা এলাকাটা একটা জঙ্গলে
পরিণত হতো। কতো
আগাছা, লতাপাতা যে গজাতো তার শুমার
করা কিশোর আবুলের সাধ্যে কুলাতো না। ধন-কপোত, কাঠ-ঠোকরা, টুনটুনি, বউ-কথা কও, বুলবুলি
কতো পাখির দেখা মেলা বসে যেতো। সাপ, নেউল, শিয়াল, বনবিড়ালের
দেখা দিনের বেলাতেও মিলতো। 'গুইসাপ' তো ছিলো
এক্কেবারে পান্তা ভাত। আর এমন একটা পরিবেশ কেন যে আবুলের ভালো লাগতো তা কি সে
নিজেও জানে। এখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আবুলদের অনেক অনেক দুষ্ট-মিষ্ট স্মৃতি।
জায়গাটা এমনিতে বুনো বুনো। পরম্ভ পুকুরের উত্তর পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পুবের
পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোটো নদীটি এ বন্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে শত গুণ। শুকনা মৌসুমে
বালিতে পূর্ণ একটি রেখামাত্র। কিন্তু বর্ষায় সর্বনাশা পদ্মা। চানখালিতে গিয়েই এই
পাহাড়ি ছোট নদীটির আত্মবিসর্জন। একাত্তরের ডিসেম্বরের দশম দিনে। এইখানে আবুলের
বার-তের বছরের জীবনের অবসান হতে পারতো। ঐ দিন শীতের সকালে আবুল তার প্রিয়
বাঁশঝাড়ের কঞ্চি ধরে ধরে নিজের মতো করে খেলছিলো। খেলছিলো পুকুরের পশ্চিম পাড়ের
জংলা জায়গাটায়। আবুলের নানাবাড়ির পশ্চিম সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে একটি গড়খাই।
তারপর সাব-রেজিস্ট্রার বাড়ির বাগিচা। হঠাৎ আবুলের চোখে পড়ে ভয়ালদর্শন সশস্ত্র
পাক-হানাদার বাহিনী অস্ত্র উচিয়ে মার্চ করে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে চলছে।
এদের একজন অস্ত্র তাক করেছে তার দিকে। তারপর আর কিছু মনে নেই। কতক্ষণ পর তার
চৈতন্য হয়েছিলো। কখন সে নানুর ঘরে ফিরেছিলো তার কিচ্ছুটি মনে নেই। কেবল এটুকু মনে
আছে এ ঘটনা আবুল না তার মাকে, না মামিকে কাউকেই বলেনি।
আবুলের মূল আকর্ষণ ছিল তার মামি। মমতার আদৃশ্য সুতোয় আবুলকে তার মামি টানতো
নিরন্তর। এমন রমণীরত্ন আবুল তার তিন কুড়ি বছরের ক্ষুদ্র জীবনে দ্বিতীয়টি আর
দেখেনি। বড় আর ছোট মামার ঘরে আবুলের মামির সাকুল্য সন্তান-সন্ততি আটজন। জন্মের পর
প্রায় সমান সংখ্যক সন্তান-সন্ততি তাঁর মামিকে কাঁদিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মাটির
চিরশান্তির কোলে। অবশ্য বড় মেয়েটি, যার নামে
সকলে তার মামিকে ডাকে সে বছর দশেক পর্যন্ত এ পৃথিবীতে ছিলো। আবুলের প্রায়
কাছাকাছি বয়সের। সারা পৃথিবীর লাবণ্য যেন ঝরে পড়তো তার মুখশ্রী হতে। কাজল-কালো
ডাগর
যেন বাঁধা পড়েছিলো গোটা জগতের দীপ্তি। দেখে মনে হতে পথ ভুলে কোনো মৃগশিশু গহিন
অরণ্য ছেড়ে নেমে এসেছে জনারণ্যে। তাই ভয় ভয় চাহনি, আর
ব্রীড়ানত মুখমণ্ডলের আবডালে গুপ্ত থাকতো তার বয়সোচিত চাঞ্চল্য। পেরেক, একটি
মাত্র জংধরা পেরেক তার এ সুন্দর জীবনের ইতি টেনে দিয়েছে। আবুল সচরাচর তার বার্ষিক
পরীক্ষার পরই নানুবাড়ি যেতো। নতুন বছরের পড়া শুরু হবার আগে আগেই ফিরে আসতো। ফিরে
আসতো আবুল মনমরা অবস্থায় — মিজানের পুরানো বই গুলো নিয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত
এক বছরের জন্যও এর ব্যত্যয় হয়নি। অথচ বোকা আবুলের কাছে নতুন বইয়ের গন্ধই ছিলো
সবচেয়ে উপভোগ্য।
বইয়ের গন্ধ উপভোগের আনন্দ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিলো কিশোর আবুল। অবশ্য কালে তা
পুষিয়ে নিয়েছিলো সে। আবুলের কাছে তার মামির হাতের রান্না সামান্য শাক-পাতাও যে
কেমন বেহেশতি চিজ হয়ে উঠতো; তা না খেলে কল্পনা করাও
অসম্ভব। পটল কিংবা কাঁকরোল দিয়ে কুচো চিংড়ির তরকারি মামির হাতে যেন অমৃত। আহ! কী
সোয়াদ। এখনো যেন বুড়ো আবুলের জিহ্বামে তা লেগে আছে। সে কথা মনে হলেই লালা ঝরে।
নানুবাড়িতে রসুইঘরে পিঁড়ি পেতে সকলেই খেতে বসতো। প্রথমে কচিকাচাদের পালা তারপর
বয়স্করা। মামার বসার জন্য অবশ্য আলাদা ব্যবস্থা ছিলো। হাতে বানানো বাঁশের বেতের
চাঁচ। আবুলের মামি তরকারির ডেকচিটা আগলেই বসতেন। এবং নিজ হাতে সকলের পাতে
বরাদ্দমতো তরকারি পরিবেশন করতেন। যখন আবুল মিজানদের সাথে খেতে বসতো তখন পষ্ট দেখতে
পেতো তার পাতে তরকারির পরিমাণ অন্যদের তুলনায় অন্তত তিন গুণ বেশি। ছোট হলেও
বিষয়টা আবুলকে ভীষণ লজ্জিত করতো। কিন্তু ভয় এবং সঙ্কোচে মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলতে
পারতো না।
একটি ঘটনা মনে পড়লে এখনো আবুল লজ্জায় কাছিমের মতো নিজের মধ্যেই গুটিয়ে যায়।
সেবারও বার্ষিক পরীক্ষার পরে এক শীতে মাসহ আবুলেরা নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো।
সেদিন দুপুরবেলা আবুলের মামি বড় বড় কুচো চিংড়ি দিয়ে কাঁকরোলের তরকারি রান্না
করেছিলেন। সকলের পাতে তিনি নিজ হাতে দু টুকরা কাঁকরোল আর একটি করে চিংড়ি মাছ
তুলে। দিলেন। কিন্তু আবুলের পাতে কাঁকরোল দু টুকরা দিলেও চিংড়ি মাছ দিলেন। এক
গণ্ডা। আবুলের মেজো মামাতো ভাইটি তা দেখে একটু গাইগুই করলে
বুঝতে পারেন। তখন তিনি যা করলেন, মৃত্যুর পরেও আবুলের তা মনে
থাকবে। তিনি গোটা ডেকচির তরকারি তাঁর মেজো ছেলের পাতে উপুড় করে দিলেন এবং পুরোটা
খেতে তাকে বাধ্য করলেন। কাওটা ভালো কি মন্দ হলো তা ভাবার মতো বয়স সেদিন উপস্থিত
কারোরই ছিলো না। তবে একটি অজানা শঙ্কা অন্যটির সাথে আবুলকেও স্তব্ধ করে দিয়েছিলো।
ভয়ের সাথে কেমন এক লজ্জাও সেদিন আবুলকে করে তুলেছিলো মুহ্যমান। মন যেন বারবার
বলতে ছিলো, “ছেড়ে দে মা কেঁদে
বাঁচি।"
মামিকে গোটা বাড়ির ছেলে-মেয়েরা ডাকতো 'নুনু-মা' বলে। এটি
ছিলো তাদের প্রাণের ডাক। এর অর্থ আবুল জানতো না, জানেও না।
পায়নি খোঁজার অবকাশ। তবে যখন চেয়ারম্যান মানু তাঁকে 'মধু' বলে
ডাকতেন, তখন আবুলের মনে হতো এটিই তার
মামির প্রকৃত পরিচয়। তাঁর সবকিছুতেই মাধুর্য। চলনে-বলনে এমনকি সোহাগ-শাসনেও।
মামির কথা ভাবলেই আবুলের মনে হয়। একটি মুরগি যেমন করে তার ছানাগুলোকে দু পাখনার
আবডালে লুকিয়ে রেখে নিজেই সমস্ত বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, মোকাবিলা
করে হিংসে সব শিকারি পাখির শোনদৃষ্টির; তেমনি
নিজের সংসারটাকে আগলে রাখেন মামি। নিজে জ্বলে-পুড়ে থাক হয়ে যান, কিন্তু
স্বামী-সন্তানের গায়ে লাগতে দেন না এতটুকুন আঁচ।
ঘরের মেয়ে ছিলেন আবুলের মামি। কোনো ধরনের উগ্রতা তার পদস্পর্শ করতে পারেনি
কোনোদিন। এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের কাছে তিনি ছিলেন শেষ ভরসাস্থল। প্রতিদিন
দুপুরে আবুলের মামির ঘরে দস্তুরমতো আসর বসে যেতো। গোটা বাড়ির মানুষের সুখ-দুঃখের
কথা তিনি শুনতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতেন। ছোট মামা ঘরে না থাকলে
সেদিন দুপুরটা রসে টইটুম্বুর হয়ে যেতো। বসতো গান আর গল্পের আসর। সকাল থেকে গভীর
রাত পর্যন্ত আবুলের মামির সাংসারিক কাজের কোনো অন্ত ছিলো না। কিন্তু এসবের মধ্যে
যথাসময়ে নামাজ আদায় এবং সকাল-সন্ধ্যা কোরআন তেলাওয়াত তাঁর বাদ যেতো না কখনো।
সাদা জমিনের কালো পেড়ে শাড়ি পরিধান করে মামি যখন বাঁশের বেতের তৈরি জায়নামাজে
নিবিষ্ট মনে বসে ইবাদতে মশগুল হতেন, তখন
আবুলের মনে
স্বয়ং তাপসী রাবেয়া। কিশোর আবুলের স্মৃতিতে তার মামিকে ঘিরে এমন কিছু দুর্লভ
মুহূর্ত আছে যার কোনো হদিস এখনো মেলেনি। গান, বিশেষত
জমকালো রোমান্টিক গানগুলো আবুলের মামির খুব প্রিয় ছিলো। মাঝে-মধ্যে গুন গুন করে
তাঁকে সে গান গাইতেও অনেকবার শুনেছে আবুল। কখনো কখনো বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় একা তিনি
জানালা ধরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি কোন অসীমে নিবন্ধ। চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু জল-
বৃষ্টির ছাঁট না হৃদয়ক্ষরা শোণিত তা অদ্যাবধি নিরসন করতে পারেনি আবুল। তিনি নিজে
সকলের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনতেন, কিন্তু তাঁর নিজের কথা
কোনোদিন কাউকে বলতে শোনেনি আবুল। তবে আবুল মাকে বলতে শুনেছে। “আমার ভাইয়ের বউয়ের
ধৈর্য সর্বংসহা পৃথিবীকেও হার মানাবে। আমার বাউন্ডুলে ভাইটির সাথে কীভাবে মানিয়ে
নিলো! কপাল, সব কপাল, এমন
লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটির ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত এ-ই ছিলো!” কিশোর আবুলের 'স্বপ্ন-লোক' ছিলো এর
নানুবাড়ি। এ স্বর্গলোকে ছোট মামার বাজখাই স্বরের শাসনে। মাঝে মধ্যে অসুর লোকের
কথা মনে পড়িয়ে দিলেও, এ স্বর্গ থেকে চ্যুত হওয়ার
কথা আবুল পালকের জন্যেও ভাবতে পারতো না।
পাশের বাড়ি মির্জাবাড়ি নামে খ্যাত। সবদিক দিয়ে এ বাড়ির অবস্থা নানুবাড়ি থেকে
অনেকটা পিছিয়ে। এ বাড়ির একটি ছেলের নাম আলম। সম্পর্কে আবুলনের মামা। লেখাপড়ায়
পাঁচ-সাত শ্রেণি উপরে। যেমন সুদর্শন তেমনি বিনয়ী। অধ্যবসায় আর মেধার সংমিশ্রণে
এমন এক উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন গোটা এলাকার অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত
হয়েছিলেন। রাস্তায় বের হলে সকলে বলতো “দেখো, দেখো, ঐ আলম
যাচ্ছে।” আবুলের মামি তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনিও মামিকে সমীহ করতেন
অপরিসীম। কৈশোরেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন ধর্মীয় সাধনায়। এখন তাঁর দুনিয়াজোড়া
নাম। আলম মামাকেই নিজের আদর্শ করার সুপ্ত ইচ্ছা আবুলের মনে এক সময় উকি দিয়েছিলো, কিন্তু
বিধি বাম, তা আর হয়ে উঠলো না।
সঙ্গদোষে আবুলের সকল স্বপ্নসাধ কোন সুদূরের নিরুদ্দেশ যাত্রী হয়ে গেলো। অনেক
সাধ্য-সাধনা করেও তার সন্ধান সে পেলো না। নানুবাড়ির বালিপ্রধান মাটিতে আবুলের আরো
একটা স্বপ্ন সমাহিত, অনেক গভীরে, আবুল জানে
মরণও তা আর কোনো দিন আবুলের জিহ্বাগ্রে এতটুকুন হাওয়া তুলবে না। আসবে না আওয়াজ
হয়ে।
যায় পলে পলে নিজের মতো করে। কখন কোথায় কী হচ্ছে, কে আসছে, কে যাচ্ছে; হাসছে কে, কে কাঁদছে
সেদিকে তার নেই ভ্রূক্ষেপ। আবুলদের সাথে বয়সে বড়-ছোট মিলিয়ে স্কুলে যেতো সাত
বন্ধু। যার মধ্যে আলমও ছিলো। একদিন বলা নেই কওয়া নেই সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে
দিলো। বন্ধ করে দিলো চিরতরে। তার নানুর হোটেলের ব্যবসা। আলমের মা ছাড়া তাঁর কোনো
সন্তান-সন্ততি নেই। আছাড় খেয়ে তিনি তার পা ভেঙে ফেলেছেন। তাই তাঁর চালু ব্যবসা
বন্ধ হবার জোগাড়। অগত্যা পড়া বন্ধ করে পত্রপাঠ আলমকে ছুটতে হলো।
আলম ছিলো
আবুলের সব কাজের সাথী। আলমের চলে যাওয়া আবুলকে বিকলাঙ্গ করে দিলো। খাটো সাইজের
ভীষণ সরল প্রকৃতির বালক আলম। গাটগোট্টা অথচ বলশালী। শক্তির তুলনায় বুদ্ধিটা ছিলো
কিছুটা কম। একদিন আবুলসহ দুজনে বাজারে যাচ্ছিল, চা আনবে।
বাড়িতে মেহমান আসছেন। চা তখন খুব সহজলভ্য ছিলো না। আবুলের মা আলমের হাতে ঘরের
একমাত্র ফ্লাস্কটি এবং কিছু খুচরো পয়সা ধরিয়ে দিয়ে বারবার সাবধান করে দিলেন যেন
খেলতে গিয়ে পয়সাগুলো হারিয়ে না ফেলে। নিরাপত্তার কথা ভেবে আলম খুচরো পয়সাগুলো
ফ্ল্যাঙ্কের মধ্যে রেখে তা নিয়ে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে লাফিয়ে লাফিয়ে চললো
বাজারের দিকে। সাথে আবুলও। দোকানদার ফ্ল্যাঙ্কের মুখ খোলে উপুড় করতেই ঝুরঝুর করে
পড়লো অসংখ্য চকচকে কাঁচের টুকরো। সাথে খুচরোগুলোও। হতভম্ব আবুল আর আলম। আলম
এমনিতে খুব ঠাণ্ডা কিন্তু রাগলে স্বয়ং বিধাতা পুরুষও তাকে শান্ত করতে পারে না। না, এখন সে
রাগলো না। অসহায়ের মতো আবুলের মুখের দিকে তাকালো। তখনকার দিনে ফ্ল্যাক্স নামে
যা-ই হোক, ব্যবহারের দিক থেকে ছিলো
ভীষণ অপ্রতুল, বলা যায় অভিজাত মহার্ঘ্য্য
বস্তু। আবুল আলমকে অভয় দিয়ে বললোঃ “ভাবিস না, মাকে বলিস
আমি ভেঙেছি। মা সে কথা সহজেই মেনে নেবেন।” আলম সেদিন মিথ্যা বলতে পারেনি। সেদিন
কেন, আমৃত্যু কোনো দিনই পারেনি।
আবুলের মা অবশ্য আলমের সত্যি কথা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। আবুলের মায়ের অবস্থা
দেখে আবুল একটুখানি হেসে আলমকে বলেছিলো:
“সত্যি তুই বাটু পলোয়ান।” খেপানোর জন্য সকলেই শৈশবে আলমকে এই নামে ডাকতো।
আগেই গ্রামের স্কুল ছেড়ে হাবিলাসদ্বীপ উচ্চবিদ্যালয়ে চলে গিয়েছিলো। পঞ্চম থেকে
ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলো। কিন্তু তার বাড়ির সহপাঠীরা এক এক
করে ঝরে গেলো। যারা পাস করলো তারাও, আর যারা
পাস করতে পারলো না তারাও। আলম তো চতুর্থ শ্রেণিতেই পড়ালেখার কম্ম কাবার করে তার
নানার পদসেবায় লেগে গেলো। ধীরে ধীরে সে সম্পূর্ণ হোটেল বয় হয়ে উঠলো। দিনে
লুকোচুরি, রাতে কানামাছি খেলা বৈ অন্য
কোনো সময় আবুল তার বাড়ির বন্ধুদের সঙ্গ পায় না। সে যেন এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
যত না শরীরে, তারচেয়ে বেশি মনে। রাতের
বেলা বিশেষত শরতের রাতে, যখন পেঁজা তুলোর মতো আকাশে
সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়, যার ফাঁকে-ফোঁকরে মাঝেমধ্যে
ডুব দেয়, মাঝেমধ্যে উকি মারে শুক্লা
দ্বাদশীর চাঁদ; তখন তারা দল বেঁধে খেলায়
মাতে। বড়োরা ঘরের বাইরে মাদুর পেতে বসে মাতে আড্ডায়। কতো কতো তাদের কথা।
উপাখ্যান নয়, রূপকথা নয়, সকলই
জীবনের কথা। কথা ঘরকন্নার, কথা ফেলে আসা জীবনের। সেখানে
সুখের কথা ছিলো, দুঃখের কথা ছিলো। ছিলো
হাসি-কান্নায় ভরা জীবনের কথা। সে কথা এখনো আবুলের কানে বাজে আর কথা বলার লোকগুলোর
মুখ ভেবে দু চোখের পাতা ভীষণ ভারী হয়ে ওঠে। না, নেই। এখন
আর তাদের কেউ নেই। এ আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন আবুলের মা। এক সময়ে খেলা শেষে আবুলেরা
এসেও মাদুরে শুয়ে পড়তো। তখন শুরু হতো আবুলের মায়ের পুঁথিপাঠের আসর। চলতো
মধ্যরাত অবধি। অনেকেই উঠোনে মানুরের উপর ঘুমিয়েই পড়তো। তাদের ঘুম ভাঙিয়ে ঘরে
নিয়ে যাওয়া সত্যিই ভীষণ ঝক্কির ব্যাপার ছিলো।
আরেকটি বিষয় আবুলকে ভীষণ ভাবাতো। যখন সে মাথার নিচে দু হাত দিয়ে চিত হয়ে আকাশের
তারা গুনতো, আর পেঁজা পেঁজা মেঘের সাথে
পাল্লা দিয়ে নিজের মনকে ভাসিয়ে দিতো চির-অচেনা কল্পলোকে, তখন সে
পষ্ট বুঝতো একটি কোমল-নরম কচি হাত তার ডান পায়ের উরুতে আস্তে আস্তে বিলি কাটছে।
আর তা
ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে আসছে। কেমন এক অসহনীয় অস্বস্তি এবং লজ্জামাখানো শিহরণ
আবুলকে উন্নত করে তুলতো। কিন্তু সে দাঁত কামড়ে বৃক্ষখণ্ডের মতো অসাড় পড়ে থাকতো।
চাদে মেঘে লুকোচুরি খেলাটা তখন তার কাছে অন্য এক অর্থ হয়ে ধরা দিতো। হয়ে যেতো
তারও জীবনের অংশ। না, এখনো আবুল সে গোপনচারিণীর
ঘোমটা কারো কাছে খোলেনি। এক সময় একে একে সকলেই ঘরে চলে যেতো। চলে যেতো
গোপনচারিণীও, আড়চোখে চেয়ে চেয়ে। মুখে
পেঁজা তুলোর হাসিটা লাগিয়ে রেখে আবুল কিন্তু তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তারপর, তারপর যখন
বুঝতে পারতো নিচের উঠোনে ছেঁড়া মাদুরে সে একা, আর মাথার
উপরে অসীম আকাশে পেঁজা পেঁজা সাদা সাদা মেঘগুলো বড় একা, তখন তাদের
সামনে মনের কথার খাতাটা মেলে ধরতো। সেখানে আবুলের স্বপ্নের কথা, আবুলের
সুন্দর আগামীর কথা এবং একজনের কথা, যাকে তখনো, এমনকি
এখনো আবুল দেখে নি—কেবল তার পায়ের আওয়াজ পেয়েছে, পেয়েছে
চুলের গন্ধ আর অধরা হাতের অধীর স্পর্শ।
আবুল একটা বান্দরে পরিণত হচ্ছিল। তার ছিলো চণ্ডালের রাগ। একবার রাগলে তাকে থামানো
স্বয়ং ব্রহ্মারও সাধ্যি ছিলো না। আর সে রাগতো মায়ের সাথেই বেশি। অবশ্য বিয়ের পর
বারকয়েক স্ত্রী-পুত্রের সাথেও তাকে রাগতে দেখা গেছে। আবুলের রাগ মানে দেয়ালে, পাথরে, গাছে মাথা
ঠোকানো, নিজের মাথা। এতো জোরে ঠোকাতো
ঠোকানোর স্থান এক একটি গোলালু হয়ে যেতো। এক সময় তো চৈতন্যই হারিয়েই ফিলতো।
পরনের কাপড়, গায়ের জামা ছিঁড়ে ছিঁড়ে
তুলো বানিয়ে ফেলতো। তাই আবুলের রাগকে সকলের ভয়। একবার তো ঘটলো এক মজার ঘটনা। তখন
আমন ধানের বীজ বপনের সময়। সকলেই বীজতলা তৈরিতে ব্যস্ত। সময়ও প্রায় দ্বিপ্রহর।
কী একটা কারণে আবুল তার মায়ের সাথে রেগে মেগে তীব্র বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
এটি তাদের মা-ছেলের প্রতিদিনের ব্যাপার, তাই
সেদিকে কেউ একটা খুব নজর দিলো না। কিন্তু একটু পরে গোটা বাড়ি জুড়ে ভীষণ হৈচৈ
পড়ে গেলো। আবুলের মা ঘন ঘন মূর্ছা যাচ্ছে। সকলের মুখে একই কথা: “আবুল আত্মহত্যা
করেছে।” ভীষণ শোরগোলের মধ্যে আবুলের
প্রতিবেশী তাঁর মুনাফ-চাচা, সে অবশ্য পুল্ল মামু' বলে
ডাকতো—এসে দেখেন পুকুর পাড়ের তেঁতুলতলার যে জমিটা এই একটু আগে তিনি মই দিয়ে বীজ
বপনের জন্যে তৈরি করে গেছেন, তার কাদার মধ্যে নাক-মুখ
