চেনা পথ অচেনা পথিক, লেখক: এম.এ. কাশেম। (৩য় পর্ব)
এখন বর্ষা নয়,
শরৎ। মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ঝিল সব কিছু বর্ষার জলে টইটম্বুর। এ সময়
আকাশে মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলায় মর্ত্যে বসে আলো-ছায়ার মহামেলা। পেঁজা
তুলোর মতো মেঘখণ্ডগুলো কী এক আনন্দে শূন্যে খায় লুটোপুটি। কাশবন কাশফুলে সাদা,
ধানগাছ কোনোটা কচি,
কোনোটা পোয়াতি দুলছে
মৃদু-মন্দ বাতাসে, পথের দূর্বা,
ডাঙার তরুলতা সজীব-হরিৎ।
গোটা প্রকৃতিতেই প্রাণের ছোঁয়া। এ ছোঁয়ায় চঞ্চল প্রজাপতি, উচ্ছল প্রাণীকুল। শরতের রাত যেন স্বপ্নীল
চাঁদোয়ায় ঢাকা এক পরীর দেশ। এ দেশ আবুলকে দেয় নিত্য হাতছানি। অক্ষম আবুল কেবল
এর ছবি আঁকে মানসপটে। হাতের তুলিতে, কলমের আঁচড়ে তার স্বপ্নের রাত, আর আনন্দের দিনকে দেবে অক্ষয় মূর্তি, সে শক্তি তার নেই।
কিন্তু এবার হলো
মুশকিল। ভাদ্রেই যেন ভরা আষাঢ়। আবুলের মায়ের কাফন-দাফনের পর প্রথমে ঝিরঝিরে
বৃষ্টি, তারপর শুরু হলো মুষলধারে।
আবুলের মনে হলো এ যেন আবুলের মায়ের মৃত্যুতে প্রকৃতির শোক প্রকাশ । তবে তাই বলে
আবুলের বাবার বিয়ের তোড়জোড়ও থেমে থাকলো না। বৃষ্টির সাথে সমান তালে চলছে বিয়ের
আয়োজন। এ বৃষ্টি মাথায় আবুলের বাবার বিয়ে হয়ে গেলো। বরযাত্রীতে আবুলও ছিলো।
ছিলো তার ছোটো মামাও। হাঁটুর সমান কাদা মাড়াতে গিয়ে তাঁর ডান পাটা মচকে গেলো।
তিনি আর দুজন বরযাত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ে থেকে
ফিরে তাঁকে এক মাস বিছানা নিতে হয়েছিলো। বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন আবুলের বাবা। সাথে
চার-ছয় বছরের একটি পুত্রসন্তান পেলেন যৌতুক। বউয়ের গায়ের রঙ উজ্জ্বল 'শ্যাম' । মুখশ্রী কমনীয় । হালকা-পাতলা গড়ন। বয়স এক্কেবারে কম। আবুলের চেয়ে বড়জোর
বছর দুয়েকের বড় হবে। নিতান্ত গরিব ঘরের মেয়ে। বাবা-মার বড় সন্তান। তারপরে আরো
পাঁচ-ছয়টি বোন এবং একটি ভাইও আছে। উপরন্তু আগে একবার বিয়ে হয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে
গেছে। সে ঘরের একটি ছেলে আছে। তাকেই আবুলের বাবা
যৌতুক পেয়েছেন।
তবে শোনা যায় এই কচি বউটার জন্য আবুলের বাবার ট্যাকের গুচ্ছের টাকা হাতবদল
হয়েছে। বউ এলো ঘরে, বৃষ্টি এলো জোরে।
দিন নেই, রাত নেই। বৃষ্টি,
বৃষ্টি আর বৃষ্টি। এর
সাথে যোগ হলো পুব পাহাড়ের পাহাড়-ধোয়া ঢল। শ্রমতি খালের তীর উপচে ঢলের জল এসে
চানখালী পেরিয়ে আবুলদের সমতলে দিলো হানা। প্রথমে ধানি জমি, তারপর বড় রাস্তা ডুবে ডুবলো বাস্তুভিটা। ঘরের