গুঁজে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে আছে আবুল।
তার সারা গা এমন মাখামাখি হয়ে গেছে, দেখে মনে
হচ্ছে একটি মাটির পোটলা। আবুলের খুল্লা মামুর সাংসারিক বুদ্ধি ছিলো যেমন অসাধারণ, তেমনি
তিনি ছিলেন স্থিতধী। তিনি মুখে বা-টি না কেড়ে আবুলকে অই অবস্থায় পাঁজাকোলা করে
নিয়ে সামনের পুকুরের জলে ঝুপ করে ফেলে দিলেন। ততক্ষণে অকুস্থলে এবাড়ি ওবাড়ির
প্রায় শতাধিক ছেলে-মেয়ে বুড়ো-বুড়ি জড়ো হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর উপস্থিত সকলেই
দেখলো আবুল মনের সুখে সাঁতার কেটে পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে যাচ্ছে। ঐ দিকটা
একটু জংলা, পাড়েও ঘন গাছপালা বাঁশ আর
কেয়াঝাড়। এবং জায়গাটা আবুলের পছন্দেরও। কিন্তু কেন সেদিন কিশোর আবুল মায়ের
সাথে রেগে গিয়েছিলো, কেনই বা হতে চেয়েছিলো
আত্মঘাতী সে কথা না আবুল, না আবুলের মা কেউই
লোকসম্মুখে উচ্চারণ করেনি। জানতে চাইলে আবুলের মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন
আর আবুলের দু চোখের পাতা ছাপিয়ে আসে দু বিন্দু না-ঝরা অশ্রু । রাগলে
আবুল আর মানুষ থাকতো না। 'রাগ' সম্পর্কিত
মুনি-ঋষিদের বাণী সে নিজেকে নিজে শোনাতো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হতো না।
একবার, তখন আবুলেরা পুরাণ চাঁদগাঁও
থানার দক্ষিণ পাশে দু রুমের
একটি ঘরে থাকতো, নাম কোহিনুর কুঞ্জ-আবুলের তিন মেয়েই তখন
পৃথিবীর মুখ
দেখেছে।
ছোটোটা
অবুঝ, বড়টা আত্মকেন্দ্রিক কিন্তু
উদার এবং মেজোটা বিচক্ষণ, অবস্থাভেদে সুবিধাবাদী।
সেদিন কী কারণে যেন আবুল রেগে ছিলো ভীষণ । তারপর তার সব ক্ষোভ ঝাড়লো ঘরের
তৈজসপত্রের উপর। গ্লাস আর থালা বলতে একটিও অবশিষ্ট না রেখে সে ধুপধাপ করে বেরিয়ে
গেলো। এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুরের খাওয়ার সময় অতিক্রান্ত। সবাই চুপচাপ। মেজো
মেয়ে ভাবছে, “আজ তাদের খাওয়া হবে না। মেঝেতে
তো আর ভাত খাওয়া যাবে না । সুতরাং নির্জলা উপোস।” এমন সময় ছয়টি স্টিলের পানি
খাওয়ার পাত্র আর ছয়টি ভাত খাওয়ার থালা নিয়ে হাজির আবুল। এখনো ঐ তৈজসপত্রগুলো
সগৌরবে মাথা উঁচু করে আবুলের ক্ষোভ প্রকাশের সাক্ষ্য দিচ্ছে। কৈশোর
থেকেই আবুলের একটি রোগ ছিলো, এখনো আছে। রোগটা মনের। অনেক
ভেবেচিন্তেও এ রোগের কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আবুল অনুসন্ধান করতে পারেনি। এবং ঠিক
কখন, কোন মুহূর্ত থেকে এ অজানা
ব্যাধিটি তার মনের গভীর-গহিনে বাসা বেঁধেছে তা-ও সম্পূর্ণ অজানা। আবুল মাঝে মাঝে
ভাবে: এ কি তার মনোবিকলন! জীবনের নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত মনের এই অবস্থা
আবুলকে বড্ড পীড়া দিতো। মাঝে মাঝে এমন আশাহত হতো, আত্মহননের
তীব্র ইচ্ছা জাগতো। আবার বিষয়টার কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে নিজেই নিজের মধ্যে
গুটিয়ে যেতো।
আবুলের কতো আর বয়স হবে। ইস্কুলের গণ্ডী তখোনও পেরোয়নি। বয়স তের-চৌদ্দের ঘরে।
যতোবারই বাইরে থেকে আবুল ঘরে ফিরতো, ততবারই
তার মনে হতো ঘরে তার জন্য কেউ একজন অপেক্ষমাণ। তাকে সে চেনে, তাকে সে
জানে। কিন্তু তাকে দেখেনি কোনোদিন। কৈশোর থেকেই আবুল তার একটা অবয়ব দেয়ার
প্রাণপণ প্রয়াস পেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে ষোলআনা। প্রতিবারই বুকে আশা বেঁধে
আবুল বের হয়েছে, ফিরে এসে সে সত্যি সত্যি তার
স্বপ্নের মানুষটিকে বাস্তবে পাবে। আর প্রতিবারই তার আশাভঙ্গ হয়েছে। এই আশাভঙ্গের
যন্ত্রণা আবুলকে ধীরে ধীরে দুঃখবাদী মানুষে পরিণত করেছে। যতদিন
আবুলের মা বেঁচেছিলেন, যতদিন ঘরে আবুলের একটা
অবস্থান ছিলো, ততদিন মাঝে-মধ্যে আবুল
মানসিক দোটানায় পড়তো। হয়তো মাগরিবের আজান শুনে নীড়ের খোঁজে ভেসে যাওয়া ছোট্ট
পাখিটির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘরে ফিরে আবুল দেখলো, তার ঘরে
একজন আগন্তুক। গায়ে লাল পেড়ে হলুন জামা। মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুল, খোলা চুলরাশি
দু ভাগ হয়ে কাঁধের দু পাশ দিয়ে বুক ছড়িয়ে নাভিমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বুক
বরাবর কুচযুগল কুন্তলরাশিকে স্ফীত করে রেখেছে। পায়ের টকটকে লাল আলতা পরনের জামার
রঙের সাথে মিলেমিশে একাকার। কিন্তু পলক না ফেলতেই আবুলের ভুল ভাঙে; না এ তো
সে নয়। হাত-পা-চোখ-কান সব মিলিয়ে কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। কোথায়!
কোথায়! একে তো আবুল চেনে না। মেঘে মেঘে বেলা কম হলো না। এখন আবুল নিয়ত অন্য
পারের ডাক শোনে।
তবু সে না পাওয়া রহস্যময়ীর হাতছানি এই তিন কুড়ি
বছরের আবুলকেও হতবিহ্বল করে তোলে। এখনও চলন্ত ট্রেনের বগিতে, বাসের
জানালার পাশে; শপিং মলের ক্রেতাদের ভিড়ে, 'জেব্রাক্রসিং' দিয়ে
রাস্তা পারাপারের সময় আবুল যেন সে অধরার অস্পষ্ট অবয়ব স্পষ্ট অনুভব করে।
বিয়ে কী নিছক দুটি মানুষের জৈবিক সম্পর্কের আরেক নাম । দেহ অসাড় হলে মনও কি
নির্জীব হয়ে পড়ে। তাহলে দুটি শর্তহীন আত্মসমর্পণের নাম কী। না, এসব
বিষয়ের কোনো হদিস আবুল করতে পারে না। আবুল কেবল তার মায়ের কথা ভাবে। সুখ নামক
বস্তুটা তার মায়ের জীবনে কতটুকু ছিলো, কেমন করে
ছিলো, এসব বোকা আবুল ভাবতে চেষ্টা
করে। না, তার চেষ্টা কেবল চেষ্টাই
থেকে যায়, কোনো উত্তর খুঁজে পায় না।
বেঁচে থাকতেও মা, মৃত্যুর পরও মা; আবুলের
পরম ভালোবাসার পরম আরাধনার স্থান তার মা। কিন্তু এ মায়ের জন্যে সরবে আর নীরবে
অশ্রু বিসর্জন বৈ আবুল কিছুটিই করতে পারে না। আবুলের মায়ের হিস্টিরিয়া ছিলো।
বিয়ের পরপরই এ রোগ দেখা দেয়। তখনকার লোকেরা এ ব্যাধি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল
ছিলেন না। তাঁরা এ রোগকে জিন-পরির আছর বলে, নানা
রকমের ভুক-ডাক, তাবিজ-কবজের চিকিৎসা চালাতে
লাগলেন। ফলে আবুলের মায়ের শরীরে দেখা দেয় নানা রকম জটিলতা। গায়ের জ্বালা
মিটানোর জন্যে তিনি অষ্টপ্রহর পুকুরঘাটে গা ডুবিয়ে নাক ভাসিয়ে বসে থাকতেন। হয়তো
এসব ওষুধ-বিষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ফলে তিনি দীর্ঘদিন মাতৃত্বের আস্বাদ লাভেও
ছিলেন বঞ্চিত। দেশভাগের পুরো এক বছর আগে ১৯৪৬ সনে, বিয়ের
প্রায় এক যুগ পর আবুলের মা মা হন। তিনি অনিন্দ্যসুন্দর এক কন্যাসন্তানের জন্ম
দেন। তারপর একে একে আরো দু-দুটি কন্যাসন্তানের পর আবুলের জন্ম। আবুলের বাবার ছিলো
তেজারতি। লোকে ডাকতো সওদাগর।
পরেও আরও দু ভাই-বোন। এমনিতে ব্যাধিগ্রস্ত পরন্তু একের পর এক অপরিকল্পিত সন্তানের
জন্ম দিতে গিয়ে নিজের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছেন আবুলের মা। পুত্রসন্তানের
মুখ দেখে শারীরিক দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়েছিলো। কিন্তু মনের দুঃখ? পড়ালেখা
তিনি যৎকিঞ্চিৎ জানতেন। তার উপর ঐ সময়ও তিনি রকমারি সব পুঁথিপত্রের নিয়মিত পাঠক
ছিলেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব একটা ধারণাও গড়ে উঠেছিলো, ছিলো
নিজস্ব ভালো লাগা মন্দ লাগা; 'সুখপাখি' অধরা থেকে
গেলেও 'সুখ' ও 'দুঃখ'-এর মতো
সংবেদনশীল বিষয়গুলো তাঁকে ভীষণ তাড়িত করতো। যার তরঙ্গ এসে নাড়িয়ে দিতো শিশু
আবুলকেও। কী জানি কী সে ভাবতো! তবে ঐ চার-পাঁচ বছর বয়স হতেই সে তার মার কোলে মুখ
গুঁজে বিড় বিড় করে কত্তো কিছু বলতো। বলতো তার মায়ের সুখ-দুঃখের কথা। তার
স্বপ্নের কথা। হাবিলাস দ্বীপ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি, আরিফের
সাথে ঘনিষ্ঠতা এমনি আরো অনেক পারিপার্শ্বিক কারণ আবুলকে যেন হঠাৎ করেই অনেকটা বড়
করে দিলো। এখন সে চলার পথে প্রকৃতির পাঠশালায় নিত্য পাঠ গ্রহণ করে। সে গাছপালা
দেখে, সে ঝোপঝাড় দেখে, সে
কীটপতঙ্গ দেখে। ফুল থেকে ফুলে মধু মক্ষিকার মধু সংগ্রহ ছাড়াও পরাগায়নের বিষয়টাও
তাকে ভীষণ ভাবায়। সে মানুষ আর বৃক্ষের মধ্যে তফাত খোঁজে। তার মা-বাবাকে
তুষ্টচিত্তে পাশাপাশি দেখার একটি বার্থ ইচ্ছে এখনও আবুলের মানসপটে অলস মুহূর্তে
উকি দেয়। জানে এখন তা সম্ভব নয়। কিন্তু কল্পনায়? না, তাতেও
আবুল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আবুলের কেন জানি এখনও মনে হয়, তার মাছের
দাম্পত্যজীবন ছিলো পুরোটাই বৃক্ষের জীবন। অথবা তার মায়ের মানবীয় দাম্পত্যজীবন
অবলোকনের সৌভাগ্য আবুলের হয়নি। বাবা মুক্ত বিহঙ্গ। স্বাধীন পুরুষ। পরিবারের
সাপ্তাহিক মেহমান। সব সময় একটা মেজাজ নিয়ে থাকতেন। তার কোলে-কাঁধে চড়ার কোনো
সুখস্মৃতি, আবুলের স্মৃতি-বিস্মৃতির
কোথাও নেই। তাই তো বয়স্ক আবুলের মায়ের মতো বাবা হওয়ার প্রচেষ্টা সার্বক্ষণিক।
তবে সে জানে না এ ক্ষেত্রে তার সফলতা কতটুকু আর ব্যর্থতাই বা কী।
গোটা শৈশব-কৈশোর তার মাকে ঘিরেই বিনির্মিত। মায়ের ক্ষণভঙ্গুর শরীরের মতো
কল্পনাবিলাসী মনটাও আবুল পেয়েছিলো পুরোটাই। আবুলের তার মায়ের সাথে একবার ঘোড়ার
গাড়িতে, একবার নৌকোয় একবার রেলে
চড়ার কথা মনে পড়ে। আর প্রতিবারই সে তার মাকে নব নবরূপে আবিষ্কার করেছে। আবুলের
মনে হতো, তার মা চর্মচোখে দেখতেন। না, দেখতেন
অন্তরচক্ষুতে। আবুলের ভাষায় 'ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। আবুলদের
পরিবারটা রক্ষণশীল ছিলো না। ছিলো না ধম্মে কম্মেও এক্কেবারে উৎসর্গিত প্রাণ। বরং
ছিলো উলটোটাই। মুক্তাকাশের প্রগাঢ় নীলের সাথে খোলা হাওয়ার
এখানে নিত্য লুটোপুটি চলতো। চলতো গালগল্পের সাথে 'কলের গানে' কাননবালার
গান। চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙার সাথে হতো পদ্মাবতীর রূপের এখানে নিত্য মেলবন্ধন।
আলিফ-লায়লার দেও-দানোদেরও এখানে ছিলো নিত্য আনাগোনা। তারপরও রেওয়াজ বলে কথা। তা
ভাঙার মতো হিম্মত আবুলের মায়েরও ছিলো না। "বাপের বাড়ি যাবে, ভাইয়ের
বাড়ি যাবে; যাও না। মানা করছে কে? আর মানা
করার আছেই বা কে বাপু? এই ছাই ফেলতে ভাঙা কুল- চাচি
শাশুড়িখানা ছাড়া? তবে বাপু যেতে হবে রাইতের
বেলা। দিনে? অসম্ভব।” কথাগুলো আবুলের
বাপের দূর সম্পর্কের এক চাচির। নিজের বলতে একটি মাত্র মেয়ে। এগারো পেরোনোর আগেই
বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আর আছে সৎপুত্রের বউ ছেলে-মেয়েরা। তাদের কাছে বাঁধা ঝিয়ের
মতো। যতো কেরদানি আবুলের মায়ের বেলায়। ভাই আবুল মায়ের সাথে কোনো দিন দিনের
বেলায় কোথাও বেড়াতে যেতে পারিনি।
আবুলের বড় মামা বেঁচে। আবুলের মা বাপের বাড়ি যাবেন। আবুলের ছোটো বোনটি তখনও
জন্মায়নি। ছোটো ভাইটি সবে হামাগুড়ি দিচ্ছে। সন্ধ্যা লাগতেই গাড়ি এলো। ঘোড়ার
গাড়ি। এক ঘোড়ার গাড়ির সাথে জোতা ঘোড়া। মাঝখানে উঁচুমতো কোচওয়ানের বসার জায়গা, বাকিটা
অনেকটা আজকালকার রিকশার যাত্রী বসার জায়গার মতো ছাউনি দেওয়া। মহিলা যাত্রী ওঠে
আসনে বসলে সামনে একটা চাদর কিংবা কাপড় মুড়িয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর
কোচওয়ানের যাত্রা শুরু। আবুলদের বেলায়ও তার ব্যত্যয় হলো না। বাড়িরঘাটা থেকে
পুবদিকের রাস্তা ধরে চৌধুরী বাড়ি ডানে রেখে ধানি জমির মাঝ দিয়ে বড়ুয়াপাড়া
হয়ে গাড়ি উঠলো আরাকান সড়কে । উঁচু-নিচু রাস্তা। ঘোড়া ছুটছে ঢিমে তালে। ঘোড়ার
গলার ঝুমঝুমি পায়ের টকটক শব্দের সাথে সমানে তাল দিচ্ছে ঝুমঝুম ঝুমুর ঝুম। বড়
রাস্তায় উঠেই আবুলের মা কোচওয়ানকে গাড়ি থামিয়ে কাপড়ের আড়াল খুলে ফেলতে
বললেন। তাঁর কথা পালিত হলো অক্ষরে অক্ষরে। চাদরের আবডাল চলে যেতেই অনেক দূরের গোটা
আকাশটা যেন একমুঠো গাঢ় নীল, অগণিত উজ্জ্বল তারা, থালার মতো
গোল একটি রুপালি চাঁদ নিয়ে এক লাফে ছোট্ট আবুলের দু চোখে এসে ভর করলো। আবুলদের
গাড়ি ছুটছে তালে তালে। তার সাথে যেন পাল্লা দিয়ে পিছন পিছন যাচ্ছে রুপালি চাঁদের
থালা।
দুয়েক খণ্ড মেঘ এদিকে-ওদিকে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদের মুখ; তখন হঠাৎ
করেই বেড়ে যাচ্ছে তারার ঔজ্জ্বল্য। চাদের মেঘের লুকোচুরি খেলা, তারাদের
মিটিমিটি হাসি এবং রাস্তার দু ধারে গাছগাছালির আবছা আবছা ভুতুড়ে ছায়া, সব
মিলিয়ে কেমন একটা রহস্যঘন অজানা জগতে আবুলের একাকী ভ্রমণ; কেননা
গাড়ির চাদরের আড়ালের আড়াল সরাতেই আবুলের মা নিজেরই তৈরি অন্য এক জগতে নিজেকে
নিয়ে গেলেন যেখানে আবুলের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তখন তিনি কেমন যেন আনমনা হয়ে
চাঁদতারা, আকাশের নীলকে ছাড়িয়ে কোনো
এক অচেনা অসীমে অশরীরী আত্মার মতো হারিয়ে গেলেন। ভয় ভয় চোখে আবুল মাঝেমধ্যে
মায়ের মুখে চোখ রেখে আবার চাঁদের কালো ছায়ায় চাদের বুড়ির খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত
রাখার ভান করে। তার মনে হয় মা তার অন্য গ্রহের জীব। ভুল করে, ভুল সময়ে, ভুল
জায়গায় চলে এসেছেন। তখনকার দিনে বড় রাস্তায় খুব একটা কলের গাড়ি চলতো না। গরু
ও ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা হাতে গোনা। ফলে আবুলেরা তার নানাবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে
গিয়ে আকসার অন্য কোনো গাড়ির দেখা পেলো না। তার মনে হলো রূপকথার এক রাজরানি তার
একমাত্র রাজকুমারকে সঙ্গে নিয়ে তেপান্তর পেরিয়ে কোনো ঘন অরণ্যে নির্বাসনে
যাচ্ছেন। কোচওয়ান ছাড়া, সুদূরের নীল আকাশ, রুপালি
চাঁদ আর অগণিত তারারা দুঃখিনী রাজরানিকে বিদায় জানাচ্ছে। হঠাৎ আবুলের মায়ের কোলে
আবুলের ছোট্ট ভাইটি ওটা ওঁয়া রবে কেঁদে ওঠে।
অস্তিত্ব জাহির করলো। ছেলের কান্নায় আবুলের মা নিজের তৈরি নিশ্ছিদ্র আবরণ ভেদ করে
বাস্তবে ফিরে এলেন। কী এক মমতায় নিজের শিশুসন্তানকে অনেকটা জোরের সাথে বুকে
আঁকড়ে ধরলেন। এসব দেখে আবুল ক্যাবলাকান্তের মতো হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো। ততক্ষণে
মাঝ গগনের চাঁদের সাথে আবুলনের ঘোড়ার গাড়িটিও আবুলের নানাবাড়ির বিন্ধ্যাপুকুরের
উত্তর-পশ্চিম পাড়ে এসে থেমে গেছে। এখান থেকে গাড়ি আর যাবে না। আবুলের
কাছে নানুবাড়ি মানে ছোটো মামার ডাগর ডাগর রক্তজবা চোখ, মামির
হাতের রসনা তৃপ্ত রকমারি মাছের তরকারি, অন্তহীন
অলস দুপুর, কানাহীন পুকুরে বাধাহীন
উদ্দাম সাঁতার, স্বাস্থ্যপ্রদ নরম বিছানায়
স্বপ্নের রাত, তারকাদের
সাথে বিহঙ্গ আবুলের নিরন্তর মিতালি আর শিশিরভেজা কাকভোরে কয়লা হাতে পুকুরঘাটে জল
দখলের কপট লড়াই। সাধারণত আবুল তার নানাবাড়ি যেতো বার্ষিক পরীক্ষা শেষে
ডিসেম্বরের শীতে। পড়ালেখার দোহাই দিয়ে আবুলের নানাবাড়ি এবং বাবুলের ফুফুবাড়ি
অন্য সময়ে আসা-যাওয়ার উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি ছিলো। তাই সারাটি বছর আবুল
তীর্থের কাকের মতো এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করতো। প্রায়শ আবুল একাই যেতো। কিন্তু
সে বার পরীক্ষা শেষের আগের দিন মা আবুলকে বললেন: “কাল তো তোর পরীক্ষা শেষ। পরশু
তোর সাথে আমিও তোর মামাবাড়ি যাচ্ছি।”
রিকশায় চড়ে মামাবাড়ি যাওয়া হলো। মায়ের সাথে আবুলের নানাবাড়ি বড়ো একটা
যাওয়া হয় না। কিন্তু যদি সে সৌভাগ্য হয় তবে পোয়াবারো। আবুলের মাকে আবুলের
মামা-মামি বুবু ডাকলেও জানতেন মায়ের মতো। আবুলের মামা এমনিতে খুব একটা ঘরে থাকতেন
না। থাকলেও মেজাজ থাকত সপ্তমে। কিন্তু আবুলের মা নাইয়র গেলে তিনি তাঁর দিন-রাতের
অনেকটা সময় তাঁর বুবুকে দিতেন। দুপুরে এবং রাতের খাবারের পর গোটা বাড়ির
ময়মুরব্বি নারী-পুরুষ আবুলের নানাদের ঘরে এসে জমায়েত হতো। চলতো জমজমাট আড্ডা।
ফলে আবুলেরা দুপুরে ঘুমুতে গেল কিনা, রাতে
পড়ার টেবিলে কে কে আছে এসব তত্ত্ব-তালাশ করতো না কেউই। এ সুযোগটারই ফিকিরে তক্কে
তক্কে থাকতো আবুলেরা। দিনের বেলা বিন্ধ্যাপুকুরের পাড়, আর রাতে
সামনের রুমের খাটের তলায় বসতো আবুলদের হরেক কিসিমের সব খেলার আসর। আবুলদের আসরে
যবনিকাপাতের পরও তার মামাদের গালগল্প চলতো পূর্ণোদ্যমে।
আবুলের জীবনে এলো এক স্বপ্নের রাত। মায়ের এক ফুফু তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে
থাকতেন নানাবাড়ির এক্কেবারে দক্ষিণাংশে। মায়ের এ ফুফুকে আবুল দেখেছে। তখন তাঁর
বয়স নব্বই পেরিছে। হাঁটাচলা করতে পারতেন। তবে কুঁজো হয়ে। এতো বয়সেও তাঁর মাথায়
ছিলো গিজগিজে একমাথা লম্বা চুল; হালকা কালো, মাঝে মাঝে
দু এক গোছা ধবধবে সাদা। আবুলের মনে হতো কোনো শিল্পীর হাতের আঁকা সাদা ও কালো রঙের অপূর্ব রঙ রঙ
খেলা।
বুড়ি চাঁদের সবটুকু জোছনা চুরি করে যেন আবুলের নানাবাড়ির দক্ষিণের ঘরে লুকিয়ে
আছেন। আবুলের মা তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করতেন এবং আবুল ও অন্য ভাইবোনদের দিয়ে
করিয়ে নিতেন। আবুলেরা তাঁকে চাদের বুড়ি থুথুড়ি বলে ডাকতো। ডাকতো ভয়ে ভয়ে।
আরেক ফুফু মারা গেছেন আবুলদের জন্মের অনেক আগে। তাঁরও এক ছেলে। আবুলের মায়ের অনেক
বড়। পটিয়া শহরে দোকান আছে তাঁর। আবুলের নানাবাড়িতে যাতায়াত আছে নিয়মিত। বাড়ি
সম্পূর্ণ পাহাড়ি গ্রামে। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম রেলওয়ে। আবুলের মাকে এবার
তিনি তাঁদের বাড়িতে নাইয়র নেবেনই। আবুলের বাপের অনুমতিও পাওয়া গেছে। অতএব
যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক। অন্যদের কথা আবুল জানে না, কিন্তু
তার নিজের মনে গোপনে এ সংবাদটা নিয়ে এলো একমুঠো দখিনে হাওয়া, চঞ্চল
মজাদার। কারণ ট্রেনের ছবিই সে বইতে দেখেছে; চড়ার কথা
কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি । আর পাহাড়-পর্বতে স্বপ্নে আবুলের নিত্য অভিসার। সে তার
মায়ের আঁচলে মুখটি লুকিয়ে যাত্রার দিনক্ষণ জানার জন্যে তার মাকে চুপেচুপে
জ্বালাতন শুরু করলো।
ঠিকঠাক দিনক্ষণ আবুলের মনে নেই। তবে সময়টা ছিলো সন্ধ্যার পর। কারণ তখনও দোহাজারী
লাইনে চট্টগ্রাম শহর থেকে ট্রেন যেতো দিনের শেষভাগ থেকে মধ্যরাত অবধি। আর দোহাজারী
থেকে চট্টগ্রামের বটতলী ইস্টিশন পর্যন্ত কাকভোর থেকে বেলা দ্বিপ্রহর অবধি। ‘খরনা’
চট্টগ্রাম থেকে পুব-দখিনে দোহাজারীর সন্নিকটে। ট্রেনে খরনা' যেতে
সন্ধ্যের গাড়ির বিকল্প নেই। নানুবাড়ি থেকে আবুলেরা সন্ধ্যা লাগতেই রিকশাযোগে
পটিয়া রেল ইস্টিশনে এসে 'খরনা' পর্যন্ত
একটি পূর্ণ এবং দুটি অর্ধ টিকেট কাটলো। ট্রেনে তারা নির্দিষ্ট বগির নির্ধারিত আসনে
উঠে বসলো। শুরু হলো আবুলের ট্রেনযাত্রা। আবুল বসলো আসনের এক্কেবারে পুব পাশে
জানালার ধারে। কেমন একটা ঝাকুনি দিয়ে সুরেলা আওয়াজ তুলে তাল-লয় এক্কেবারে ঠিক
রেকে কু.. ঝিক ঝিক শব্দে সর্পিল গতিতে ছুটে চললো ট্রেন। কিন্তু তাজ্জবের বিষয়
আবুলের পষ্ট মনে হলো: “ ট্রেনসমেত আবুলেরা এক ঠাঁয় স্থির, দাঁড়িয়ে, আর বাইরের
যতটুকু জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে—গাছপালা, নদী-নালা, আকাশভরা
তারা, পাহাড়-পর্বত আর দিগন্তজোড়া মাঠ-প্রান্তর সব, সবকিছু
অন্ধের মতো ছুটছে পেছনের দিকে তীব্র গতিতে।” বিস্মিত আবুলকে অনেকটা জোরে
ধাক্কা দিয়ে তার মা জানালো: “বাবা, এবার
নামতে হবে।
মামাবাড়ি এসে গেছি।” আবুলের পিঠেপিঠি বড়বোন জাহান: “মা, তোমার ভাবুক ছেলে ধ্যানে বসেছে। তার ধ্যান ভাঙিয়ো না।” বলে মাঝখানে ফোঁড়ন কাটলো। ইস্টিশনের পুব পাশেই আবুলের মায়ের ফুফুবাড়ি। তার মায়ের ফুফাতো ভাইটা আবুলদের জন্যে ইস্টিশনেই অপেক্ষা করছিলেন। আবুলদের ট্রেন থেকে নামতে দেখেই তাদের দিকে এগিয়ে এলেন এবং আবুলের পিচ্চি ভাইটার দু গালে আদর খেতে খেতে আবুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন: “ভাগনে, আমরা খাঁটি গাঁইয়্যা, এখানে পথ চলার একমাত্র ভরসা আল্লাহর দেওয়া দুইটা পা। মামার বাড়ি বেশি দূরে নয়, হাঁটতে পারবে তো?”
আবুলের জবাবের কোনো তোয়াক্কা না করে পিচ্চিটাকে আবুলের মায়ের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে ইস্টিশন থেকে পুবদিকে চলে যাওয়া একটি সংকীর্ণ মেঠোপথে পা রাখলেন তিনি। মায়ের হাত ধরে আবুল আর তাদের পিছন পিছন আবুলের 'জানুপা' ও হাঁটা শুরু করলো। পাড়াগাঁ। আঁধার রাত। এঁকেবেঁকে ধেয়ে চলা মেঠোপথ। চারপাশ ঝোপঝাড়ে ভরা। আকাশের তারারা সমানে হাসছে মিটিমিটি। তাদের হাসির ছটা আলো হয়ে পাহাড়ি পথের দু ধারের তরুলতার উপর পতিত ।
প্রকৃতি যেন আলোছায়ার খেলা খেলছে জমিয়ে। বড় কোনো বনস্পতি পথে পাশে দাঁড়িয়ে তারার আলোতে সৃষ্টি করেছে এক ভুতুড়ে পরিবেশ। মায়ের আঁচলের তলায় মুখটি লুকিয়ে, নিজের বুকের ধুঁকোকো শুনতে শুনতে আবুলও পথ চলছে। তবে কেন জানি আবুলের মনে হচ্ছে, সে একটি ভীতু মেটে-ইঁদুর। একসময়, ঠিক কতক্ষণ পর এখনও অনুমান করতে পারে না আবুল, তারা পৌঁছলো গন্তব্যে। যেখানে গিয়ে আবুলদের যাত্রার ইতি হলো, কুপিবাতির আলোতে তা আবুল ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারলো না।
পরদিন সকালে চোখ খোলে আবুল, প্রথমে কিচ্ছুটি বুঝে উঠতে পারলো না। শয্যার আশপাশে দৃষ্টিপাত করে দেখলো, না, কোনো কিছুই আবুলের পরিচিত নয়। একটা যেমন-তেমন খাটের একপাশে কাঁথা মুড়িয়ে সে শুয়ে আছে। তার একপাশে লালচে রঙের মাটির দেয়াল। অন্যপাশে অন্য একটি কাঁথায়, আপাদমস্তক ঢেকে কে একজন শুয়ে। মাথার উপর কাঠের ছবি। ছাদের কাঠে হাতের কাজ। বেশ শৈল্পিক। চোখ আর মন দুটিই জুড়িয়ে গেলো। আবুলের পায়ের দিকে একটি জানালা। যদিও ডিসেম্বরের সকাল তবু কুয়াশা নয়, জানালা কবাটের ফোঁকর গলে আবুলের চোখে এসে লাগলো অর্বাচীন দিনদেবের নিস্তেজ রশ্মি।
চোখের সাথে মনেও যেন রশ্মি পাতন হলো। হুটহাট করে মনের জোরে সব স্মৃতি একসাথে ভিড় করলো; লাফ দিয়ে কাঁথাসমেত ওঠে বসলো আবুল। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে আবুল খাটটাকে নাড়িয়ে দিলো। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো ভীষণ। সে শব্দে পাশের কাঁথাটি নড়ে উঠলো। প্রথমে চোখ-মুখ থেকে কাঁথাটি সরলো, চোখ পড়লো আবুলের চোখে। এবার কাঁথা ছেড়ে তড়াক করে ওঠে বসলো পাশের জন। তারপর চোখে বিরাট এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন এঁকে আবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েক লহমা। আবুলের অবস্থাও তথৈবচ। তারপর চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে দুজন একই সাথে বলে উঠলে: "কে তুমি?” জবাবও দুজনে দিলো একই সাথে।
কালরাতে আবুলেরা যখন এ মামাবাড়িতে এসে পৌঁছায়, তখন রাত নটার কম নয়। আর শীতের নটা মানে পাড়াগাঁয়ের মাঝরাত। আবুলের মামি ছাড়া আর সবাই খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ফলে মামা-মামি বৈ আর কারোর সাথে আবুলের চেনাজানা হয়নি। আবুল যার সাথে ঘুমিয়েছে তার নাম আরমান। আবুলেরই বয়সী। রঙ ফর্সার দিকে। মাথায় প্রায় সমান। মুখের আদল অনেকটা রাখাইন নৃ-গোষ্ঠীর মতোন। চেনা-জানার পালা শেষ হলে আরমানকে সাথে নিয়ে দরজা খুলে ঘর থেকে উঠোনে বেরিয়ে এলো আবুল। চোখের পলকে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ঘরের ভিতরের সকল দীনতা তিরোহিত হলো কোন সুদূরে। সুসজ্জিতা নববধূটির মতো পাহাড়ি প্রকৃতি ঘোমটা খুলে সটান হাজির আবুলের দুই আঁখিপুটে। মাটির ঘর, টিনের ছাউনি। আটচালা, পুরনো। ঘরের সামনে নিকানো উঠোন। প্রশস্ত ও বর্গাকৃতির। উঠোনের চারপাশে এক প্রকার পাহাড়ি গুল্মের সীমানা প্রাচীর। শীতের রুক্ষতা গুল্মের শরীরে স্পষ্ট চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। পুবমুখী বাড়ির পূর্ব সীমানা মাঝ বরাবর একটি পায়ে চলা পথ উঠোনে এসে মিশেছে।পথটা চওড়ায় ন্যূনপক্ষে দু হাত। পথের দু ধারে এক প্রকারের গুল্মজাতীয় বৃক্ষ ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে।
শীতের সকল প্রয়াস ব্যর্থ করে নিয়ে এখনও অনেক পত্র বৃক্ষগুলো তাদের ছোট ছোট ডালে ধারণ করে একটি নান্দনিক তোরণের সৃষ্টি করেছে। উঠোন থেকে শুরু হয়ে দু ধারের বৃক্ষের সারি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানেই গ্রাম্য রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণে ধাবমান। যার উত্তর প্রান্ত ইস্টিশন এবং দক্ষিণ প্রান্ত পাহাড় আর টিলার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে আবুলের স্বপ্নের অরণ্যে লুকিয়েছে । আরমান আবুলকে এ রাস্তা দিয়ে কিছুটা পথ নিয়ে গেলে আবুল দেখতে পেলো একটি মাঝারি আকারের পুকুর। পুকুরের উত্তর পশ্চিম কোণে একটি পুরনো মসজিদ। মসজিদের সামনে একটি বিশাল আকারের কাঠবাদামের গাছ। দেখেই বুঝা যায় এ বৃক্ষের বয়স শতাধিক বছর। বৃক্ষটির ঠিক দক্ষিণ ধার ঘেঁষে একটি শান-বাঁধানো ঘাট। অতি প্রাচীন ও ভাঙাচোরা। সোপানগুলো শ্যাওলা ঢাকা। সাবধানে পা না দিলে পা পিছলে আলুর দম' হওয়া সুনিশ্চিত। এ পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরতি পথ ধরতে গিয়ে আবুল দেখে কুয়াশায় চারদিক ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। ঢেকে গেছে সূর্যের মুখ। ঠান্ডাও লাগছে ভীষণ। উত্তরে হিমেল হাওয়ায় হিহি কাঁপন ধরিয়েছে। দ্রুত পা চালিয়ে সাততাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলো তারা। গ্রাম্য কী সব পিঠেপুলি আর খেজুরের সিদ্ধ রসে সকালের নাস্তা সেরে, আরমানদের পাড়া দেখতে বেরিয়ে পড়লো আবুল।
এখন কুয়াশা অনেকটা কেটে গেছে, সূর্যের মুখ পরিষ্কার। রাস্তায় নেমেই বুঝলো টিলা কিংবা পাহাড় কেটে সমতল করে গড়ে তুলেছে এ বসতি। এখনো ধানি জমির মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা টিলাগুলো তাদের সুবর্ণ অতীতের কথা ঘোষণা করছে সগৌরবে। শীতের প্রকোপ আশপাশে পষ্ট ছাপ ফেলেছে। জমিগুলো শুকনো এবং শূন্য। টিলাগুলোর লতাগুল্ম শুকিয়ে জ্বালানি হয়ে গেছে। গাছগুলোও পত্রশূন্য । ঘাস শুকিয়ে খড়। মাঠের এবং পথের মাটি কেমন যেন লালচে রঙের। আরমানের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আবুল একটা টিলার সামনে এসে হাজির। আরমান বলল: “এই টিলাটা আমাদের এলাকার সবচেয়ে উঁচু টিলা। এটিতে বাবা 'পাইন্যাগুলা'র আবাদ করেছে। সুযোগ পেলে সামনের বর্ষায় এসো, দেখবে ক্যামনে ফলে।" পাহাড়ি এ ফলটা একটু কষা হলেও খেতে বেশ। পুষ্টিগুণও আছে। আবুল এই টিলায় চড়ার আবদার করলো। আর সব টিলার মতো পুরোটা মাটির ঢিবি নয় এটি।
পত্রশূন্য পাইন্যাগুলায় গাছগুলো মোটামুটি একটা আরণ্য ভাব এনেছে এখানে। টিলাটার মাঝ বরাবর একটি চিহ্ন নিয়মিত পায়ে হাঁটার সাক্ষ্য দিচ্ছে। আবুলেরাও এ পথ ধরলো। টিলাটার মাথায় ওঠার মুখে আবুল প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে থাকলো। আরমান ছিলো আবুলের পেছনে। সে কিছু বুঝতে না পেরে বলল: “কী রে, দাঁড়িয়ে গেলি কেন? চল্ না।” আবুলের মুখে রুচি নেই। সে কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আরেক কদম এগোলেই আবুলেরা টিলাটার চূড়ায় উঠে যাবে। তারপর শুরু হবে অবরোহণ । আরমান আবুলের জন্যে সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আবার আবুলকে ডিঙিয়ে যাবে সেটুকু জায়গাও নেই। আবুল অনেক কসরত করে নিজেকে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা দুটি গাছের ফাঁকে গুটিয়ে নিল, আরমান সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বলে: “উঃ, এই ব্যাপার। আমি বলি, কী না কী।” এমন সময় আরমানকে ধাক্কা দিয়ে জায়গা করে নিয়ে পাশ দিয়ে গটগট করে চলে গেলো যেন এক জীবন্ত অগ্নিবিম্ব। তাকে দেখে গড়গড় করে আরমান অনেক কিছুই বলে গেলো।
তার কিছুটা আবুলের কানে ঢুকলো আর অনেকটায় কান ঘেঁষে ইথারেই ঢেউ তুললো। আরমানের কথায় আবুল বুঝলো মেয়েটির নাম রৌশনি। আরমানদের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়া। বাবা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা নেই। বড় ভাইয়েরা ঢাকায় চাকরি-বাকরি ও পড়ালেখা করে। সংখ্যায় কজন, আরমান তা জানে না। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর স্বেচ্ছায় বদলি নিয়ে চাটগাঁ শহর থেকে এ পাহাড়ি ইস্কুলে এসেছেন। যেন স্বেচ্ছানির্বাসন। এমনিতে সজ্জন কিন্তু কারোর সাথে বড় একটা মেলামেশা করেন না। তবে দাম্ভিক নন। চাকরি আর বেশি দিন নেই। পৈতৃক নিবাস কুতুবদিয়া। বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে। সব কিছু বেচে দিয়ে একমাত্র মেয়েটিকে নিয়ে এই পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। শেষ ইচ্ছে এখানেই থেকে যাবেন। আরমানকে ভদ্রলোকের বেজায় পছন্দ। তার সাথে কথাবার্তা হয়। আর এসব কথাবার্তার ফাঁক-ফোকরে, তথ্যগুলো আরমান জেনেছে আরমানের বাবা নিজে দাঁড়িয়ে টিলার অপর পাশে প্রায় বিঘে দশেক আবাদি জমি মাস্টার মশায়কে কিনে দিয়েছেন। এক প্লটের জমি। এর এক কোনায় পাখির নীড়ের মতো ছোট্ট ছিমছাম একটি বাড়ি। তাতেই বাপ-বেটির বাস। আরমান কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে অনেক সময় তাঁর ছেলেদের ব্যাপারে জানতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি প্রতিবারেই চুপটি করে থেকেছেন।
রৌশনি ঠিক বাপের উল্টা। কথা বলে নাকে-মুখে। চাঞ্চল্যে শশককেও হার মানায়। কিছুতেই পরোয়া নেই। বাবা অন্তপ্রাণ আর বাবাতেই পূর্ণ যতি। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ভীষণ মেধাবী। এলাকার সকলেই তাকে চেনে ও জানে। তবে তাকে সকলেই ডাকে 'পাহাড়ি বিচ্ছুটি' বলে। আরমানের কথার মাঝখানে হঠাৎ আবুল বলে উঠলো: “আচ্ছা আরমান, মেয়েটিকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?” বিস্মিত আরমান পাল্টা প্রশ্ন করলো: "কেন?" ভীরু আবুল কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। দু চোখে নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল দেখতে দেখতে আরমানের পিছু পিছু হাটতে লাগলো। সূর্য যখন মাঝ আকাশে, হিম হিম উত্তুরে হাওয়া অনেকটা সহনীয় ঠিক তখনই আবুলেরা বাড়ির পথ ধরলো। ফিরতি পথে আর কোনো কথা হলো না। ধূলো উড়া লাল মাটির পাহাড়ি পথে শুকনো ঝোপ-ঝাড়, শুকিয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী, কোথাও ঝোপের আড়ালে বনমোরগ আর তার ছানা, শুকনো বনস্পতির ডালে বন-কপোত, উঁচু-নিচু টিলা, পাহাড়ের ঢালুতে জুম চাষের চিহ্ন, এবড়ো-খেবড়ো বন্ধ্যা পাহাড়ি জমি, একটি পোয়াতি সাদা গাভী- মন আর চোখ দিয়ে দেখছিলো আবুল। আর বেসুরা কণ্ঠে গুনগুন করছিলো:
গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
আমার মন ভুলায় রে।
ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে
ও যে আমায় ঘরের বাহির করে,
লুটিয়ে যায় ধুলায় রে পায়ে পায়ে পায়ে ধরে ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে কোনখানে কী দায় ঠেকাবে কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে ভেবেই না কুলায় রে। যায় রে কোন্ চুলায় কে ও যে কোন্ বাঁকে কী ধন দেখাবে। আবুলেরা আরো দু দিন আরমানদের বাড়িতে ছিলো। এ দু দিনে আবুল আরমানকে নিয়ে গোটা এলাকাটা আঁতিপাতি করে দেখেছে। দেখেছে পাহাড়ি প্রকৃতি আর জীবন। এখানকার মানুষগুলো অত্যন্ত সহজ-সরল। তবে এক কথার মানুষ এরা। কোনো কারণে খেপে গেলে খুন-খারাবি এদের জন্য পান্তা ভাত। এই দু দিনে আবুল রৌশনিদের কথা একটিবারও আরমানের কাছে পাড়েনি। সে কি লজ্জায়, নাকি সংকোচে কিংবা ভয়ে তা এখনো আবুল ভেবে দেখেনি। কিন্তু আবুলের মন একটি পলের জন্যেও বিস্মৃত হতে পারেনি সে মাহেন্দ্রক্ষণটি এখনও। আবুলের মন বলে: “আর একটি কদম না হয় সেও উঠতো, আমিও উঠতাম। তাতে যা হবার হতো। এতে জগৎসংসারের কী এমন ক্ষতি হতো? সূর্য ওঠা বন্ধ হয়ে যেতো? চাঁদ লজ্জায় মেঘের আড়ালে মুখ ডাকতো? গাছে গাছে ফুল ফুটতো না? পাখি ডাকতো না? নদীতে হতো না জোয়ার ভাটা? আকাশের সব নীল উধাও হয়ে যেতো? গেলে যেতো? কিন্তু অন্তত একটি বার আবুল তার হাতের স্পর্শ পেতো, পেতো অমন কুচকুচে কালো কুন্তলের অমিয় সৌরভ আর অগ্নিঝরা দু আঁখির উত্তপ্ত আগ্নেয় পরশ।” এখন আবুল রৌশনির কথা যখন ভাবে, তখন সে কিচ্ছুটি স্মৃতিতে ধরতে পারে না, স্মৃতি কেবলই তার সাথে লুকোচুরি খেলে, দেখা দিয়েও সে অদেখা থেকে যায়, ধরা দিয়েও থাকে অধরা। এখন আবুলের কাছে রৌশনি মানে ভরা ভাদরের আচমকা এক বিজলির ছটা, যার ঝলকে তার অঙ্গ নয় মনটাই পুড়ে ছাই।
তৃতীয় দিন সকাল সকাল আবুল ফিরতি পথে তাদের নানুবাড়ি ফিরে এলো। এবার কোনো কিছুতেই আবুলের না চোখ না মন লাগলো। ট্রেনের ভিতর-বাইরের কোনো কিছুই আবুলকে টানতে পারলো না। তার মন-মস্তিষ্ক একটা বিন্দুতেই আটকে থাকলো; যেখানে একটি অনত্যুচ্চ পাহাড় জঙ্গলে ঠাসা বরাবর একটি পায়ে চলা পথ, পাহাড়ের একদিক থেকে ওঠে অন্যদিকে নেমে গেছে। এ পথে কেবল একজনের পক্ষেই চলা সম্ভব। একজন এগারো-বারো বছরের কিশোর একদিক থেকে পাহাড়ের চূড়োর কাছাকাছি ওঠে দেখে, বিপরীত দিক থেকে একজন দশ-এগারো বছরের কিশোরী ঐ পথেই ওঠে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চোখের উপর চোখ, তারপর কেবল শূন্য, মহাশূন্য। আবুলের ভাবনা এখানে শেষ হয়ে যায়। সে আর কিছুই মনে করতে পারে না। কতো কতো আস্ত কবিতা তার দাঁড়ি-কমাসহ মুখস্থ, কিন্তু ঐ ক্ষণটির পুরোটাই কেমন তার মানসপটে ঝাপসা হয়ে ভাসে। মনে মনে সে হাজার বার প্রতিজ্ঞা করে, "না, জীবনের ঐ মুহূর্তটি স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে দেবো।” কিন্তু অর্ধশতবর্ষ ধরে তা এখনও তাকে তাড়া করে ফিরছে।