মধ্যে হাঁটু পানি। সামনের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে মাঝামাঝি উঁচু ঢিবির মতো একটা
জায়গা আছে। কোনো বন্যাতেই ঐ ঢিবিটা ডোবেনি। তাই গোটা বাড়ির মানুষের ভরসা উঁচু
জায়গাটা। আগে অবশ্য পুকুরের চারটি পাড়ই সমান উঁচু ছিলো। কিন্তু উঁচু জায়গায়
ধানের বীজতলা তৈরি করতে গিয়েই পুকুরটার এই দশা। আর বন্যা? আবুল তার বাচ্চা বয়স থেকে দেখে এসেছে
পুব-পাহাড়ের ঢলে প্রতি বছর পানি এসে জমে আবুলদের সমতলে, তারপর আর বের হওয়ার নামগন্ধ থাকে না। এ জলে ঘর
ভাঙে কৃষকের, পচে গলে একাকার
হয় পোয়াতি ধানের গাছ, পুকুরের পাড়
ডোবে, পুকুর হয় মাছশূন্য
ক্ষেত্রবিশেষে পানিতে ডুবে মরে হালের বলদ; তাই বন্যার পরে নেমে আসে ছদ্ম-দুর্ভিক্ষ। যে জমির ধান পচে, তা নতুন করে আবাদের সময় থাকে না আর। এখন অবশ্য
আবুলদের এলাকা বন্যার শঙ্কা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মাস্টার শামসু মেয়র থাকাকালীন
সময়ে শ্রমতি খালে বাঁধ দিয়ে বন্যা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করে গেছেন।
আবুলদের
বাংলোঘরটা বাঁশের বেড়ার। বন্যার পানিতে ভেঙে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। আবুলের বাবা
নতুন বউকে নিয়ে সেখানে উঠলেন। তারপরও বিপদ-আপদের কথা ভেবে পুকুর পাড়ের উঁচু ঢিবিটায়
অন্যদের পাশাপাশি আবুলেরাও একটা টঙ বাঁধলো। বাঁশ, গাছের ঠুনি, টিনের বেড়া আর ছাউনি দিয়ে মোটামুটি মজবুত
একটা টঙ। আবুলেরা যতক্ষণ ঘরে ছিলো পানি উঠলেও দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু
যেই মাত্র প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো, সাথে সাথেই দেয়ালগুলো ঝুপ ঝুপ শব্দে ভেঙে ভেঙে
পড়তে লাগলো। ময় মুরব্বিদের মুখে আবুল অনেকবার শুনেছে যতক্ষণ নাকি ঘরে ঘরের মালিক
থাকে ততক্ষণ নাকি ঘর ভেঙে পড়ে না। অবশ্য আবুল এ কথার কোনো বিজ্ঞান কিংবা
যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি।
কথাগুলোকে কথার কথা
বলে ধরে নিয়েছে। ফলতে দেখে বিস্মিত হয়েছে, বিশ্বাস করেনি। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না।
বৃষ্টি ধরে এলো।
বন্যার পানিও কমতে শুরু করলো। বানভাসি মানুষগুলোর মনে আস্তে আস্তে ফিরে আসতে লাগলো
স্বস্তি। আবুলের এসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই । সে এখন মশগুল তার ভেলা নিয়ে। কলাগাছ
আর বাঁশ ও তক্তা দিয়ে তৈরি ভেলা। বৃষ্টি ধরলেও এখনো চারদিকে পানি থৈ থৈ। কেবল
মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো বাড়িগুলো একটু-আধটু দেখা যাচ্ছে, অবশিষ্ট সবটাই পানি, পানি আর পানি। সমতলের মানুষ আবুলেরা এমন পানি