নানুবাড়িতে এসেও কোনো কিছুতেই মন বসে না আবুলের। সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও আবুলের মামির চোখে তার অস্বাভাবিক আচরণ ধরা পড়ে। তিনি প্রথমে আবুলের কপালে আর বুকে হাত দিয়ে শরীরের তাপ দেখেন। তারপর বলেন: “কী রে ভাগনে, তোকে আবার কোন পাহাড়ি ব্যাধিতে ধরলো? যাবি নাকি আরেকবার পুব-পাহাড়ের জংলা চূড়ায়?" অত্যন্ত সাদামাটা কথা। তারপরও এ কথা শুনে কেমন লজ্জাবনত মুখে এক ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে আবুল। আবুলের মামি যেমনি বিদূষী তেমনি কৌতুকপ্রিয়। তাঁর কৌতুকের খোঁড়া কখন কাকে বিধে তার ইয়ত্তা নেই। তারপরও আবুলের এমনি করে পলায়ন, আবুলের মামির চোখে যে লাগে তা বোকা আবুল বুঝতে পারে। সে থেকে আবুল তার মামির নাগাল এড়িয়ে চলে, আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে মায়ের কানে একটানা ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকে।
আবুল সদ্য সাইকেল চালাতে শিখেছে। উদ্দেশ্য শুকনো মৌসুমে সাইকেলে অনেক কম সময়ে ইস্কুলে যাওয়া যাবে। বাবা দেবেন না। মা কথা দিয়েছেন তার মামার কাছ থেকে একখানা সাইকেল নিয়ে দেবেন। আবুলের ঘ্যানর ঘ্যানর সইতে না পেরে আবুলের মা তাঁর এবারের নাইয়রের সময়সীমা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। সে বিদ্যুদবার আবুলের মামি যথারীতি জোহরের নামাজের পর ঘণ্টা-আধেক কোরআন পাঠ ও মুনাজাত করে রসুইঘরে গেলেন। ডাক পড়লো আবুলদের। দুপুরের খাবারের ডাক। খাবারের ব্যাপারে আবুলের মামি বড্ড হিসেবি। এখন অবশ্য আবুল বোঝে, তার নানুর রেখে যাওয়া জমির মাটি তো আর কামড়ে খাওয়া যায় না।
জমি থেকে যা পাওয়া যায় তাতে ভদ্রভাবে কোনো মতে বেঁচে থাকাই সম্ভব। কিন্তু ছোটো মামার হাতখরচ আর ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ তা আসবে কোত্থেকে? আবুলের মামির বাবার অনেক আছে। কিন্তু তাঁর আত্মসম্মানবোধ এতোই প্রবল যে তিনি কিছুতেই তাঁর বাবার নিকট হাত পাততে পারেন না। তিনি তাঁর সংসার, তাঁর সন্তান-সন্ততির জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। কিন্তু মৃত স্বামীর আত্মসম্মানে লাগে এমনটি কিছুতেই করতে প্রস্তুত নন। তাই তাঁকে সবকিছু এমনি করে হিসাব করে চলতে হতো।
আবুলের মা ও মামা খেতে এলেন আবুলদের পর । আবুলের কেন জানি ঘরের দিকে যেতে ইচ্ছে করলো না। যদিও সে জানে তার নানুবাড়িতে দুপুরের খাবারের পর পর যার যার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়াই নিয়ম। এ নিয়ম ছেলে-বুড়ো সকলের ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য । আবুল অবশ্য জানে না; কখন, কে. এ নিয়ম চালু করেছেন। তবে তারা দল বেঁধে অনেক সময় এ নিয়ম ভেঙেছে এবং যথারীতি মাথা পেতে নিয়েছে শাস্তি। আজ আবুল একা রসুইঘরের পিছনের সারি সারি নারিকেল গাছগুলোর ছায়ায় বসে বালিতে আঁকিবুকি খেলছে। হঠাৎ আবুলের কানে গেল তার মায়ের কথা। আবুলের মা সাধারণত তাঁর ভাই কিংবা ভাইয়ের বৌয়ের নিকট কোনো আবদারই করতেন না। কারণ আবুলের মামাদের সংসারের কোনো কিছুই তাঁর অজানা ছিলো না। অধিকন্তু আবুলের মামি এবং মামা আবুলের মায়ের অনেক ছোটো আর “ছোটদের কাছে বড়দের কিছু চাইতে নেই, দিতে আছে” এটাই ছিলো আবুলের মায়ের বিশ্বাস। তবে আবুলের পড়ালেখার ব্যাপারে আবুলের ব্যবসায়ী বাপের চেয়ে তাঁর শিক্ষিত ভাইও বিদুষী প্রতিবছর উপরই ভরসা ছিলো বেশি। ইস্কুলে যাতায়াতের জন্য সাইকেল আবুলের সখ নয়, ছিলো প্রয়োজন। তাই অসংকোচে তিনি তাঁর আহাররত ছোটো ভাইটিকে বললেন: “ ও ভাই, তোকে একটা কথা বলবো, মনে কিছু নিস না। বৌও আছিস, তুইও শোন। আবুলের ইস্কুল বেজায় দূরে। অতো দূরে যেতে ছেলেটার আমার কষ্ট হয়। তোরা তো জানিস, সে লেখাপড়ায় আর দশজনের চেয়ে অনেক ভালো। আরও একটু মন দিলে সে অনেক ভালো করবে। সে তার বড় মামার মাথা পেয়েছে। তার বাবাকে বলেছিলাম, তিনি সরাসরি না করে দিয়েছেন । তোরা যদি তাকে একটা সাইকেল কিনে দিতিস?" এরপর তার মায়ের কণ্ঠ আবুল আর শুনতে পেলো না।
তার মামার বাজখাই গলার স্বরের নিচে তা চাপা পড়ে গেল। আবুলের মামা তার স্বভাবসিদ্ধ ভরাট কণ্ঠে বললেন: “বুবু তুইও না একটা, এমনিতেই তোর ছেলেটা দিনকে দিন বান্দর হয়ে যাচ্ছে, তার উপর সাইকেল পেলে আর দেখতে হবে না, বরং তুই তাকে বলিস তার বাপের দু কাঁধে দু পা দিয়ে সাইকেল চালাতে।" আবুল আর শুনতে পারলো না। সে এক ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো। সে দিন সন্ধ্যায় আবুলেরা নিজ বাড়িতে ফিরে এলো। বয়সে কিশোর হলেও তার মামার বিদ্রূপমাখা কথাগুলো অনেক দিন আবুলকে অশরীরী আত্মার মতো তাড়া করে ফিরেছে। তবে এখন আবুল ভাবে অন্য কথা। বয়স্ক আবুলের মনে হয়, তার ছোটো মামা নিজের অক্ষমতা ঢাকার জন্যেই তার মাকে অমন কথা বলেছিলেন। আবুলের জীবন একট অতি-স্বাধীন অসমপর্বের অপায়ে পঙ্ক্তি। এর না অতি পর্বের মাত্রা, না ভাঙা পর্বের মাত্রা, কোনো কিছুই ঠিকঠাক নেই। আর মূল পর্ব? যার মূলই নেই তার আবার মূলপর্ব? অতএব এখানে আগেরটা ঠাঁই নেবে, পরে আর পরেরটা আগে। মূলের সাক্ষাৎ হতে পারে আকস্মিক। হয়তো এক্কেবারে গুরুত্বহীন কথাটা লেখা হয়ে গেছে কয়েক বার। ভাবতেই বিরক্তির উদ্রেক হয়। কিন্তু কী করা?
দিন যায়, দিন আসে। গড়িয়ে চলে সময়। দিনে দিনে আবুলের বয়স বাড়ে। আবুল আরও আবুল হয়। শরীরে আসে পরিবর্তন। কিন্তু বোধ-বুদ্ধি থেকে যায় অর্বাচীন। শ্রেণি বদলাতে বদলাতে যে বছর আবুল অষ্টম শ্রেণিতে সে বছরই এক সাথে সংঘটিত হয় অনেকগুলো ঐতিহাসিক ঘটনা। যার অনেকটা অম্ল, কতকটা মধুর। নির্বাচনে বাঙালি দেখিয়ে দিলো: “জ্বলেপুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।” পশ্চিমারা অবাক হলো, তবু থেমে থাকলো না। এলো ৭ মার্চ। কাঁপলো রেসকোর্স, কাঁপলো বিশ্ববিবেক। কিন্তু সতর্ক হলো বিশ্ব বেহায়া। তারা ধরলো ষড়যন্ত্রের গোপন পথ। রাতের অন্ধকারে সশস্ত্র হানাদার বাহিনী ঢাকা মহানগরকে পরিণত করে বিভীষিকা নগরে; বুড়িগঙ্গা রক্ত-স্রোতের এক নদীতে পরিণত হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে খচিত হয় একটি কালো রাত, '২৫ মার্চ। ধ্বংসলীলার এ ঢেউয়ের ধাক্কা দেশের প্রান্তিক গ্রামগুলোতে এসেও লাগে। বাদ যায় না আবুলদের গ্রামও। একটু কান পাতলেই শোনা যেতো গুলির শব্দ, আর বাতাসে ভাসতো বারুদের গন্ধ। ধোঁয়া আর আগুন বাঙালির আটপৌরে জীবনের নিত্যদিনের প্রাত্যহিক সঙ্গী। কখন কে, কোন ফাঁকে দেশ ছাড়ছে তা বোঝার জো ছিলো না। ঘরের পাশের প্রতিবেশীর খোঁজ রাখাও সে সময় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। তবে এই অবস্থা বেশি দিন থাকলো না। একদিন আগেও ১২ ১৩ বছরের যে ছেলেটি ভালো করে তার হাফ-প্যান্টটাও পরতে পারতো না দুষ্টু বন্ধুরা টান মেরে পাছার প্যান্ট পায়ের গোড়ালিতে নামিয়ে আনতো,
এখন সে দস্তুরমতো সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। হাতে অস্ত্র, চোখে আগুনের ফুলকি, বুকে হিম্মত, মুখে দেশমাতৃকার স্তুতি। দশটা প্রশ্ন করলে একটারও জবাব পাওয়া যায় না। মুখে একটিই জিকির আমাদের আরো লোক লাগবে। এই গ্রামইে তার ঘর। বাবা নেই, মা তখনও বেঁচে। কিন্তু সে দেখা করবে না। দিনে তাদের দেখা মেলে, রাতের হদিস আবুলেরা জানে না, ছেলেটাকে অস্ত্র হাতে দেখলেই আবুলের কেমন লজ্জা লাগে। ভাবে: “আমি তো গায়ে গতরে ছেলেটার চেয়ে কম না। তবে আমি কেন মায়ের আঁচলের তলায় চুপটি করে বসে আছি? এ দেশের আলোতে কি আমি পথ চলি না, এ দেশের বাতাস কি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে না, এ দেশের মাটি কি আমাকে তার বুকে আশ্রয় দেয় না, এ দেশের আকাশ কি আমাকে দেখায় না অসীমের স্বপ্ন? তবে কেন, কেন আমার এই পালিয়ে বাঁচা?” আবুল আড়মোড়া ভেঙে জাগলো। “না, আর বিলম্ব নয়, আজ রাতেই পালাতে হবে।” আবুলের যেমনি ভাবনা, তেমনি কাজ। গ্রামের এক বড় ভাইয়ের সাথে তার পরিচয় আছে। সকলেই তাঁকে 'নেতা' বলে ডাকে। আবুল থাকতো তাদের বাংলো ঘরে। অনেকটা একা। এটি তার পড়ার ঘরও বটে। এশার নামাজের পর আবুলের মা বড় একটা আবুলের পড়ার ঘরে আসতেন না। এ সুযোগটাই আবুল নিলো। আবুল তার মাকে লিখলো "মা, তোমার ছেলে চললো। শত্রু মেরে দেশের স্বাধীনতা নিয়ে তবেই ফিরবে।
তুমি তাকে দোয়া করো- সে যেন জয়ী হতে পারে।" চিরকুটটি একটি বই চাপা দিয়ে রেখে আবুল তার স্কুলব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে চুপে চুপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। ব্যাগটি সে সকাল সকাল গুছিয়ে রেখেছিল। সামান্যই জিনিসপত্র তার। কয়েকটি কাপড়-চোপড়, খানকয়েক বিদ্যুৎ মিত্রের রহস্যোপন্যাস। আগে-ভাগে সব ঠিকঠাক করা ছিলো। মনসার টেকের আগে বড় রাস্তার মোড়ে, জংলা পুকুরটার পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় বিশাল বাঁশঝাড়টি মধ্যখানের এইটুকু জায়গায় সকলে ঠাসাঠাসি করে বসে আছে। অপেক্ষা আবুলের। আবুল এলে তাকে রাস্তা থেকে একজন অচেনা যুবক পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। কারো মুখে রা নেই। আবুল অকুস্থলে পৌঁছালে বাঁশঝাড়ের মধ্যখান থেকে আরেকজন লম্বামতো সুদর্শন যুবক আবুলের দিকে এগিয়ে এলো। আর আবুলকে যে জন রাস্তা থেকে এ পর্যন্ত নিয়ে এলো, সে রিমোট চালিত যন্ত্রমানবের মতো জটলার এক কোনায় বসে পড়লো চুপচাপ। আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ।
কোথাও একখণ্ড মেঘও নেই। আশপাশ সুনসান। বাঁশঝাড় এবং গাছপালার ছায়া এখানে কিঞ্চিৎ আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে। ওঠে আসা যুবকটি আবুলের চারপাশ একবার প্রদক্ষিণ করে এলো। তার চৌম্বকীয় দৃষ্টি দিয়ে যেন আবুলের ভিতর পর্যন্ত অনুপুঙ্খ দেখে নিলো একদৃষ্টে। তারপর আবুলকে লক্ষ করে বললো: “দেখো, এর নাম নাছির। পড়ে নবম শ্রেণিতে। বাড়ি চরকানাই । আজ সকালে হানাদারেরা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এদের বাড়ি আক্রমণ করেছে। এর বাবা স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অতীব সজ্জন। এলাকার সকলেই তাকে মান্য গণ্য করে। হানাদারদের ধারণা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এঁর যোগাযোগ আছে। তাই তারা এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান নিতে। তাদের সকল অপপ্রয়াস ব্যর্থ হলে, মাস্টার মশাইকে তাঁরই বাড়ির সামনের আম গাছের ডালে ঝুলিয়ে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়, তাঁর যুবতী মেয়েটির উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে তাকেও খুন করে, তাঁর স্ত্রীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যখন মারছিল তখনও তাঁর কোলের শিশুটি মায়ের স্তন পান করছিলো নিশ্চিন্তে। কিন্তু নরাধমেরা এ অবোধ শিশুটিকেও ছাড়লো না। বেয়নেটের একটি খোঁচায় মানব-সভ্যতার ইতিহাসে এঁকে দিলো এক অমোচনীয় কালো দাগ । আর চলচ্চিত্র দেখার মতো নীরবে বাঁশঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজ পরিবারের এ আত্মাহুতি দেখেছে নাছির।” কথাগুলো তিনি বলে গেলেন যন্ত্রের মতো কিন্তু তাঁর চোখের পাতা ভিজিয়ে অবিরল ধারায় গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। তিনি নিষ্কম্প কন্ঠে বলেই চললেন: “লোক আমাদের চাই-ই।
অনেক অনেক লোক। তবে মনে রাখতে হবে, লোক চাই কাজ উপযোগী। আমাদের কাজের যেমন রকমফের আছে, তেমনি আছে যোগ্যতার।” এরপর আবার তিনি আবুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আবুল, আমি তোমার ইমোশনকে স্যালুট করি। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পক্ষে তুমি যথেষ্ট ছোটো। তোমাকে আমরা আজ থেকে আমাদের ইউনিটের সদস্য করে নিলাম। তুমি এখন ঘরে ফিরে যাও। তোমার কাজ এখানেই। প্রয়োজনে ডাক পাবে। তৈরি থেকো। আরেকটি কথা, তোমার আজকের কথা কাউকে বলো না। এমনকি নিজেকেও না। মনে রেখো, আমাদের একটি ছোট্ট ভুলও দেশের স্বাধীনতাকে সুদূরপরাহত করতে পারে।" যুবকটির কথা থামল। কিন্তু তখনও তা আবুলের কানে অনুরণিত হচ্ছিল। আবুলের মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গ থেকেই কোনো দেবদূত এইসব দেববার্তা এতক্ষণ আবুলকে শোনালো। মন্ত্রমুগ্ধ আবুল নীরবে ঘরে ফিরে এলো। পথের দূরত্ব রাতের ভয় কিছুই সে অনুভব করতে পারলো না। কখন যে এতটুকু পথ হেঁটে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়েছিলো এখনো তা মনে করতে পারে না। কেবল এটুকুই মনে পড়ে, মায়ের হাতে পড়ার আগে, মাকে লেখা চিরকুটটা আবুল ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেছিলো।
পরদিন সকালে আবুলের ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে। আবুলের মা কয়েকবার এসে দেখে গেছেন কিন্তু তাকে জাগাননি। ঘুম ভাঙতেই আবুল তার পেটে ছুঁচোর ভীষণ লক্ষরাক্ষ টের পেয়ে ছুটলো হেঁশেলে। আবুলের মা আবুলকে দেখেই বুঝলেন ছেলে তাঁর কী চায়। তখন আবুলদের বাড়িতে সকালের নাস্তা বলতে পাস্তা আর তরকারিকে বোঝাতো। আবুল তার শৈশব থেকেই পান্তা খেতো না। খেতো ভালো কোনো তরকারি দিয়ে গরম ভাত। তবে যে দিন গরুর মাংসের ঝোল থাকতো, সেদিন তার চিকন চালের পান্তা চায়ই চায়। ভাতের গ্রাসে চামুচ দিয়ে গরুর মাংসের ঝোল ঢেলে খাওয়া, আবুলের ভীষণ পছন্দের ছিলো। চায়ের প্রচলন তখন খুব একটা ছিলো না। বিস্কুট ছিলো দস্তুরমতো বড়লোকি খাবার। তবে আবুলের বাবা ঘরে থাকলে আবুলদের ঘরে দিনে বেশ কবার চা হতো। এর ছিটেফোঁটা আবুলেরাও পেতো। খাবার ভালো না হলে আবুল পুরোদস্তুর দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিতো। থালা ভাঙতো, পানির গ্লাস ছুড়ে ঘরের বাইরে ফেলে দিতো, ভাত-তরকারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলতো। কিন্তু সেদিন তার মনে ছিলো নববসন্তের ফুরফুরে হাওয়া, চোখে ছিলো দৃষ্টি-শেষের সুনীল আকাশ। অপার্থিব কোনো আহ্বানের জন্য তার অপেক্ষার কাছে জগতের আর সব অতি তুচ্ছ বলে বোধ হচ্ছিল। তাই কী খেলো আর কী খেলো না, তার দিকে তার কোনো খেয়ালই ছিলো না। কিন্তু মা যখন তাকে বললেন: “বাবা, রাস্তার দিকে যাসনে, শুনছি চেয়ারম্যানবাড়িতে মিলিটারিরা আস্তানা গেড়েছে। তুই বরং চোরাবিলের মাঝখানে মনসাপুকুরের ঐখানে চলে যা।
দুপুরে এসে খেয়ে যাস। এখন আর বাড়িঘর নিরাপদ নয়।" আবুল তার মায়ের কথা মন দিয়ে শুনলো। হাতদুটো ক্ষোভে আর অভিমানে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। কেবল মনে মনে ভাবলো: “সত্যিই কি আমি খুব ছোটো?” আবুলদের গ্রামটা বড় রাস্তার পাশে। যদিও পুরো এলাকায় একজনও রাজাকার নেই। শান্তি কমিটিও গঠিত হয়নি। তবু গোটা দেশের নারকীয় হাল দেখে আবুলদের গ্রামের লোকেরাও সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকে। কখন কী হয় না, কী হয়। কেউ সারাটা দিন কাটিয়ে দেয় খালে বিলে। আর কেউ কেউ চলে গেছে দূর-দূরান্তের আত্মীয়ের বাড়িতে। দেখতে দেখতেই দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ যোগাতে মুষ্টি চাল সংগ্রহ করা, কয়েকটা চিরকুট এর-ওর কাছে পৌঁছে দেওয়া বৈ যুদ্ধকালীন সময়ে আবুলকে আর কিছুই করতে হলো না। এখন আবার যথারীতি ইস্কুলে যাওয়া, সকাল ও সন্ধ্যায় পাঠাভ্যাস করা, বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলতে যাওয়া এ অত্যন্ত সাধারণ নিয়মের মধ্যে আবুলের জীবন বাঁধা পড়ে গেলো। আবুলদের পশ্চিমের বাড়ির এক বড় ভাই। নাম হারুন। ভীষণ চৌকস। আবুলনের ইস্কুলেরই দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম সারির ছাত্র। এমন মিষ্টি মুখের ছেলে বড় একটা দেখা যায় না। একটু খর্বকায় ছেলেটি ফুটবল খেলার মাঠে যেন জীবন্ত আগুনের গোলা। আবুলদের গ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্দেশ্যে সর্ব প্রথম ঘর ছাড়েন তিনি।
প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরতি পথেই শহীদ হয়ে গেলেন। স্বাধীনতার পর গ্রামের যুবক-কিশোররা মিলে তাঁর স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন 'শহীদ হারুন স্মৃতি সংঘ'। পাঠাগার এ-স্মৃতিসংঘের একট অঙ্গ। আবুলের অনেক ভুলের মধ্যে ফুল হয়ে আছে, 'বই পড়া' ও 'বই কেনা'। শহীদ হারুন স্মৃতি পাঠাগারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বই ডোনেট করেছিলো আবুল। তবে অনেক চেষ্টা করেও এ পবিত্র প্রতিষ্ঠানকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা গেলো না। মাঝখানে আবুল খোয়ালো তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ। ভাবলেই আবুলের বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। কী ভাবছিলো, আর কী হলো। কেমন করে যেন পালটে গেলো চেনা মানুষগুলো, যুদ্ধের সময় একটা নাম আবুলরা প্রতিদিন শুনতো। নামটা গোটা এলাকায় একটা জীবন্ত বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিলো। রাজাকার মৌলানা জাকের। বোয়ালখালীর গোমদণ্ডী গ্রামের বাসিন্দা। কথিত আছে, দিনে অন্তত একজনকে খুন করতে না পারলে সে জল-আহার গ্রহণ করতে না। পাখির মতো মানুষ শিকার।