সচরাচর দেখে না। তাই দিগন্ত-বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে ভেলা নিয়ে আবুলদের খেলা। কেউ
কেউ প্রয়োজনে আর আবুল নিছক মনের আনন্দে বাঁশের লগি নিয়ে ভেলায় করে ভেসে পড়লো
যেন কোন অজানায়। নিচে আবুলের ভেলা, মাথার উপরে রোদভাঙা সাদা মেঘের ভেলা, দুটোতে যেন চলছে দিগন্ত ছোঁয়ার এক মহাপাল্লা। ভাসছে আবুল মেঘের ছায়া দেখে
দেখে। কখন যে সে চোরাবিলের অর্ধেকটা পাড়ি দিয়ে, মনসাপুকুর ঘুরে, ওয়াসিমের দিঘির পশ্চিম পাড় ছুঁয়ে
চৌধুরীবাড়ির পুব পাশের বিলের মাঝামাঝি এসে পড়েছে, তা সে নিজেই জানে না। যখন সে তাদের টঙের সামনে
থেকে ভেলা জলে ভাসিয়েছে, তখন মেঘভাঙা
আকাশে সূর্য ঠিক মাথার উপর, আর এখন পশ্চিম
গগনে আস্তপারে মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সে লজ্জারাঙা নববধূটির মতো। তার আবিরের পরশ
পেয়ে কেমন রঙিন আকাশের মেঘ, বানভাসি পানির
উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সবুজ আর দিগন্ত বিস্তৃত থৈ থৈ রুপালি জলরাশি।
যার ছটা এসে পড়েছে আবুলের চোখেমুখে, রাঙিয়ে দিয়েছে তার মন। এমন বিকেল মানুষের জীবনে ফিরে না বারবার- এমন যখন
ভাবছে আবুল, তখন তার চোখ দুটি
আটকে যায় এক অবর্ণনীয় দৃশ্যে। পশ্চিমের অন্তপ্রায় দিনদেব তার সমস্ত অনুরাগ ঢেলে
দিয়েছে চৌধুরীবাড়ির সর্ব দক্ষিণ-পুবের ঘরটিতে। ঘরের আশপাশ পুরোটাই বানের পানিতে
ডোবা। ছোটোখাটো গাছপালাগুলোও পানির তলায়, দুয়েকটা বনস্পতির ঝাঁকড়া মাথা দেখা যাচ্ছে। যেন কোনো ষোড়শী রূপসীর মাথার
ঘন-কুন্তল স্নানের ছলে ভাসিয়ে দিয়েছে জলে। তারই একটির ঠিক মাঝ বরাবর কল্পনার
মৎস্যকুমারী বাস্তবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। তার অর্ধেকটা পানির উপরে, বাকিটা দেখা যাচ্ছে না। তার পিঠের দিকে ডুবন্ত
সূর্যের রক্তিম আলো পড়ে একটি ছায়াদেহ সৃষ্টি করেছে। এ দেহ আবছা কিন্তু এর আছে এক
স্পষ্ট অবয়ব। যা চোখ টানে, মন কাড়ে।
অবিশ্বাসে বিশ্বাসের দোলা জাগায়। বোকা আবুলের কণ্ঠে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে 'অসম্ভব'। নিজের অজান্তে তার হাতের লগি চলে দ্রুত। ভেলা তার ভাসে পশ্চিমের দিকে। সে
জানে না কোথায় তার মনজিল। আচম্বিত টুপ করে ডুব দেয় সূর্য। আঁধারের কালো চাদরে
ঢাকা পড়ে চারদিক। এই আধারে অদৃশ্য হয়ে যায় ছায়াদেহটি। আবুল এক সমুদ্দুর
অতৃপ্তি নিয়ে টঙে ফেরে। না, তার জন্য কোনো
উৎসুক চোখ পথ চেয়ে বসে নেই। এমন দুর্যোগে এখনো ছেলেটি বাড়ি ফিরলো না বলে নেই
কারো অনুযোগ। তার অজান্তেই দু ফোঁটা অশ্রু টপ টপ করে ঝরে পড়লো। রাখলো না কোনো
চিহ্ন। বন্যার অথৈ পানিতে মিশে একাকার হয়ে গেল।
পরদিন পানি আরও
কমেছে। তবে এখনো বড় রাস্তায় গলাপানি। চারদিক থৈ থৈ সমুদ্দুর। বেলা দ্বিপ্রহর হতে
না হতেই কী এক চৌম্বকীয় আকর্ষণে আবুল আবার তার ভেলা ভাসালো বন্যার ঘোলাপানিতে।
এবার আর এদিক ওদিক ঘোরাফেরা নয়, মনজিল তার জানা;
হাতের লাগি তার ঠিকানা
খুঁজে নিতে ব্যস্ত। ঝপাং ঝপাং শব্দে নিঃশব্দে লগি চালাচ্ছে আবুল আর তড়বড় করে
ভেসে চলছে তার ভেলা। চৌধুরীবাড়ির বড় পুকুরের মাঝ বরাবর দিয়ে দক্ষিণ-পারের
মসজিদের পাশে ছুঁয়ে সোজা দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের প্রান্তিক ঘরটির উঠোনে গিয়ে
আবুলের ভেলা থামলো। ঘরটি তার বড্ড চেনা। বাঁশের বেড়া, টিনের ছাউনি। শক্তপোক্ত। বন্যার পানিতে ডুবেছে,
কিন্তু ভাঙার কোনো আশঙ্কা
নেই বলে চৌকির ওপর চৌকি দিয়ে ঘরের মানুষ ঘরেই থেকে গেছে। এ ঘরে সাকুল্যে তিনজন
মানুষের বাস। কালাম, আবুলদের তিন-চার
বছরের সিনিয়র ভাই, স্কুল একাদশের
সেরা স্ট্রাইকার; বাবার মৃত্যুতে
সংসারের হাল ধরেছে। খেলা ছেড়ে বিয়ে করেছে। বাবার একমাত্র সন্তান। অগত্যা আর কোনো
উপায় ছিলো না। বাবার রেখে যাওয়া জোত-জমির সাথে এজমার টানটাও পেয়েছে
পৈতৃকসূত্রে। বউটা সুন্দরী, বিদুষী। আপন
মামার মেয়ে। সুরুচিসম্পন্না। বিয়ের কদিনের মধ্যেই পাড়ায় তার যথেষ্ট সুনাম
ছড়িয়েছে। আবুলের সাথেও বেশ ভাবসাব। আর কালামের 'সৎ মা'। আক্ষরিক অর্থেই 'সৎ'। আবুল জেঠী বলে ডাকে। উঠোনের মাঝখান থেকে ভেলা
হতেই আবুল চেঁচিয়ে ডাকলো: “জেঠীমা আছেন?” দরোজার কবাট খোলে, গলাটা বাড়িয়ে,
কালামের মা ভেলার উপর
আবুলকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন! ধাতস্থ হতে কতক্ষণ সময় নিলেন। তারপর বললেন:
“দ্যাখ, দ্যাখ পাগল ছেলের কাণ্ড
দ্যাখ। এমন দুর্যোগে কেউ ঘর থেকে বের হয়!”
এমন সময় আর দুটো
কৌতূহলী চোখ কালামের মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিলো। আবুলের মনে হলো এ দুটো
চোখ সে অনেক দিন ধরে চেনে। কিন্তু পলকেই আবার তা অদৃশ্য হয়ে গেল। কালামের মা কিছু
বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। ভেতর থেকে কালামের বউয়ের কণ্ঠ শোনা গেলো। আবুলেরা তাকে
কালাম ভাবি বলে ডাকে। তিনি বললেন: “কীরে আবুল, এই বানভাঙা পানিতে কীসের সন্ধানে ভাই!"
"অভিসারে গো ভাবি অভিসারে” এই বলে আবুল আর দাঁড়ালো না, ভেলার লগিতে দিলো টান। ভেলা ছুটলো
দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির উপর দিয়ে। আর আবুলের অবচেতন মন বারবার জানতে চাইলো,
“চোখ দুটো কার; কার চোখ দুটো?”