করতো সে। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বয়ং তার জন্মদাত্রী মা তাকে এ হীন কাজে বিরত রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক বার তার হাতে প্রহৃত হয়েছেন। যুদ্ধের আগে পরে অনেকেই তাদের পরিচয় পাল্টে ফেললেও মৌলানা জাকির এ দুনিয়াতেই তার পাপের শাস্তি কিছুটাও হলেও ভোগ করেছে। যুদ্ধের পর পর সে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। তারপর এলাকার লোকের অনুরোধে তাকে আগাগোড়া শিকল দিয়ে বেঁধে, মাথা মুড়িয়ে, গলায় মানুষের কংকালের মালা পরিয়ে গোমদণ্ডী ইস্টিশনের পাশে, সরকারি খাদ্য গুদামের একতলা পাকা দালানের ছাদে সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে দাঁড় করিয়ে রাখতো। গোটা দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম যেন অকুস্থলে ভেঙে পড়তো। দু ঘণ্টার জন্য সাইকেল ভাড়া করে আবুলও গিয়েছিলো মানুষ নামের এ ঘৃণ্য জানোয়রটাকে দেখতে। নিজের ক্ষোভ, ধরে রাখতে না পেরে বোকা আবুল তার সদ্য কেনা জুতোর এক পাটি ছুড়ে মেরেছিলো লোকটিকে। আর নিজে অন্তত মাস দুয়েক খালি পায়ে চলাফেরা করেছিলো। অবশ্য আবুলের মা এ কথা শুনে তার লম্বা কালো চুলে পরম আদরে বিলি কেটে দিয়েছিলো। এবং পরের দিনেই একই রকমের একজোড়া নতুন জুতা আবুল তার পড়ার ঘরে দেখতে পেলো।
যুদ্ধজয়ের পর আবুলের মতো বোকা লোকেরা ভেবেছিলো এবার কেল্লাফতে। বইপত্রে পড়া সোনার বাংলা এবার বাংলার লোকেরা বাস্তবে গড়ে তুলবে । হাতে হাত ধরে সকলে মিলে-মিশে হবে একাকার। জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আবুলরা হবে এক অভিন্ন সত্তা। কিন্তু কী দেখলো? দেখলো ঠিক উল্টোটা। দেশের কথা ভাববার ফুরসতই কেউ পেলো না। সকলেই ছুটলো সোনার হরিণের পিছনে। কে ধরবে আগে সে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মাতলো গোটা জাতি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো শিক্ষা বিভাগ। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত হলো। আস্ত বই বেঞ্চিতে রেখে গণটুকাটুকির উৎসবে মাতলো দেশের ভবিষ্যৎ। বছর ঘুরতেই পেলো না, কেবল পোশাকটা পাল্টে মঞ্চটা দখল করলো পুরানো সব চিহ্নিত মুখ। আবুলরাও সুযোগটা নিলো। বই রেখে হাতে তুলে নিল যুদ্ধে ব্যবহৃত পর্যাপ্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অস্ত্রের কোনোটা না কোনোটা। দেশে দেখা দিলো অন্য রকম অস্থিরতা। আবুলের বাবার আয়-রোজগারও কমে গেল হঠাৎ। আবুলের পারিবারিক গিটও কেমন যেন আলগা হয়ে গেলো। আগে সাঁঝ ডাকতেই ঘরে ছুটতো আবুলেরা। আর এখন সাঁঝ লাগলেই ঘর ছাড়ে তারা। স্বাধীনতার এমন কী জাদু নিয়ে এলো, যে পরীক্ষায় বসলেই পাস। তাও আবার প্রথম শ্রেণিতে। আবুলের মতো বোকা বোকা শিক্ষার্থীরা বইপত্র একটু-আধটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেও, যারা বিচক্ষণ(?) তারা ও-কাজের ধারেকাছেও গেলো না। স্বাধীনতার আগে আবুলদের দু-দুটি এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেলো। এবার আবুলদের পালা । কেন্দ্র নিজ ইস্কুল । গত পরীক্ষায় এ কেন্দ্রে এক মজার ঘটনা ঘটেছিলো, যা মনে হলে এখনও আবুল নিজ মনে একটু হেসে নেয়। 'মিনু' নামের একজন ছাত্রী, এলাকার এক প্রভাবশালীর মেয়ে, প্রতিবেশী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় বসেছেন।
প্রভাবশালীর নেক নজরে পড়ার জন্য গোটা এলাকার সুযোগসন্ধানীরা মিনুকে সাহায্য করার জন্যে ভেঙে পড়লো পরীক্ষা কেন্দ্রে। তাদেরই কারো পাঠানো একটা 'চিরকুট' মিনুর হাতে পড়ে। ‘মিনু তা তাঁর উত্তরপত্রে হবহু লিখে দিয়ে আসেন। পরীক্ষায় মিনু ভালো ফলাফল যে করেছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একজন বেরসিক সাংবাদিক কী করে যে মিনুর একটা উত্তরপত্রে লেখা উত্তরে 'তুমি লিখে মিনুকে দিও' এ কথাটাও যে লেখা ছিলো তা জানতে পারেন এবং ফাঁস করে দেন। দীর্ঘদিন এ কথাটা এলাকার লোকের মুখে মুখে ছিলো।
নবম শ্রেণিতেই তখনও বিভাগ নির্ধারিত হয়ে যেতো। আবুল নিয়ে ছিলো ‘বাণিজ্য' বিভাগ। এই বিভাগে 'আবুল' নামে দুজন ছাত্র ছিলো। কী করে যেন নিবন্ধনে আবুলের বাবার নামে অন্য আবুলের বাবার নাম এসে গিয়েছিলো, ইকবাল স্যার না থাকলে অন্তত শিক্ষা সনদে আবুলকে অন্যের বাবার নাম বয়ে বেড়াতে হতো অদ্যাবধি, কেননা তখন আবুলদের শিক্ষা বোর্ড ছিলো কুমিল্লা । অতো দূরে গিয়ে নাম পরিবর্তনের ঝক্কি আবুল নিতে পারতো না। যথাসময়ে আবুল এসএসসি পরীক্ষায় বসলো। প্রস্তুতি ছিলো মাঝারি। তারপরও কেন জানি প্রবেশপত্র বৈ অন্য কোনো রকমের অতিরিক্ত কাগজপত্র সে সাথে নিতে পারলো না। আসন নিয়ে শের আলী নামের এক সহপাঠীর সাথে পিয়াসের একটু গণ্ডগোল ছাড়া আবুল ভালোভাবেই পরীক্ষা। শেষ করলো। পিয়াস শের আলীকে তার নির্ধারিত আসন থেকে তুলে দিয়ে আবুলের পিছনের আসনে বসেই সবগুলো পরীক্ষা দিয়েছিলো।
তখন কলেজে ভর্তি এতোটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিলো না। তাই এসএসসি পরীক্ষার পর পরীক্ষার্থীদের মেলা অবসর। শুয়ে-বসে, হেসে-খেলেই পরীক্ষার্থীরা এই সময়টা কাটিয়ে দিতো। আবার অনেকেরই পড়ালেখায় এখানেই হতো পূর্ণযতি। ফলাফলের অপেক্ষা না করে তারা চাকরি-বাকরির তদবিরে লেগে যেতো। আবুলের এসব চিন্তা ছিলো না। তাই সে এ সময়ের পুরোটায় লাগালো অধ্যয়নে। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় পুরোটাই আবুল শেষ করে ফেলেছে। এই অবসরে আবুলের ইচ্ছে কিছু ইতিহাস শ্রেণির বই পড়বে। 'ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি', 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর', 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন' বইগুলো পড়ার ভীষণ ইচ্ছে আবুলের। অবশ্য দাবাটা ভালো করে রপ্ত করার একটা গোপন বাসনাও ছিলো। আবুলদের প্রতিবেশী গ্রামের বছির নামের একজন ব্যক্তি তখন 'মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড কুমিল্লার বৃত্তি-বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলেন। এলাকার প্রায় সব কজন পরীক্ষার্থীর ফলাফল তিনি পত্রযোগে আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পাঠানো তালিকার 'পাস' কিংবা 'ফেল' কোথাও আবুল ও পিয়াসের নাম ছিলো না। ফলে এলাকায় ছড়িয়ে গেল এবারের এসএসসি পরীক্ষা আবুল এবং পিয়াস ফেল করেছে। কেননা তাঁর পাঠানো তালিকায় ফেলের কোনো কলামই ছিলো না। আবুল ও পিয়াস ছাড়া এলাকার সব বিভাগে সব কজন পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর পাসের তালিকায় ছিলো। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কটুকাটব্য করতে লাগলো।
পিয়াস এসবের কোনো কিছুই গায়ে না মাখলেও, আবুলের কিন্তু এলাকায় মুখ দেখাবার জো থাকলো না। অনেকেই তো মুখের উপর বলে বসলো: “ইস্কুলের টুল-টেবিল পর্যন্ত পাস করে গেছে। আমার কুকুরটাকে পরীক্ষায় বসালে সেও অন্তত দ্বিতীয় বিভাগে উতরে যেতো। আমি হলে গলায় কলসি বেঁধে জলে ডুবে মরতাম, তবু কাউকে এ পোড়া মুখ দেখাতাম না। ছিঃ এমন বেহায়াও থাকে? তাও আবার নাকি ভালো ছেলে।” এদের অমন কথায় আবুলের ভীষণ কষ্ট লাগতো। কখনও কখনও প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগতো আত্মহননের। কিন্তু অসহায় আবুল কিচ্ছুটি করতে পারতো না। কেবল কান-হাত চাপা দিয়ে দ্রুত ঐ স্থান ত্যাগ করতো। সপ্তাহখানেকের মাথায় সরকারিভাবে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো। তখন প্রান্তিক এলাকায় ঘোষণার অনেক পরে ফলাফল পৌঁছাতো। তবে চট্টগ্রাম থেকে তখনও 'আজাদী' পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকায় আবুলদের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিলো। ফল প্রকাশের পরের দিনই আবুল অনেক কষ্টে একখানা পত্রিকা সংগ্রহ করে। এবং তাতে পিয়াসের রোল নম্বর দ্বিতীয় বিভাগে, আর আবুলের রোল নম্বর তাদের ইস্কুল থেকে যে কজন বাণিজ্য বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়েছে তাদের তালিকার সবার উপরে দেখতে পেলো।
পরীক্ষার ফল হাতে পেয়ে আবুল তার মামা-মামিকে সালাম করার জন্যে মামাবাড়ি গেলো। আবুলের ভালো ফলাফলে তার মামি খুশি হয়ে বললেনঃ “আর একটু ভালো নার্সিং পেলে তুই বোর্ডে দশজনের মধ্যে থাকতিস। আমারও তো মন্দ কপাল, ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারলাম না।” মামা বাড়ি ছিলেন না, তাই আবুলের তাঁকে সালাম করাও হলো না। আবার
মামাকে সালাম না করে ফিরেও যাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা আবুলের অপেক্ষার পালা। মিজান এখন কমার্স কলেজের ছাত্রাবাসে, কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সে। আবুলেরও ইচ্ছা কমার্স কলেজে ভর্তি হওয়া, কিন্তু তার জন্যে মামার মতামত প্রয়োজন। সে মতামতের অপেক্ষায় আবুল। আবুলের মামা খেতে আসলেন। কোনো কথা পাড়তে হলে আবুলের মামি তার মামাকে সাধারণত ভাত খাওয়ার সময় পাড়তেন। এ কথা আবুলের জানা ছিলো। তাই তার মামা খাওয়ার জন্যে যখন হেঁসেলে ঢুকলেন, তখন আবুলও হেঁসেলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার কাঁঠালতলায় চুপটি করে বসে থাকলো। উদ্দেশ্য মামার কথা শোনা। আবুলের মামির মুখে তার রেজাল্ট শুনে আবুলের মামা কোনো রকমের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। কেবল তাঁর কাছে জানতে চাইলেন: “আবুলের হাতের লেখা কী রকম?” অনেকটা বিস্মিত স্বরে আবুলের মামি বললেন: “তার হাতের লেখা আমি দেখেছি। ভারী চমৎকার। কিন্তু কেন?” আবুলের মামা, তার মামির কথা কানে নিলেন কিনা তা আবুল বুঝতে পারলো না। সে কেবল শুনলো তার মামা বলে যাচ্ছেন: “আমি মুবিনকে বলে রেখেছি, সে সোনালী ব্যাংক, পটিয়া শাখার ম্যানেজার। তার একজন শিক্ষানবিশ ক্যাশ-সহকারী প্রয়োজন।
আবুলের হাতের লেখা পছন্দ হলে সরাসরি নিয়োগ। আসছে মাসের এক তারিখ একটি দরখাস্ত নিয়ে আবুলকে আসতে বলো।” এরপরের কথা শোনার জন্য আবুল আর অপেক্ষা করলো না। তার মনে হলো কোনো আততায়ী পিছন থেকে এসে অকস্মাৎ তার মাথায় ভীষণ জোরে লাঠি বসিয়েছে। সে এক ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে উঠলো। সে কিছুতেই ভাবতে পারছিলো না, মামা তার জন্য চাকরি ঠিক করেছে। সেদিনই আবুল মনে মনে শপথ করলো: “প্রয়োজন ভিক্ষা করবো। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে মামার সামনে আসবো। নচেৎ নয়।” আবুল অবশ্য এ শপথ রক্ষা করতে পারেনি। জীবিত না হলেও, তার মৃত মামাকে এমএ ডিগ্রি অর্জনের পূর্বে দেখতে বাধ্য হয়েছিলো। নির্মম নিয়তির হাতে হেরে গিয়েছিলো আবুল। সেদিন অবশ্য আবুল সরাসরি বাড়ি চলে এসেছিলো। তবে এ কথা সে কোনো দিন তার মাকে জানতে দেয়নি।
আবুল কমার্স কলেজ থেকে ভর্তি ফরম নিয়ে তা যথারীতি পূরণ করে জমা দিয়েছিলো। তখন কমার্স কলেজ বলতে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদস্থ সরকারি কমার্স কলেজকে বুঝানো হতো। অবশ্য এখনও তাই। মিজান তো এ কলেজে ছিলোই, পরন্তু আবুলের আলম মামাও তখন কমার্স কলেজের অত্যন্ত জনপ্রিয় সিনিয়র ছাত্র। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যে ছাত্র-শিক্ষক সকলেই ছিলেন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। তিনি একটা কথা বললে কলেজ কর্তৃপক্ষ তা খুব একটা ফেলতেন না । কমার্স কলেজে আবুলের ভর্তি প্রায় নিশ্চিত ছিলো। সে সময় যার কথা কমার্স কলেজে 'শেষ কথা' বলে বিবেচিত হতো, তিনি হলেন 'এ আর চৌধুরী স্যার'। পটিয়ার গর্ব এই ব্যক্তিত্বও হাবিলাস দ্বীপ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মিজানের সুবাদে তিনি আবুলকে জানতেন। তিনি তো সরাসরি বলেই দিলেন: "ভর্তি পরীক্ষা যা-ই হোক, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও টাকা-পয়সা নিয়ে ভর্তির দিন উপস্থিত থেকো, আমি ভর্তি করিয়ে দেবো।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবুলের কমার্স কলেজে পড়া হলো না । ভর্তি পরীক্ষায় সে প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলো। সে থাকবে কোথায়, খাবে কী এ প্রশ্নের নিরসন না হওয়া, আবুলের মায়ের আবুলকে ডাক্তার করার বাসনা, আবুলের বয়ঃসন্ধিকালের স্বাভাবিক চাপল্য—সব মিলে ভর্তির ব্যাপারে এক ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। অবশেষে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মোজাহেরের হাত ধরে হুলাইন ছালের নূর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলো আবুল । তখন এ কলেজের রমরমা অবস্থা। ফলাফলও খুব একটা ফেলনা নয়। শিক্ষকদের অনেকেই ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের বরণীয় ব্যক্তিত্ব।
আবুলদের সময় একাদশ বিজ্ঞান শ্রেণির বাংলা ভার্সনের কোনো গ্রন্থ ছিলো না। পরীক্ষাও দিতে হতো ইংরেজি মাধ্যমে। বাংলাদেশি লেখকদের কোনো গ্রন্থও পাওয়া যেতো না। তার উপর আবুল গণিতটা খুব ভালো বুঝলেও ইংরেজিতে ছিলো কাঁচা। ফলে ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি, বায়োলোজির মতো বিষয়ের অনেক ক্ষেত্রে পাঠোদ্ধারও তার পক্ষে সম্ভব হতো না। ফলে আবুল ধীরে ধীরে অধ্যয়নে অনেকটা অমনোযোগী হয়ে পড়ে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মোজাহেরের পৃষ্ঠপোষকতায় কলেজে যতগুলো ছাত্র। সংগঠন ছিলো প্রত্যেকটিরই সাধারণ সম্পাদক হলো আবুল। অতএব আবুলের রসাতলে যাওয়ার পথটা প্রশস্ত হলো অনায়াসে। তখন আবুলদের রসায়নের স্যার ছিলেন 'মোজাম্মেল স্যার'। যাঁর এক ভাই সরকারি চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের জনরেল অধ্যাপক। তাঁকে আবুল দেখেনি, কিন্তু মোজাম্মেল স্যারকে দেখেছে অত্যন্ত কাছ থেকে। এমন সত্যনিষ্ঠ সাধকপুরুষ আবুল তার জীবেন বড় একটা দেখেনি। একদিন বলা নেই কওয়া নেই, মোজাম্মেল স্যার তাঁর রুমে আবুলকে ডেকে পাঠালেন। আবুল গেলে তিনি ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলেন: “ পথে নেমেই পথকে ভয় পেলে আর পথ চলা হয় না। কিন্তু সাহস করে চলতে শুরু করলে, কখন যে পথই শেষ হয়ে যাবে তা তুমি টেরও পাবে না।
এখন সিদ্ধান্ত তোমার। পাথ আঁকড়ে থাকবে নাকি পথ ছেড়ে সহজ পতনকেই পথ করে নেবে।” আবুল যা বোঝার তা বুঝলো; মনকে শক্ত করলো। মনে মনে স্যারকে একটা স্যালুট করে, স্যারের কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এই সময় তার বার বার ইকবাল স্যারের কথা মনে পড়ছিলো। যেভাবে আবুল অধ্যয়নবিমুখ হয়ে পড়েছিলো, মোজাম্মেল স্যারের উৎসাহে একইভাবে অধ্যয়নে ফিরে এলো। এমন সময় 'ঈসা খান' নামের একজন গণিতের নতুন শিক্ষক কলেজে যোগ দিলেন। আবুল কীভাবে যেন জানতে পেরেছিলো ইনি একজন যুদ্ধফেরতা আল-বদর। তারপর থেকে তার কাজ হলো যে কোনো ভাবে নতুন গণিতের স্যারকে হেনস্থা করা। আবুলদের সময় তাদের কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে শ্রেণিকক্ষ ভর্তি থাকতো ছাত্র-ছাত্রীতে। কেউ কোথাও কোনো আওয়াজ করলে শিক্ষকের পক্ষে তা ঠিকঠাক ধরতে পারা প্রায় অসম্ভব ছিলো। আবুল গণিতের ক্লাসে শ্রেণিকক্ষের ঠিক মাঝখানে বসতো, তার কিছু ভক্ত-অনুরক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে। গণিতের নতুন স্যার যখন ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে মুখ করে মনোযোগ দিয়ে বোর্ডে কোনো অঙ্ক কষতেন, ঠিক তখনই আসনের বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে মেয়েদের মতো কণ্ঠে আবুল বিকট আওয়াজ করে উঠতো “তুই রাজাকার।” হঠাৎ এ রকম শব্দ শুনে ঈসা খান স্যার ভীষণভাবে চমকে উঠতেন। মাঝে মধ্যে তাঁর হাত থেকে চক ডাস্টারও পড়ে যেতো। কখনও কখনও আবুল নিরীহভাবে স্যারের হাতে কোনো অঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে তা তখনই কষে দেওয়ার আবদার করতো।
গণিতের নতুন স্যারও কেন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবুলের হাত থেকে অঙ্ক লেখা চিরকুটটি নিয়ে তা কষতে শুরু করতেন আর যথারীতি ব্যর্থ হতেন। এতে নতুন গণিত স্যারের কী ক্ষতি হয়ে ছিলো তা কেউ জানে না, কিন্তু বোকা আবুলের ভীষণ লাভ হয়েছিলো। গণিত বিষয়টা আবুলের রপ্ত হয়ে গিয়ে ছিলো ষোলআনা। গণিতের নতুন স্যারের বাড়ি ছিলো আবুলদের গ্রামের পাশের গ্রামে। যেমন ফর্সা ছিলো, তাঁর গায়ের রঙ তেমনি দেখতে ছিলেন সুদর্শন। আবুলদের শ্রেণির অনেক মেয়ে মনে মনে এই স্যারের প্রতি দুর্বল ছিলো। তাদেরই কেউ 1 একজন আবুলের কাণ্ড-কারখানার কথা স্যারকে বলে দিয়েছিলো। একদিন শুক্রবার জুমার নামাজের পর পর পিয়াসকে সাথে নিয়ে গণিতের নতুন স্যার আবুলের বাংলোতে এসে হাজির। স্যারকে দেখে আবুল তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সে বার বার পিয়াসের দিকে দেখতে থাকলো । পিয়াস আবুলের ‘চাহনি'কে পাত্তা না দিয়ে বলল: “ইনি আমাদের বড় ভাই। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, তাই তোর সাথে দেখা হয়নি। এখন তোদের কলেজে যোগ দিয়েছেন। মনে রাখিস, আমার বড় ভাই মানে তোরও বড় ভাই। কলেজে তাঁর যেন কোনো অসম্মান না হয়।” নতুন স্যার কিন্তু কলেজের ব্যাপারে কোনো কথাই তুললেন না। তিনি আবুলের বই-পত্রগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলেন। আবুলকে পড়ালেখার ব্যাপারে পরিপূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আবুলদের দেওয়া চা-নাস্তা খেয়ে চলে যাওয়ার সময় অত্যন্ত সাবলীলভাবে বললেন: “আমি খুব গরিব ঘরের ছেলে । খেয়ে-না খেয়ে পড়ালেখা করছি। জীবনে ভুল করে ভুল করার ফুরসত পাই নি । কিন্তু কী করে যে এটা হয়ে গেল...” এতটুকু বলে, কেমন অসহায়ের মত কতক্ষণ আবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পিয়াসকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন।
তখন বোকা আবুলেরও কেমন যেন গণিত স্যারের জন্য মায়া হয়ে ছিলো। বন্ধু-বান্ধবেরা বার বার আবুলের কাছে জানতে চেয়েছিলো: “কীরে আবুল, তোর সাথে কি নতুন গণিত স্যারের ভাব হয়ে গেছে? তুই স্যারের পিছন ছাড়লি কেন?” আবুল একটুখানি হেসে দিয়ে বন্ধুদের সকল প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যেতো। কার্যত সে দিন ঈসা খান স্যার আবুলদের বাড়িতে গিয়েছিলেন সেদিন থেকে আবুল তাঁর প্রতি কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। মোজাম্মেল স্যারের উৎসাহ ও সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ঈসা খান স্যারের সহযোগিতায় প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বোকা আবুল আবার বোকামি করে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম হয়ে বসলো। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে বাংলা সাহিত্যে আবুল প্রান্তিক নম্বর পেয়ে ইস্কুলের পরীক্ষাগুলোতে কোনো মতে উত্তরে এসেছে, সে আবুল একাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষায় বাংলায় আশির ঘরে নম্বর পেয়ে নিজেই নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাতে বসলো। তখন আবুলদের যে দুজন বাংলার স্যার ছিলেন তাঁদের একজন হলেন বিখ্যাত ছোটগল্পকার, গবেষক, সাহিত্য সংগঠক বিপ্রদাশ বড়ুয়া। এমন শিক্ষক আবুলের মতে কয়েক যুগেও একজন জন্মায় না।
পড়ানোর সময় তাঁর সারা অঙ্গ কথা বলতো। এ ভাষা যে ছাত্র বুঝতো তার আর কিছুর প্রয়োজন হতো না। আবুলের কাছে তিনি ছিলেন 'বাংলা সাহিত্যের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা'। তাঁর প্রেরণায় আবুল গোপনে গোপনে এটা-ওটা লিখতে শুরু করলো। স্বাধীনতা কিংবা একুশে উপলক্ষে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় আবুল একটি কবিতা জমা দেয়। তাজ্জবের ব্যাপার সেটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে যায়। আবুল তার প্রিয় স্যার বিপ্রদাশ বড়ুয়ার হাত দিয়ে বিষ্ণু দে বিরচিত 'রবিকরোজ্জ্বল এই দেশে' কবিতার বইখানি প্রথম পুরস্কার পায়। আর এটিই ছিলো বোকা আবুলের জীবনের প্রথম পুরস্কার। আগে আবুল কেবল বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকটই পরিচিত ছিলো। এখন সে গোটা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর নিকট পরিচিত হয়ে গেলো। কলেজের সাহিত্যমনা সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর সমন্বয়ে ‘বিভাস সাহিত্য চক্র' নামে একটি সাহিত্য সংগঠন পরিচালিত হতো। এবার আবুল এ সংগঠনেরও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। এ সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী-দ্বাদশ মানবিক বিভাগের ছাত্রী মেরী বড়ুয়া। চাল-চলন, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা সব কিছুতেই সাধারণের চেয়ে আলাদা। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদ, চোখজোড়া বড় বড়, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত, মুখমণ্ডলের বাড়তি লাবণ্যে কাছে টানে সহজেই। প্রথম দেখাতেই মনে হয় যেন অনেক জন্মের পরিচিত। যখন কথা বলে মনে হয় এ তো কথা নয়, সংগীত।
মেরীর সাথে আবুলের আলাপটা কাকতালীয়। ছুটির পর কলেজ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে আবুলেরা কজন। সেকালে এমনিতে গাড়ি-ঘোড়া ছিলো কম। অধিকন্তু স্কুলজীবন থেকেই আবুলের হাঁটার অভ্যাস। আবার তখন গাড়ির জন্য যতক্ষণ অপেক্ষা করবে ততক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যাবে অনায়াসে। তাই কলেজে আসতে কিংবা কলেজ থেকে ফিরতে আবুল আর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে না। সেদিনও এর ব্যত্যয় হয়নি। আবুলের যতদূর মনে পড়ে তখন ছিলো গ্রীষ্মকাল। সুয্যিমামাও সেদিন ভীষণ খেপে ছিলো, ফলে বায়ুমণ্ডল ছিলো অসম্ভব উত্তপ্ত। আবুল সকল প্রকারের ভব্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে গায়ের জামাটা খুলে পাগড়ির মতো তার মাথায় বেঁধে নিয়েছিলো। তারা হাঁটছিলো ঢিমে তালে, হঠাৎ পিছন থেকে একটি গানের কলি এসে আবুলের কানে বাজলো: “এই আমরাও কি তোমাদের সাথে যেতে পারি?” আবুলেরা সব কজন একসাথে পিছনে তাকালো। দেখলো তাদেরই কলেজের কয়েকজন মেয়ে ধীর লয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আবুল সব কিছু ভুলে গিয়ে প্রথমে মাথা থেকে জামাটা নিয়ে গায়ে পরলো। আবুলদের একজন দুষ্টুমি করে বললো: “না পারবে না। কারণ আমার মরহুম দাদামশায় হাজার বছরের জন্য বাদশা আওরঙ্গজেব থেকে রাস্তাটা লিজ নিয়েছেন। আলবত তোমাদের আমার অনুমতি আবশ্যক।” হালকা-পাতলা পড়নের লম্বা মেয়েটি ঈষৎ হেসে বললো: “তাহলে তুমি এটাও জানো, তোমার দাদামশায় আমার ঠাকুরদা থেকে হাজার টাকার তোড়া নিয়ে আমাদেরকে বংশপরম্পরায় এ রাস্তাটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রেখেছেন।” তারপর একে একে সকলেই, সকলের সাথে পরিচিত হলো। আবুল মেরীকে আগে থেকে চিনতো। কিন্তু আলাপ ছিলো না। হলো আজকে।
সময়ের স্বভাবেই চলে সময়। আবুলের জীবনেও আসে পরিবর্তন। আগে যে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো তার মা সেখানে এখন অনেক নতুন মুখের নিত্য আনাগোনা। এসব মুখের ভিড়ে মায়ের মুখটা আবুলের কাছে কেমন যেন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। আলাপের পরের দিনই মেরী ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' উপন্যাসটা আবুলকে পড়তে দেয়। আবুলও পরম আগ্রহে হাত পেতে নেয়। কিন্তু কেন জানি একটি বারও বলতে পারেনি, “এর মধ্য বইটি আমার বার কয়েক পড়া হয়ে গেছে।” কিছু নিলে কিছু দিতে হয়, ভদ্রতার এ নিয়ম মেনে, পরের দিন আবুল রবি ঠাকুরের 'শেষের কবিতা' উপন্যাসখানি মেরীর জন্য নিয়ে আসে। বইটি পেয়ে মেরী এতোই উৎফুল্ল হলো যেন সাতরাজার ধন হাতে পেয়েছে। কথায় কথায় মেরী আবুলের কাছে রবি ঠাকুর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং তাঁর সম্পর্কে আবুলের মতামত জানতে চায়। এখন কেউ যদি রবি ঠাকুর সম্পর্কে কোনো মন্তব্য জানতে চান, তবে আবুল তা জানাতে সরাসরি অক্ষমতা প্রকাশ করবে। কিন্তু সেদিনের কৈশোর-উত্তীর্ণ আবুল সবজান্তার মতো গড়গড় করে অনেক কথাই বলেছিলো। বলেছিল: “দেখো মেরী, রবি ঠাকুরকে পড়ার জন্য কোনো অভিধান প্রয়োজন হয় না।
একজন ভাষা অর্বাচীনও অতি সহজেই রবি ঠাকুরের প্রায় সব ধরনের রচনা তড়বড় করে পাঠ করতে সক্ষম। কিন্তু পাঠান্তে তুমি যদি পাঠক কী বুঝলো জানতে চাও তবে তিনি পড়বেন মহাফাপরে। হাঁ করে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার থাকবে না। আমার মতে রবি ঠাকুর সহজ-সরল শব্দের ফাঁদ পেতে অতীব সহজে তাঁর পাঠককে সে ফাঁদে গ্রাস করেন। কিন্তু আপাত সরল শব্দের ভিতর ভাবের যে গভীরতা প্রোথিত থাকে তা আমাদের মতো অর্বাচীনের পক্ষে বোঝা তো দূরের কথা, সে চেষ্টা করাও ধৃষ্টতা। প্রথমে মনে হয়, তাঁর রচনার ভেতরে প্রবেশের সব কটি দরোজা হাট করে খোলা। কিন্তু যেই মাত্র তুমি তার ভেতর পা বাড়াবে অমনি ভাবের সব রাক্ষস-খোক্কস তোমার পথ আগলে দাঁড়াবে। দিশায় পাওয়া মানুষের মতো তুমি এক ঠাঁয় ঘুরতে থাকবে। শেষে নিজের লেখার ব্যাখ্যার জন্য কৰিকেই কলম ধরতে হবে।” এ পর্যন্ত বলার পর মেরী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো: “এবার থামুন পণ্ডিতপ্রবর । বইটির জন্য তোমার এক বেলা নাস্তা পাওনা রইলো।” এরপর মেরী কলেজের ছাত্রী মিলনায়তনের দিকে পা বাড়লো। আর বোকা আবুল তার চলে যাওয়ার দিকে আবুলের মতো তাকিয়ে থাকলো। পড়ালেখা সময়ের সাথে তাল রেখে মোটামুটি ভালোই হচ্ছিল আবুলের।
অন্যদিকে অনেকজনের সাথের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ যেন একজনে এসে ঠেকছিলো। আর সব সংগঠনের দায়িত্ব পালনে আবুল উদাসীন হলেও বিভাস-সাহিত্য চক্রের দায়িত্ব পালনে তার কেমন যেন অতিমাত্রায় সচেতনতা পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। এমনি ভাবেই হয়তো আবুলের সময় কেটে যেতে পারতো কিন্তু তার একটি দুঃসাহসিক কাণ্ড সবকিছু কেমন উলট-পালট করে দিলো। মেরীদের পারিবারিক গ্রন্থাগার ছিলো, তাতে ভালো ভালো সব গ্রন্থের সংগ্রহও ছিলো। সে হিসেবে আবুলের সংগ্রহ অত্যন্ত নগণ্য। মেরীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আবুল এখন রহস্যোপন্যাস বাদ দিয়ে কিছু কালজয়ী গ্রন্থ সংগ্রহে মনোনিবেশ করলো। উদ্দেশ্য সেও পালটা মেরীকে ভালো ভালো বইয়ের জোগান দিয়ে যাবে। এ সময় আবুলের হাতে আসে বিভূতি বাবুর বিখ্যাত উপন্যাস 'আরণ্যক'। পরদিনই আবুল বইটি মেরীকে পড়তে দিলো। তবে বইটি নির্ভেজাল ছিলো না। আবুলের হাতের লেখা একটা 'চিরকুট' গ্রন্থটার মধ্যে মুখ গুঁজে লুকিয়ে ছিলো। পরদিনই মেরীকে একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় তড়িঘড়ি করে আবুলের দিকে আসতে দেখা গেল।
আবুলের সামনে এসে মেরী কোনো ধরনের ভূমিকা বা ভব্যতা না করে হিড়হিড় করে তাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললো: “আজ ছুটির পরে আমার সাথে একটিবার একলা দেখা করো।” তারপর সে অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। আবুল এক্কেবারে থ হয়ে সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অতি ধীরে রাস্তার দিকে হাঁটা ধরলো। সেদিন সে আর ক্লাস করলো না। কলেজের দক্ষিণ পাশের রাস্তার মাথায় যে গর্জন গাছটি আছে, বিমর্ষ মনে তার কাজের সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়লো। কলেজ ছুটি হলে আস্তে আস্তে বড় রাস্তা ধরে উত্তর-পশ্চিম দিকে অনেকটা উদাসীনভাবে হাঁটতে থাকলো। তার পাশ দিয়ে তারই অনেক সহপাঠী বাড়ি ফিরলো। কিন্তু তার একবারও বাড়ি ফেরার কথা মনে হলো না। আচম্বিত একটি কোমল হাতের ছোঁয়ায় আবুল চমকে উঠলো। পিছনে ফিরে দেখলো তার কাঁধে বাঁ-হাতটি দিয়ে প্রায় তার গায়ের সাথে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেরী। আবুল হাঁটা থামিয়ে পিছনে ফিরতেই মেরী একটি বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছের দিকে ইশারা করে বললো “চলো বসা যাক।” আবুল এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে বড় রাস্তার একশ গজের মধ্যে তারা দুজন ছাড়া আর কেউই নেই। কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় একটি বড় শিকড়ের উপর আবুল আর মেরী পাশাপাশি বসলো মেরী কোনো সময় নিলো না। সে আবুলের কাঁধে তার বাঁ হাতটা আলতো করে রেখে বলতে লাগলো: “দেখো, তুমি আমার ভালো বন্ধু। আমি জানি কোনো বিপর্যয় না এলে তুমি জীবনে অনেক দূর অবধি যাবে। উপরন্তু তোমার আমার ধর্ম ভিন্ন। আমি তোমার জন্মতারিখ দেখেছি। দেখেছি তুমি আমার গোটা দুই বছরের ছোটো। তবে এসব আমার আসল কথা নয়।
আমি নির্দ্বিধায় বলছি তোমার মতো ছেলেকে পাশে পেলে যে কোনো মেয়ে বর্তে যাবে, আমি কোন ছার। কিন্তু বন্ধু বিধি বাম। আমি বিবাহিতা। আমার তিনি জাপানে, এই এলেন বলে। " শেষের কথাটুকু শুনে আবুল কেমন যেন চমকে উঠলো। কাঁধ থেকে মেরীর হাতটা আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়ে বানভাসি মানুষের মতো মেরীর চোখের উপর তার চোখ দুটি রাখলো। মেরী কেমন যেন অকারণ চপলতা প্রকাশ করে বললো: “তোমার চিরকুটটা কিন্তু আমি রেখে দিচ্ছি। আমৃত্যু এটা আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত থাকবে।” এতটুকু বলে মেরী আর দাঁড়ালো না। হাতের ইশারায় একটি রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলো। আবুল যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো মেরী তার শাড়ির আঁচল এবার তার চোখ আর মুখের দিকে তুলছে। আর আবুল...? না, কিছুই করলো না। কেবল তার গায়ের জামাটা খুলে বাতােেস ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলো। এরপর আবুলের সাথে মেরীর আরেক বার মাত্র দেখা হয়েছিলো। কলেজ ক্যাম্পাসে এক্কেবারে একান্তে। তারপর কলেজ থেকে অ-নে-ক দূরে, অনেক দিন পর আবুল আরেক মেরীকে দেখেছিলো, যাকে সে কোনোদিন দেখতে চায়নি। কিছুদিন ধরে আবুলের মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছে না।
তাঁর পেটের পীড়া। স্থানীয় ডাক্তারের ধারণা রক্ত-আমাশয়। ভালো হতে একটু সময় লাগবে। এমন সময়ে আবুলের এক দূর সম্পর্কীয় ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে নামলো। দাওয়াত দিয়েছে খুব করে, আবুলদের পরিবার থেকে কেউ একজন না গেলে নয়। আবুলের মা বিছানা থেকে খুব একটা উঠতে পারেন না। এমন কী, বিছানাতেই অনেক সময় বাহ্য সারতে হয়। তিনি আবুলকে ডেকে পাঠালেন। আবুল তার মায়ের শিয়রে বসে মাথায় আর কপালে হাত বোলাতে লাগলো। আবুলের মার চোখ দুটি বোজা। তিনি তাঁর আস্থিচর্মসার একটি হাত আন্দাজে আবুলের মাথার উপর তোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। হাতটা থরথর করে কাঁপছিলো আর বারবার পড়ে যাচ্ছিল। আবুল তার মায়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নিজেই মায়ের ডান হাতটা তার মাথায় রাখলো। আবুলের মা তাঁর কম্পিত হস্তে পরম স্নেহে ছেলের মাথার লম্বা কালো চুলে বিলি কাটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তাঁর হাতটা ছেলের মাথার উপর প্রাণহীন বস্তুর মতো লেপটে থাকলো। আবুল দেখলো তার মায়ের ওষ্ঠাধর থরথর করে কাঁপছে এবং কোটরাগত নিমীলিত দু চক্ষুর কোটর ছাপিয়ে শীর্ণ গণ্ড হয়ে ফোঁটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু অশ্রু।
বাইরের জগৎ নিয়ে আবুল এতোই মেতে ছিলো যে, সে জানতেই পারেনি তার একান্ত আপন ভুবনে নেমেছে মহাধস। মায়ের শরীরের এমন হাল আবুল কল্পনাও করতে পারেনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আবুল প্রস্তরবৎ কতক্ষণ মায়ের শিয়রে বসেছিলো জানে না। হঠাৎ তাঁর মায়ের কণ্ঠ শুনে সম্বিত ফেরে। সে তার মায়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। অনেক কষ্টে পাখির শব্দের মতো চিঁচিঁ রবে মা আবুলকে বললেন: “বাবা, ঘরে তো আর কেউ নেই, তুই আমার বড় ছেলে। এবারটির মতো তোকে যে একটু বরলিয়া যেতে হবে।” এইটুকু কথা বলতে গিয়েই তিনি ভীষণ হাঁপিয়ে উঠলেন। আবুল মাকে কথা বলতে বারণ করলো। এবং মায়ের কথায় সম্মতি জানালো। আবুলের মা ঘর-সংসারের কোনো কাজ জানতেন না, কেবল রান্নাটা ছাড়া। তা-ও কেউ একজন তরিতরকারি মসলাপাতি জোগাড়যন্তর করে দিলেই। তাই তাঁকে বাড়ির ঠাট্টার সম্পর্কীয়রা ডাকতেন ‘চৌধুরী’। এ নিয়ে আবুলদের সংসারে কোনো দিন কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ আবুলের মায়ের ছোট-জা হাসিমুখে সংসারের সব কাজের ভার একাই নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ঘরকন্নার কাজে অপটু আবুলের মায়ের মনটা ছিলো প্রশান্ত মহাসাগরের মতো বিশাল। এখানে এসে ছোটো-বড়ো সবমিলে একাকার হয়ে যেতো। আবুল তাঁকে ভিখারিনীর সাথেও তাঁর বাটার শেষ সম্বল একমাত্র পানটা দু ভাগ করে খেতে দেখেছে। বাড়ির যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে, সম্পর্কে চাচি, জেঠি, ভাবি যা-ই হোক না কেন, তাদের এবং তাদের বরের যতো বায়না আবুলের মায়ের কাছে।
তিনিও তাদের যথেষ্ট যত্ন-আত্তি করতেন। এভাবে গোটা বাড়ির সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে আবুলের মায়ের একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই বিনি সুতোর বন্ধনটা তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তুষ্ট মনে। তাই জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে বসেও তিনি পাড়ার সম্পর্কের ননদের ছেলের বিয়ের কথা বিস্মৃত হতে পারেননি। অনেকটা অসামাজিক আবুলকে ডেকে তাই তাঁর এ নির্দেশ। মায়ের শরীরের অবস্থা দেখে আবুলের মন কিছুতেই এ বিয়েতে যেতে সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু অসুস্থ মায়ের মুখের উপর অস্থির আবুলের পক্ষেও সরাসরি না বলা সম্ভব হলো না। আবুলের মা আবার অনেক কষ্টে আবুলকে বললো: “বাবা, এবার তুই পড়তে যা, সামনেই তোর পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় তোকে অনেক অনেক ভালো করতে হবে।” আবুল কিচ্ছুটি বললো না। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির মতো অনেকটা অনিচ্ছায় ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পড়তে বসে আবুল যখন বই খুলে বসলো তখন কিছুতেই তাতে মনঃসংযোগ করতে পারলো না। পালাক্রমে দুটি ছবি তারমানসপটে আনাগোনা করতে শুরু করলো।
কখনো একটা রিকশা হনহন করে তার পাশ দিয়ে ছুটে চলছে, তাতে লাল পেড়ে বেনারসি পরে বসে আছে যে জন, তার সিথিতে সিঁদুর, হাতে শাখা। আবার তার অত্যন্ত কাছের কোনো একজন, সারা শরীর কাফনে ঢাকা, চারজন চেনা-চেনা মুখের মানুষ তাকে খাটিয়ায় করে যেন কোন অজানার দেশে নিয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। আবুলের পাগল হওয়ার দশা। সতের বছরের এই জীবনে আবুল তার চারপাশকে সব সময় অস্থির করে তুলেছে। আর আজ অসহনীয় অস্থিরতায় তারই পাগল হওয়ার দশা। অবশেষে আবুল পালানোর সিদ্ধান্ত নিল। যাবে, সে বিয়েতেই যাবে। আবুলের যতো শখের বস্তু ছিলো, তার একটি হচ্ছে ক্যামেরা। 'ইশিকা ৩৫'। জাপানের তৈরি। তখনকার দিনে এটি ছিলো দুর্লভ বস্তু। পরের দিনই আবুল ফুজি কোম্পানির একটি রিল ক্যামেরায় ভরে দিল। বেলি কেডস জিনসের প্যান্ট আর লাল হাওয়াই শার্ট পরে বিয়ের দুদিন জাগেই আবুল বিয়েবাড়িতে হাজির। সহপাঠী বৈ অন্যদের সাথে আবুল বড় একটা মিশতো না বা মিশতে পারতো না। এক নানুবাড়ি ছাড়া আর কোথাও সে সহজও হতে পারতো না। তাই অন্য কোনো আত্মীয় বাড়িতে আবুলের যাওয়াও হতো না।
এবার ঘটলো উল্টোটা, বিয়েবাড়িতে আসা অতিথি-অভ্যাগতদের সাথে সে আগ বাড়িয়ে পরিচিত হতে লাগলো। ইতোমধ্যে তার ডজনখানেক ভক্ত জুটে গেলো। সকলেই বয়সে নবীন। স্কুলের নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের মধ্যে জনা তিনেক মেয়েও ছিলো। তবে তারা ছিলো টিপিক্যাল গাইয়া, এদের নিয়ে একটু মজা করার বাসনা, মেয়েদের মধ্যে দাম্ভিক বলে পরিচিত আবুলের মনে উকি দিলো। আবুলের তিনজনের মধ্যে থাকে একটু বেশি টিপিক্যাল মনে হলো তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো, মেয়েটি আসি কি আসি না করে এক সময় আবুলের সামনে এসে দাঁড়ালো।আবুলেরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, তা ছিলো একটা খালের পাড়। খালের এপারে বাড়িঘর, ওপারে ধানি জমি। মাঝে মাঝে কেয়াঝাড়ের ঝোপ, মাঝে মাঝে ধানগাছের মতো এক প্রকারের ঘাসের ঝোপ। আবুল এবার সরাসরি মেয়েটিকে খালের ওপারে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। মেয়েটি একটু করে চোখ তুলে আবুলের দিকে তাকিয়ে আবার তার পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর চোখ জোড়া রাখলো। আবুলের দৃষ্টিও এবার সেদিকে গেলো। মেয়েটির পা দুটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাছাকাছি অবস্থিত। একপায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্য পায়ের বুড়ো আঙুলের নখে কোটাকুটি করছে।
আবুল কতক্ষণ একদৃষ্ট সেদিকে তাকিয়ে থেকে ক্যামেরটা গলায় ঝুলিয়ে খালের ওপারে যাওয়ার বাঁশের সাঁকোটির দিকে হাঁটতে থাকলো। ইটিতে ইটিতেই উপস্থিত সকলকে লক্ষ করে বললো: “তোমরা একটু এখানে থাকো। আমি এখনই ঐ ঘেমো ঝোপটার স্ল্যাপ নিয়ে ফিরছি।” কথাটা বলেই আবুল মেয়েটির দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটিও আবুলের দিকে কেমন একটু ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আবুল আর পিছনে ফিরে তাকালো না। খালের পার ধরে সাবধানে গিয়ে বাঁশের সাঁকোতে উঠলো। এবং সাঁকো পেরিয়ে খালের অন্য পার ধরে উলটো দিকে হেঁটে ঘেসো ঝোপটার কাছে পৌঁছালো। সূর্য তখন পাটে। শরতের নির্মেঘ আকাশ। ক্ষেতভরা সবুজ ধান। গাছগুলো পোয়াতি। সন্ধ্যার আগাম বার্তা নিয়ে ছোট ছোট পাখিগুলো আবুলের মাথার উপর দিয়ে কুলায় ফিরছে। কনে দেখা আবিররঙে দোদুল্যমান ধানগাছ, পশ্চিমের আকাশে ভাসা হালকা কুয়াশা, কেয়াঝাড়ের ঝোপ, খালপারের বাঁশঝাড়ে আর মেসোঝাড়টি যেন লজ্জারাঙা কনেবউটি হয়ে উঠলো।
আবুল খালের ওপারের দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না। এবার সে ক্যামেরাটা ঘেসো ঝোপটির দিকে তাক করে যেই লেন্সে চোখ রাখলো অমনি সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো । ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে সে স্পষ্ট দেখতে পেলো ঘেসোঝাড়টির একগোছা ঘাস বাঁ-হাতে নিয়ে অস্তপারের দিনমনির দিকে অপলক তাকিয়ে দুটি বুদ্ধিদীপ্ত পটলচেরা চোখ, চোখ দুটি কোনো শিল্পীর আঁকা অনুপম এক মুখমণ্ডলে খচিত। প্রথম দেখায় আবুলের মনে হলো এ মুখ পৃথিবীখ্যাত মহাকবির কোনো মহাকাব্যের নায়িকারই প্রতিবিম্ব। এ মুখে, এ চোখে নেই কোনো জড়তা, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদনের আকৃতির সাথে মিশে আছে শাশ্বত নারীর স্বভাবজাত ব্রীড়া অনেক খুঁজেও এর মধ্যে ওপারের মেয়েটিকে খুঁজে পেলো না। বোকার মতো বোকা আবুল অনেকক্ষণ ক্যামেরার চোখে চোখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর এক সময় মেসোঝোপটি একটু শব্দ করে নড়ে উঠলো, আবুল তড়িঘড়ি করে স্ল্যাপ নিতে গিয়ে হাত থেকে ক্যামেরাটা ছুটে গিয়ে গলায় ঝুলে পড়লো। মেয়েটির আর দাঁড়ালো না, চপলা হরিণীর মতো সারা অঙ্গে রূপের ঢেউ তুলে টুপ করে কোথায় হারিয়ে গেল। আর বেচারা আবুলও ধীর পায়ে ফিরে এলো। গায়ে হলুদে তেমন একটা জমলো না। অতিথি-অভ্যাগতদের খাওয়া-দাওয়া হলো উঠোনে চাটাই বিছায়ে।
তারপর ঠাট্টার সম্পর্কের কয়েকজন মধ্য বয়স্কা মহিলা এসে বরের হাতে মেহেদি পরিয়ে গেলো। স্কুল কিছু কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টার ছলে পরস্পর পরস্পরের দিকে ছুড়ে দিলো। এসবের কিছুই আবুলের ভালো লাগলো না। বরং মহিলাদের কথাগুলো এতোই স্থূল, আবুলের অশ্লীল মনে হলো। লজ্জায় তার কর্ণমূল পর্যন্ত লাল হয়ে গেলো। মন তার কেবলই পালাই পালাই করলেও চোখ দুটি যেন উপস্থিত ভিড়ের মাঝে কাউকে খুঁজছিলো। মাঝে-মধ্যে একজোড়া চোখ আবুলের বড় চেনা মনে হলো । মনে হলো ঐ জোড়া চোখ থেকে এক ঝলক বিদ্যুৎ হঠাৎ হঠাৎ এসে আবুলের বামপাশে বিদ্ধ করছে। আবুলের মন-প্রাণ বড্ড চঞ্চল হয়ে ওঠলো। খাওয়ার জন্য বিছানো চাটায়ের উপরই বরকে একটি পিঁড়িতে বসিয়ে তার চারপাশে অন্যরা দাঁড়িয়ে মজা করছিলো। কেউ করছিলো গান, যার সবটাই আঞ্চলিক লোকগীতি।
আবার গানের সাথে কখনো সখনো বুড়ি বুড়ি মেয়েরা দোলাচ্ছিলো কোমর। উপস্থিত ছেলে-বুড়োর হাসাহাসিতে আবুল বুঝলো এগুলোতে এরা বেশ মজা পাচ্ছে। কিন্তু এগুলোতে সে মজা নয়, পাচ্ছিলো লজ্জা। কোথাও একটু পালাতে পারলে যেন সে বাঁচে। এমন সময় বরের পিঠেপিঠি ছোট ভাই ছগির, যে আবুলেরই সমবয়সী, এই একটি পড়ার বয়সেই পাকা ব্যবসায়ী, আবুলকে ডেকে নিয়ে গেল একটি বাংলো মতোন ঘরে। ছোট্ট একটা কামরা। কামরায় একটা মাঝারি চৌকি, টেবিল, একটি চেয়ার। টেবিলের উপর গুছানো খানকয়েক বই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো ইস্কুলের পাঠ্য বই। মাটির দেয়াল, বাঁশের ছাদ, শনের ছাউনি দেওয়া ঘরটিতে একটিমাত্র দরোজা, আর একটি ছোট্ট খুলগুলি। ছগির আবুলকে বললো "এটি মাস্টার চাচার দেউড়ি। এখানেই থাকবি। আমিও তোর সাথে থাকবো।” এতটুকু বলে আবুলকে রেখে ছগির ব্যস্তসমস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। ছগির চলে গেলে আবুল ভাবলো: "ঢের হয়েছে আর না। এবার নিদ্রাদেবীর কোলে একটু নিরুপদ্রব আশ্রয়।" আবুলের রাত জাগার অভ্যাস আবাল্যের। বলতে গেলে তার একপ্রকার অনিদ্রার ভাব আছে। আজ কিন্তু কাপড় পালটে পিঠ যেই না বিছানায় রাখা, অমনি রাজ্যের সব ঘুম নামলো তার চোখে।
সূর্যের তেজে একেবারে ঘেমে নেয়েই আবুলের ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে আবুল প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু তার পাশে উবুড় হয়ে ভূস ভুস করে ছগিরকে মোষের মতো ঘুমোতে দেখে আবুলের সব কিছু মনে পড়ে গেলো। সে আলতো করে ছগিরের পাশে থেকে উঠে এলো, যাতে ওর ঘুম না ভাঙে বাইরে বের হওয়ার জন্যে দরোজার আগল খুলতে গিয়ে আবুল দেখে এটা আগে থেকেই খোলা। কেবল দরোজার কপাট দুটি ভেতর থেকে ভেজানো। ভেজানো দরোজা খুলে বাইরে পা রাখতে গিয়ে আবুলের পা মাঝপথে থেমে গেলো, সে এখন অনেকটা একপায়ে দাঁড়িয়ে। কারণ সে যেখানে কদম ফেলবে সেখানে একটি তাজা কলাপাতার উপর গুচ্ছের শিউলি ফুল। ফুলগুলো যেমন শুভ্র, তেমনি টাটকা। ফুলের শুভ্রতা গোটা জায়গাটাকে যেন পবিত্র করে দিয়েছে। আর সুবাস? আবুলের মনে হলো এ ফুলের সুবাসে গোটা পাড়াটা সুরভিত। আবুল অতি সাবধানে তার কদম রেখে পরম আগ্রহে পাতাসমেত ফুলগুলো তুলে নিলো । এমন সময় আবুলের পিছন থেকে সদ্য ঘুম থেকে জাগা ছগির বলে উঠলো: “কী রে আবুল, তোর হাতে ওগুলো কী?” আবুল মুখে কিছু বললো না, কেবল পিছন ফিরে ছগিরকে তার হাতের ফুলগুলো দেখালো। ছগির এক পলও না ভেবে বললোঃ “ও, বুঝেছি। এসব পাগলির কাজ। মাস্টার চাচার একমাত্র মেয়ে। নয় ক্লাসে পড়ে। পরির মতো দেখতে। কিন্তু মাথাটা আউলা-ঝাউলা। সবাই বলে তার জিনের আসর হয়েছে।”
আবুলের মুখে কোনো কথা সরলো না। বোকা আবুল সত্যিই বোকার মতো ফুলগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।আজ রাত্রেই বিয়ে। কনের বাড়ি অনেকটা দূরে। বর যাবে চতুর্দোলায়। কনে আসবে পালকিতে। বেহারা কাহারেরা চতুর্দোলা, পালকি নিয়ে এসে গেছে। পালকি সাজানো হবে না, কাঁচা তাজা ফুল দিয়ে চতুর্দোলা সাজানো হবে। বেহারা, কাহারেরা পর্যাপ্ত সিদে পেয়েছে; তারা উঠোনের এক পাশে আয়োজন করছে রান্নার। গোটা পাড়াটার কাচ্চাবাচ্চা এখানে এসে ভেঙে পড়েছে। তারাই জানে এখানে কী মজা পাচ্ছে। মাইক এসেছে। এখন এখানেই গান বাজানো হবে। আর বর এই মাইকে গান বাজাতে বাজাতে শ্বশুরবাড়ি যাবে, তারপর বিয়ে করে পালকিতে করে নববধূকে নিয়ে মাইকে গান বাজাতে বাজাতে নিজ বাড়িতে ফিরবে। আবুলের এসব জানা, তাই এসব নিয়ে তার কোনো ঔৎসুক্য নেই। এখনো তার মন-প্রাণ জুড়ে আছে কালকের রহস্যময়ী বালিকাটি। কাল রাতের ঘুমটুকু আজ দিনের বেলায় পুষিয়ে নিচ্ছে অনেকেই। তাই এখনো বিয়েবাড়ি বেশ নীরব। দ্বিপ্রহরের পর এ শান্ত পরিবেশ আস্তে আস্তে হয়ে উঠবে অশান্ত। চারপাশে মেতে উঠবে হৈ-হুল্লোড়ে।
আসবে আরও আরও অতিথি-অভ্যাগত, আবুল তখন শত চেষ্টা করলেও কাউকে একটু নিরিবিলিতে একা পেতে পারে না। তাই এ সুযোগটা সে হারাতে নারাজ। পাগল হোক আর ছাগলই হোক, মেয়েটির সাথে তাকে একটিবার একান্তে কথা বলতেই হবে। কপালে যা-ই থাক, ছগিরের মাস্টার চাচার ঘরে সে একবার ঢুকবেই । এখন প্রয়োজন একটা অজুহাত। কথায় বলে না মন-প্রাণ দিয়ে মানুষ স্বয়ং স্রষ্টাকে চাইলে তাকেও পায়। এ কথাটা আবুলের জীবনে ফলে গেলো অক্ষরে অক্ষরে। আবুল তখন যে দেউড়ি ঘরটায় রাত্রে ঘুমিয়ে ছিলো তার একপাশে একটি পায়ে চলা পথে দাঁড়িয়ে। পথটার দক্ষিণ পাশেই দেউড়ি। এক কামরার ঘর। তার পশ্চিম পাশে এক চিলতে নিকানো উঠোন। উঠোনের পশ্চিম পাশে দু কামরার একটি মাটির ঘর। ঘরটি আটচালা টিনের। ঘরের দেয়ালে, উঠোনে আর চারপাশে আন্তরিক যত্ন ও রুচির ছাপ স্পষ্ট। ঘরের দক্ষিণ পাশটা জুড়ে সুপারি গাছের বিশাল বাগান।
গাছগুলো প্রায় গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। যে কেউ ইচ্ছে করলে এক গাছ থেকে অনায়াসে অন্য গাছে যেতে পারে। আবুলের কেবল বেখাপ্পা মনে হলো বড় সড় একটি শিউলি গাছকে। যার তলায় এখন অগুনতি শিউলি ফুলের শুভ্র বিছানা। আবুলকে চমকে দিয়ে তার ভাবনার মাঝখানে শিউলি গাছের একটা ডাল ধরে কেউ একজন কতক্ষণ বাদুরের মতো ঝুলে থাকলো। তারপর এক সময় ঝুপ করে মাটিতে পড়লো। এবার আবুল সেদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। বিস্ময়ে তার চোখ জোড়া চড়কগাছ। যে চোখের ঝিলিক আবুল মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও ভুলবে না, এই তো সেই চোখ। এখন অবশ্য চোখ নয়, আস্ত মানুষটাকেই সে দেখছে। আকাশ রঙের সালোয়ার-কামিজ পরনে। ওড়না হালকা আসমানি, বুকের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে এসে বেশ শক্তভাবে কোমরে প্যাচানো। বুকটা টানটান। পাতলা কটি। বেশ পুরুষ্ট নিতম্ব, তবে মাংসালো নয় । হাত-পা সরু কিন্তু সজীব, হাতের আঙুলগুলো বাঁশের কঞ্চির মতোন চিকন লম্বা, পা দুটি দেবী প্রতিমার, মাথার চুল যদিও ঝুঁটিবাধা, তবে সহজেই অনুমেয় এ কুন্তলরাজি খুলে দিলে দীর্ঘাঙ্গী বালিকাটির জানু ছাড়িয়ে যাবে। আলাওলের পদ্মাবতীর মতে ওষ্ঠাধর। দেখেই মহাকবির মতো বলতে ইচ্ছে করে “তাম্বুল রাতুল হয় অধর পরশে"। এর কিছুটা রঙ যদি আবুল তার আপাত শ্যামল ওষ্ঠাধরে তুলে নিতে পারতো! এসবই আবুলের মনের কথা, মুখের কথা নয়। অলৌকিকভাবে সংঘটিত এ ঘটনাটায় আবুল এতোই চমকে গেলো এখন সে পুরোটাই বেসামাল। কিন্তু মেয়েটি ভীষণ প্রাণবন্ত। লাজ-লজ্জা, ডর-ভয় কিছুই তার আচরণে পরিলক্ষিত হলো না।
সে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে এসে এক্কেবারে আবুলের নাকটি ঘেষে সামনাসামনি দাঁড়ালো। মাথায় আবুলের চেয়ে ইঞ্চিখানেক খাটো। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে মাথায় আবুলের সমানে সমান হলো। তারপর স্পষ্ট কন্ঠে বললো: “আমি এই রকমই। যখন যা মন চায় তাই করি। জোছনা রাতে আমি মাঝপুকুরে সাঁতার কাটি। অমাবস্যার তমসায় আমি সূর্যের মুখ খুঁজি। আর কালবৈশাখির প্রচণ্ড ঝড় ঘরের টিন, গাছের ডাল যখন উড়িয়ে নিয়ে যায়, আমি ঐ ঝড়ে ওড়না উড়িয়ে দিই, প্রজাপতির পাখার রঙ আমি গায়ে মাখি, শ্যামল সবুজ দূর্বা আমি চিবিয়ে খাই, আর যখন আকাশে চাঁদও থাকে না, সূর্যও থাকে না, কেবল আকাশভরা তারকারাজি অকারণে চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে থাকে, তখন মনটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদি । আমি জানি শরতের ধবল মেঘের ভেলায় চড়ে শিউলি ফুলের বৃষ্টি ঝরিয়ে সে আসবে, তারপর তার দীর্ঘ লম্বা হাত দিয়ে আমাকে তার পাশে তুলে নিয়ে শিউলি ফুলের মালা পরিয়ে, আসমানি রঙের ওড়নার ঘোমটা দিয়ে তার করে নেবে।” এই বলে, অনেকটা অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবুলের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে 'না, সে তো তুমি নও, না, সে তো তুমি নও' এ কথা বারবার আওড়াতে আওড়াতে নাচতে নাচতে হাতে তালি বাজিয়ে বাজিয়ে পলকেই অদৃশ্য হয়ে গেলো।
এরপর আবুল মেয়েটিকে আর দেখেনি; এমনকি তার নামটিও জানা হয়নি তার। পরদিনই আবুল বাড়ি ফিরে এলো। ফিরে এলো অনেকটা বদলে। আবুল ভাবে রৌশনির হারিয়ে যাওয়া বিয়েবাড়ির আজব মেয়েটার পলকে উষাত হয়ে যাওয়া- এ সবই কি তার ভবিতব্য? মায়ের অসুখটা বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গিয়ে আবুলের এইসব আবোল-তাবোল চিন্তার সময়টুকুই কেজে নিলো। এখন সে সারাক্ষণ থাকে মায়ের পাশে। তার পীড়াপীড়িতে এখন ডাক্তার বদলানো হয়েছে। নতুন ডাক্তার বললেন: “এ রোগ সারবে না। এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।” সে সময়ও যে তিন দিনের বেশি হবে না, তা অন্তত আবুলেরা ভাবতেই পারেনি। সেদিন ছিলো শনিবার। সকাল থেকে আকাশটা ছিলো মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছিল, কখনো হালকা, কখনো ঝিরঝিরে, কখনো মুষলধারে। এখন বৃষ্টির সময় নয়, তাই সকলের ধারণা এক সময় থামবে। থামলো সে বিকেলে। মেঘভাঙা রোদ। কেমন সোনা সোনা রঙ। কচি ধানগাছগুলোতে লেগে থাকা বৃষ্টির পানির ফোঁটাগুলোতে এ রোদ যেন কোনো রূপসীর শ্বেত দাঁতের অনুপম হাসি। মেঘের সাথে সাথে আবুলের মনের শঙ্কার মেঘও যেন কেটে গেলো।
তার মা তার সাথে একটা-দুটো করে কথা বলছেন। অবশ্য এ কথাগুলোর মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই। কোমলমতি আবুল ধরতে না পারলেও উপস্থিত মুরুব্বিরা বুঝলেন: “এসব বিকারের বিলাপ । "বৃষ্টিভাঙা আকাশে সূর্যের বিদায়রশ্মি পূর্ব-গগনে এঁকেছে তার সাতরঙা রঙধনু। প্রকৃতি সজীব-সবুজ। সায়াহ্নের আকাশে একটি দুটি করে মুখ দেখাচ্ছে প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র, পাখিগুলো নীরবে উড়ছে আর উড়ছে, ফিরবে নীড়ে। নীড়ের টানে পাখনার ক্লান্তি সম্পূর্ণ তিরোহিত। রক্ত-শোষক মশকগুলো উঠোনের খালি জায়গায় চক্রাকারে ঘুরছে। এই চক্রের ব্যাপ্তি আকাশ ছুঁয়েছে। হঠাৎ একটি ব্যাঙের ডাকে আবুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ওখানে পাটিপাতার ঝোপে, বুনো লতাপাতায়, সন্ধ্যার অনেক আগেই রাত নেমেছে। আর তাতে উৎসবে মেতেছে জোনাকিরা। জ্বলছে নিভছে, নিভছে-জ্বলছে। নারকেল, জাম, সুপুরিগাছের পাতায় জমা বৃষ্টির পানি টপটপ শব্দ করে নিচের বুনো কচুপাতার উপর পড়ে কেমন এক বিষাদের সুর তুলছে; তার সাথে যুক্ত হয়েছে ঝিল্লিরব। যেন বিষাদের ঐকতান। আবুলের আকস্মিক মনে পড়ে গেলো তাদের কবরস্থানের কথা। শৈশব থেকে তাদের সামনের পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণটা আবুলের বড় প্রিয়। এখানে তার অগুনতি অদেখা পূর্বপুরুষ চিরনিদ্রায় শায়িত। একদিন তাকেও এখানেই ঘুমোতে হবে শেষ ঘুম।
সন্ধ্যার পর এই কবরস্থানে এসে যেন পৃথিবীর সব জুনিপোকা আলো জ্বালানোর দায়িত্ব নিয়েছে। জোনাকিগুলো দেখে তাই আবুলের তাদের কবরস্থানের কথা মনে পড়ে গেলো। সে তার ডান পাটা লম্বা করে দিয়ে তার মায়ের মাথাটা বালিশ থেকে তার ডান-উরুর উপর তুলে নিলো পরম যত্নে। তখন তার কানে এসে লাগলো মাগরিবের আজানের সুরেলা আওয়াজ। এ আওয়াজ যে তার মায়ের কানেও গেছে তা আবুল বুঝতে পারলো তাঁর আনচান ভাব দেখে। আবুল তার বোধোদয়ের পর থেকে তার মাকে দেখে এসেছে যথাসময়ে নামাজ আদায় করতে। অনেক সময় আজানের আগেই গুজু করে তিনি তসবিহ হাতে জায়নামাজে বসে যেতেন। আবুল ভাবলো: "নামাজ পড়তে না পারার যন্ত্রণায় মা এমন ছটফট করছেন।” একটু পরে কে একজন এসে আবুলের মায়ের নাকে-বুকে হাত দিয়ে দেখলেন। তারপর তাঁর ডান হাত দিয়ে আলতোভাবে আবুলের মায়ের দু চোখে হাত বুলিয়ে দিতে তাঁর চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেলো। এসবের কিছুই আবুল বুঝলো না। ঘণ্টা দুয়েক আগে তাঁকে ডাক্তার দেখে গেছেন। সরকারি হাসপাতালের পাস করা ডাক্তার। যাওয়ার সময় ডাক্তার সাহেব আবুলকে কাছে ডেকে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
আর বলেছিলেন: “ভয়ের কোনো কারণ নেই।” ডাক্তারের কথায় আবুল ভরসা করেছিলো। তাই পাড়া-প্রতিবেশীর কোনো ব্যস্ততাই তাকে শঙ্কিত করছিলো না। কিন্তু আস্তে আস্তে ভিড়টা যখন বাড়তে লাগলো, বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ বনিতা যখন সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবুলের মায়ের পাশে এসে জমতে থাকলো, তখন আবুলের টনক নড়লো। সে তখন তার মায়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলো এখনো সেখানে বেশ ওম। তখন সে তার মায়ের মাথাটা বালিশে রেখে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো। আর ছুটতে ছুটতে বললো: “আমি না ফেরা পর্যন্ত, খবরদার, আমার মায়ের গায়ে হাত দেবে না।” মনসার টেকে যাওয়ার পথে আবুল হাজরার মার পুকুরপাড়ে পেলো ডাক্তারকে। সন্ধ্যায় ডাক্তার সাহেব মনসার টেকে চেম্বার করেন। এ কথা আবুলের জানা। তাই কাউকে কিছু না বলে সে সেখানেই ছুটে গিয়ছিলো। তখনকার দিনে গাড়ি ঘোড়া ছিলো না বললেই চলে। অগত্যা অনেক দূরের স্থানও পয়দল যেতে হতো। সেদিন ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া হলো না।
আবুল গিয়ে পড়লো সটান ডাক্তারের পায়ে। ডাক্তার আবুলকে কোনো প্রশ্ন করলেন না। তিনি তার হাত ধরে বললেন: “চলো, আমি তোমার সাথে যাচ্ছি।” আবুলদের বাড়িতে পৌঁছা পর্যন্ত তিনি আবুলের হাত ছাড়লেন না। পৌঁছেই মুরুব্বি গেলো। সে তার ডান পাটা লম্বা করে দিয়ে তার মায়ের মাথাটা বালিশ থেকে তার ডান-উরুর উপর তুলে নিলো পরম যত্নে। তখন তার কানে এসে লাগলো মাগরিবের আজানের সুরেলা আওয়াজ। এ আওয়াজ যে তার মায়ের কানেও গেছে তা আবুল বুঝতে পারলো তাঁর আনচান ভাব দেখে। আবুল তার বোধোদয়ের পর থেকে তার মাকে দেখে এসেছে যথাসময়ে নামাজ আদায় করতে। অনেক সময় আজানের আগেই গুজু করে তিনি তসবিহ হাতে জায়নামাজে বসে যেতেন। আবুল ভাবলো: "নামাজ পড়তে না পারার যন্ত্রণায় মা এমন ছটফট করছেন।” একটু পরে কে একজন এসে আবুলের মায়ের নাকে-বুকে হাত দিয়ে দেখলেন। তারপর তাঁর ডান হাত দিয়ে আলতোভাবে আবুলের মায়ের দু চোখে হাত বুলিয়ে দিতে তাঁর চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেলো। এসবের কিছুই আবুল বুঝলো না। ঘণ্টা দুয়েক আগে তাঁকে ডাক্তার দেখে গেছেন। সরকারি হাসপাতালের পাস করা ডাক্তার। যাওয়ার সময় ডাক্তার সাহেব আবুলকে কাছে ডেকে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন: “ভয়ের কোনো কারণ নেই।” ডাক্তারের কথায় আবুল ভরসা করেছিলো। তাই পাড়া-প্রতিবেশীর কোনো ব্যস্ততাই তাকে শঙ্কিত করছিলো না। কিন্তু আস্তে আস্তে ভিড়টা যখন বাড়তে লাগলো, বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ বনিতা যখন সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবুলের মায়ের পাশে এসে জমতে থাকলো, তখন আবুলের টনক নড়লো। সে তখন তার মায়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখলো এখনো সেখানে বেশ ওম। তখন সে তার মায়ের মাথাটা বালিশে রেখে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো। আর ছুটতে ছুটতে বললো: “আমি না ফেরা পর্যন্ত, খবরদার, আমার মায়ের গায়ে হাত দেবে না।” মনসার টেকে যাওয়ার পথে আবুল হাজরার মার পুকুরপাড়ে পেলো ডাক্তারকে। সন্ধ্যায় ডাক্তার সাহেব মনসার টেকে চেম্বার করেন। এ কথা আবুলের জানা। তাই কাউকে কিছু না বলে সে সেখানেই ছুটে গিয়ছিলো। তখনকার দিনে গাড়ি ঘোড়া ছিলো না বললেই চলে। অগত্যা অনেক দূরের স্থানও পয়দল যেতে হতো। সেদিন ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া হলো না। আবুল গিয়ে পড়লো সটান ডাক্তারের পায়ে। ডাক্তার আবুলকে কোনো প্রশ্ন করলেন না। তিনি তার হাত ধরে বললেন: “চলো, আমি তোমার সাথে যাচ্ছি।” আবুলদের বাড়িতে পৌঁছা পর্যন্ত তিনি আবুলের হাত ছাড়লেন না। পৌঁছেই মুরুব্বি গোছের একজনের হাতে আবুলের হাতটা দিয়ে বললেন, “পরের কাজ পরে, আগে ছেলেটাকে সামলান।” এরপর আবুলের কিছুই মনে নেই।
যখন তার চৈতন্য ফেরে, তখন তার মাকে গোসল করিয়ে সুন্দর রেশমি কাপড়ে আপাদমস্তক ঢেকে তাদের সামনের কামরায় উত্তরদিকে মাথা দিয়ে পাটির উপর শুইয়ে রেখেছে। আবুল খেয়াল করলো এখন সে সম্পূর্ণ আদুল গায়ে। গায়ে গেঞ্জিও নেই। তার এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে, ডাক্তার ডাকতে যাওয়ার সময়ে গায়ে তার অত্যন্ত প্রিয় বিস্কুট রঙের টি-শার্টটি ছিলো। তার ভেতরে ছিলো একটি আনকোরা হাত কাটা গেঞ্জি। শার্টের পকেটে টাকাও ছিলো। ছিলো যা, তা নিতান্ত কমও নয়। একটু এদিক-ওদিক ঘুরতেই চোখে পড়লো শার্টটা ছেঁড়াখোঁড়া, গেঞ্জিটা ফালাফালা, মাঝের কামরায়, ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। আবুল আস্তে-ধীরে গিয়ে জামাটা তুলে নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখে, না, টাকাগুলো এর মধ্যেই হাওয়া। বোকা আবুলেরও মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলো: "হায়রে মানুষ! এই কি আমাদের মনুষ্যত্ব।” হঠাৎ তার চাচির নজর পড়ে আবুলের উপর। তিনি তাকে হাত ধরে তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলেন: 'পাগল ছেলে আমার, অমন করতে নেই। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। কাল যে তোর অনেক কাজ।”
এই বলে তিনি আবুলের মাথার লম্বা লম্বা কালো কালো চুলে পরম স্নেহে বিলি কেটে দিতে লাগলেন। তারপর আবুল বুঝতেও পারলো না কোন সময় তার ঘরে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আসন পেতে বসলো। আবুলের ঘুম ভাঙলো শেষ রাতে, কুরআন, তসবিহ ও তালিল পাঠের শব্দে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়লো বিপাকে। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তার পাশে কে একজন শুয়ে আছে। গলা থেকে হাত দুটো সরাতে গিয়ে আবুল ঘরে জ্বালানো হারিকেনের ঝাপসা আলোতে যা দেখলো তাতে তার গাটা ভীষণ গুলিয়ে উঠলো। কী করে এমন কষ্টের সময়ে তার তর্জনীর সাইজের একটা বাচ্চা মেয়ে এমন একটা জঘন্য কাজ করলো! সে তার গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে ছুটলো পুকুরে। স্নান সেরে মায়ের শয্যার পাশে এসে তার ভীষণ ইচ্ছে করলো মায়ের আত্মার শান্তির জন্যে সামান্য একটু হলেও কুরআন তিলাওয়াতের। কিন্তু আবুল ভাবলো: “আমি কি পারবো? দীর্ঘদিন আমি কুরআন স্পর্শও করিনি।
শুক্রবারে যখন আমার বন্ধুরা মসজিদ অভিমুখে, তখন আমি কোনো না কোনো সিনেমা হলের সামনে কিউতে অপেক্ষমাণ, কখন আমার পালা আসবে।” তারপরও সাহস করে একটি কোরআন শরিফ নিয়ে আবুল পরম শ্রদ্ধায় বুকে ও মাথায় ঠেকিয়ে তাতে চুমু খেলো। এবার ধুকুপুকু বুকে মায়ের শয্যার একপাশে বসে ভয়ে ভয়ে কুরআন শরিফটা খুলে অনুচ্চ কণ্ঠে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত শুরু করলো। অত্যল্প সময়ে তার সকল জড়তা কেটে গেলো। সে এখন দস্তুরমতো দ্রুতলয়ে বিশুদ্ধ উচ্চারণে উচ্চকণ্ঠে তিলাওয়াত করছে। আর মনে মনে বলছে: “মা তুমি বেঁচে থেকে যা পারোনি, আজ মরে গিয়েই তা করলে। আমি ফিরেছি মা, আমি ফিরেছি। তোমার ছোট্ট আবুল আজ থেকে বড়ো হয়ে গেলো মা, হয়ে গেলো আস্তিক। তুমি তোমার ছেলের জন্য দোয়া করো মা।” এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে আবুল ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু করেছিলো তা সে নিজেও জানে না। কেউ একজন এসে অনেকটা জোর করেই আবুলকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে চলে গেলো।
মায়ের শয্যার পাশ থেকে ওঠে আবুল কতক্ষণ দেউড়ির উত্তর-পূর্ব কোনায় দাওয়ার উপর বসে থাকলো। তারপর নিজেকে একটু সহজ করে নিয়ে সামনের পুকুরেরঘাটে নেমে নাকে-মুখে খুব করে পানির ঝাপটা দিলো। হাত-পা ধুয়ে নিলো ভালোভাবে। এমন সময় সে দেখলো একটা রিকশা এসে তাদের দেউড়ির সামনের খোলা জায়গায় থেমেছে। আর তা থেকে নামলো আবুলের মামা, মামি এবং একমাত্র মামাতো বোনটি। আবুলের সাথে তার মামির চোখাচোখি হয়, মামাতো বোনটিও তাকে দেখলো কিন্তু তাদের সাথে কোনো কথা হলো না। রিকশা থেকে নেমেই তারা সোজা অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালো। সময় কারো জন্যে বসে থাকে না। সকলেই তড়িঘড়ি করতে লাগলো। মুরব্বি গোছের একজন তো বলেই বসলেন: “আর বিলম্ব করো না। বিলম্বে শুনা হবে।” মামা কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন: "আপনারা উপস্থিত সকলেই জানেন, আমার বুবু খুব সহজ-সরল ছিলেন। সকলের কষ্ট তিনি বুক পেতে নিয়েছেন, কাউকে এতটুকুন কষ্টও পেতে দেননি। তবু তাঁর অজান্তে তিনি আপনাদের কোনো কষ্টের কারণ হলে আজ শেষ যাত্রার দিনে আপনারা তাঁকে ক্ষমা করে দিন। আমার জানা মতে না খেয়ে থাকলেও বুবু আমার কারো কাছে হাত পাততেন না। তারপরও যদি কারো সাথে তাঁর কোনো লেনদেন থাকে, আমাকে বলবেন, আমিই শোধ করে দেবো।”
আবুল দেখলো তার মামার কথায় উপস্থিত সকলের চোখে জল এসে গেলো। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। আবুলের বোনদের সাথে গলা মিলিয়ে গোটা বাড়িটাই বিলাপে মাতলো। মেয়েদের জটলার একপ্রান্তে আবুল দেখলো প্রায় জনাদশেক ভিখারিনী তাদের কাপড়ের আঁচলের খুঁট দিয়ে নীরবে চোখ মুছছে। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এসবের কিছুই আবুলের মাকে বেঁধে রাখতে পারলো না। খাটিয়ায় চড়ে তিনি চললেন, চিরশান্তির দেশে। একসময় শেষ হলো কাফন-দাফনের কাজ। একে একে সকলেই ফিরে গেলো। আবুল তার জামাটা গা থেকে খুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। তারপর কতক্ষণ সে জানে না, একদৃষ্টে মায়ের কবরটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আর ভাবছিলো: “এখানে কি মানবজীবনের সবশেষ। এরপর সবই অন্ধকার? মা কি ওখান থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছে? ঝিল্লির ঝিঁ ঝিঁ শব্দ, জোনাকির মিটিমিটি আলো, বিষ্টির রিমিঝিমি, অমারাত্রির তমসা, চাঁদের দুগ্ধ-ধবল জোছনা সব সবকিছু কি এক নিমেষেই মিথ্যে হয়ে গেলো? আমি কিচ্ছুটি জানি না মা। কেবল জানি তোমার এই পাগল ছেলেটা আজ থেকে বড় একা হয়ে গেলো। এই পাগলটার পাগলামি হাসি মুখে সহ্য করবে এমন তো আর কেউ রইল না।
বলে দাও না মা, আমি কোথায় যাবো। দ্যাখো, এখন এখানে কেউ কোথাও নেই। সব সুমসাম মা, এটি কি তোমার ইচ্ছামৃত্যু। কিন্তু কেন? বলো মা, বলো।” এমন সময় একটি তুলতুলে কোমল হাতের স্পর্শ আবুলের কাঁধে অনুভূত হলো। আবুলের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেলো। মনের গভীর গহিন থেকে জেগে আবুল যাকে দেখলো, তাকে না দেখে তার মৃতা মাকে দেখলেও এতোটা বিস্মিত হতো না। সে একজন কিশোরী, সম্পর্কে বোন, ঘনিষ্ঠ, সারা অঙ্গে রুচি আর আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ আর ওড়নায় তাকে মনে হচ্ছে একটি অনুপম হলুদ পাখি। সে মুখে কিছু বললো না, আবুলের কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে আবুলের বাঁ-হাতটা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। এবার আবুল ডুকরে কেঁদে উঠলো। কিশোরীটি আবুলকে না সান্ত্বনা দিলো, না বাধা। তবে তার দু চোখের অশ্রু অমন সুন্দর গণ্ডে দাগ কেটে মুক্তার মতো টপটপ করে ঝরতে লাগলো। না, আবুল কোনোদিন ঐ কিশোরীর কোনো পরিচয় স্পষ্ট করে কাউকেই বলেনি। কবরস্থান থেকে বাড়িতে ফিরতেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো। একেবারে আকাশভাঙা বৃষ্টি । আবুলের বৃষ্টি খুব পছন্দ। কিন্তু আজকে কী এক ভীষণ কষ্টে তার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
বারবার মনে পড়লো তার মায়ের কথা। এমন বৃষ্টির দিনে টিনের ছিদ্র দিয়ে ঘরে পানি পড়লে আবুলের মা সেখানে সানকি বসিয়ে দিতেন। আর এখন কবরে পানি ঢুকলে তার মা কীভাবে সেখানে পানি ঠেকাবেন। আবুল আর ভাবতে পারে না। তাদের বাংলো ঘরের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব কোনার দাওয়ায় বসে সে একদৃষ্টে মায়ের কবর দেখার চেষ্ট করছে, আর হাত দিয়ে নিজেই নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে। এমন সময় তার এক দূর সম্পর্কের ফুফা আবুলকে ঘরে ডেকে পাঠালেন। আবুলের বাবার বিশাল পালঙ্কে অনেকেই বসে আছেন। এঁরা সব আবুলের বাবার পক্ষের কোনো না কোনো আত্মীয়। আবুল ঘরের অন্দরে-বাইরে আতিপাতি করে দেখলো, না, কোথাও মামাবাড়ির কেউই নেই। যে ফুফাটা আবুলকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনিই শুরু করলেন। বলতে লাগলেন, “দেখো, তুমি এখনো পড়ছো।
শুনেছি তোমার মাথাও নাকি খুব ভালো। পরিচর্যা পেলে অনেক দূর যাবে। তোমার পিঠেপিঠি ভাইটি এখনো যথেষ্ট ছোটো। আর যে বোনটি ঘরে আছে সে তো এখানো মাটির সাথে কথা বলছে। তাকে দিয়ে তোমাদের ঘরকন্না চলবে না। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্যে তোমাদের মাথার উপর একজন অভিভাবক অপরিহার্য। এ অবস্থায় তোমার বাবার আবার বিয়ে করা বৈ অন্য কোনো গতি নেই। তাই আমরা স্থির করেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বাবার আবার বিয়ে দেবো। না হলে তোমাদের সংসারটা শিয়াল-কুকুরের আবাস হবে। এখন বলো তোমার মত কি?” আবুলের মুখে কোনো রা সরলো না, সে তার ফুফার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। তারপর সে গুমরে কেঁদে ওঠে একরকম দৌড়েই বাইরে বেরিয়ে গেলো।