দেখতে দেখতে
বন্যার পানি নেমে গেলো। স্বাভাবিক হয়ে এলো সবকিছু। টং আর বাংলো ছেড়ে সকলেই
বড়ঘরে উঠলো। কেবল আবুলেরা ছাড়া। তারা বাংলোতেই থেকে গেলো। আবুল, তার ছোট বোন আর ভাইটিকে নিয়ে বাংলোর উত্তর
পাশে একটি খাটে, নতুন বউকে নিয়ে
আবুলের বাবা, আবুলের মায়ের
বড় খাটটায় দক্ষিণ পাশে তাঁর সংসার পাতলেন। দেখে আবুলের হৃৎপিণ্ডটা দুমড়ে-মুচড়ে
ওঠলো। আবুলের কচি মনে একটা সন্দেহ ক্রমশ দানা বাঁধছে। মায়ের তার স্বাভাবিক মৃত্যু
নয়, এ যেন ইচ্ছামৃত্যু ।
কিন্তু কেন? এর বেশি আবুল আর
ভাবতে পারে না। যখন তার মায়ের জায়গায় আরেকজনকে দেখে, তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নিজের
মাথার চুল নিজে হেঁড়ে। ইচ্ছে করে ডাইনিটাকে টেনে-হিচড়ে ঘরের বাইরে বের করে দেয়।
কিন্তু অক্ষম আবুল কিচ্ছুটি করতে পারে না। তাই সারাক্ষণ বাইরে বাইরে ঘোরে।
দু দিন বাসে তার
কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষা। ঘরে নেই পড়ার পরিবেশ, মনে নেই শাস্তি। উপরন্তু তার বড়বোনেরা তার
মনের আগুনে দিচ্ছে ঘৃতাহুতি। আবুল এখনো যাকে কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারলো না,
তাঁরা মেয়েটির অন্তত
পাঁচ-দশ বছরের বড় হয়েও কেমন ম্যা ম্যা করে ডাকতে শুরু করলো তা আবুল কিছুতেই
বুঝতে পারলো না। কাজের মধ্যে এই হলো, আবুলের ক্রোধ সপ্তমে চড়লো। সে বোনদেরও এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। সে মনে মনে
ভাবলো মা কি কেবল তারই মা ছিলো?
সময়টা বড়
নিষ্ঠুর, বড় নির্মম।
নিজের পথে সে নিজেই সচল। কারো দিকে দৃকপাত করার এতটুকুন অবকাশ নেই তার।
জন্ম-মৃত্যু সবকিছুতেই সে নির্মোহ। আবুলের মা মরলেন বলে একটু সময় দাঁড়াবে সে
সময় সময়ের নেই। কী করে যেন আবার সব ঠিকঠাক চলতে শুরু করলো। আবুলও শুরু করলো কলেজে
যেতে। কলেজের অনেকেই তার মায়ের কথা জানে না। আবুলও গায়ে পড়ে কাউকে নিজের দুঃখের
কথা বললো না। তবে আবুলের অনুপস্থিতিতে কলেজে অনেক মজার ঘটনা ঘটে গেছে।
এতদিন আবুল ছিলো ‘বিজ্ঞান পরিষদ' কলেজ শাখার
মনোনীত জিএম। “মনোনীত নয় নির্বাচিত পরিষদ চাই" বলে হুল্লোড় তুললো আলী আকবর
সিদ্দিকী নামের এক উচ্চাভিলাসী ছাত্র। আর দলেও পেলো কয়েকজনকে। সাদা মনের মানুষ
পরিষদের চেয়ারম্যান রসায়ন বিভাগের মোজাম্মেল স্যার ছাত্রদের দাবিকে সম্মান
জানিয়ে নির্বাচন দিলেন। আলী আকবর সিদ্দিকীর অনেক গাইগুই সত্ত্বেও অনুপস্থিত
আবুলকেও জিএম পদে নমিনেশন দেওয়া হলো। আলী আকবর সিদ্দিকীসহ এ পদে প্রার্থী হলো
তিনজন। অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়ে গেল। ভোট গণনার পূর্বে সিদ্দিকী
তার দশ-বারোজন সমর্থক নিয়ে বিজয় মিছিল বের করলো। তবে ফলাফল ঘোষণার পর সে নিজে
এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা এমনভাবে কলেজ ছাড়লো, গোটা সপ্তাহে তাদের টিকিও কেউ দেখতে পেলো না।
কাস্টিং ভোটের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভোট পেয়ে আবুল আবার কলেজ শাখা বিজ্ঞান
পরিষদের জিএম নির্বাচিত হলো। এ সবকিছুই আবুল মেরীর কাছে শুনেছে। শুনতে শুনতে নিজের
অজান্তেই আবুল বাচ্চা ছেলের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অশ্রুভেজা কণ্ঠে সে কেবল
বললো: “ মেরী, আমার মা আর নেই।”
নিমেষেই যেন কেয়ামত হয়ে গেলো। আবুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আবিষ্কার করলো,
তার ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা
মেরীর উষ্ণ নরম বুকে; মেরী পাগলের মতো
তার মাথায়, মুখে, পিঠে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আবুল,
বিস্ময়াহত আবুল কেবল
ভাবলো: “ একেই কী বলে শাশ্বত জননী।”
আবুলদের বাংলার
স্যার ছিলেন দুজন। তাদের একজন হানিফ স্যার। ভীষণ সহজ-সরল। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে
মিশতেন সতীর্থের মতো। একটু হালকা একটু চটুল প্রকৃতির যুবক। বিয়েথা করেননি।
সারাক্ষণ মুক্ত বিহঙ্গের মতো কলেজ ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখতেন। গোটা কলেজের
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে তিনি একটা কালচারাল প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন, সম্পূর্ণ স্ব-উদ্যোগে। আবুল এসবের কিছুই জানতো
না। মাঝে-মধ্যে কবিতা লেখা। ছাড়া কালচারের ‘ক'-এর সাথেও আবুলের কোনো সখ্য ছিলো না। ছিলো। না,
কারণ আবুলদের সময়
এলাকাটা মুসলমান ছেলেমেয়েদের নিকট ছিলো। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গুটি কতেক আলোকপ্রাপ্ত
পরিবারের ছেলেমেয়েরা ছাড়া বারোয়ারিভাবে মুসলিম ছেলেমেয়েদের এ এলাকায়
গতায়াত ছিলো না বললেই চলে। তারপরও আবুল অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলো। হাজির হলো
সদলবলে। এদিকে নির্বাচনের হারার পর সিদ্দিকী ও তার দলবল তক্কে তকে ছিলো। কীভাবে
আবুলকে বাগে পায়। সিদ্দিকী আবুলকে কলেজের হরেক কাজে দেখেছে, কিন্তু দণ্ডের জন্যেও কোনোদিন বক্তৃতা মঞ্চে
দেখেনি। তাই সে অনুমান করে নিলো বক্তৃতা আবুলের ধাতে নেই। বাস্তবেও তাই। সুযোগটা
নিলো সে। প্রতিযোগিতার যতগুলো বিষয় ছিলো তার মধ্যে একটি 'উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা। আবুলের অজান্তে
সিদ্দিকী এ বিষয়ে প্রতিযোগীদের তালিকায় আবুলের নামও তালিকাভুক্ত করে দিলো।
উদ্দেশ্য ভরা মজলিশে আবুলকে অপদস্থ করা। যথাসময়ে উপস্থিত প্রতিযোগিতার পালা আসলো।
সঞ্চালক প্রতিযোগীদের পূর্বপ্রস্তুতির জন্যে গোটা তালিকা একবার পড়ে গেলো। তালিকার
প্রথম নামটি আবুলের। আবুল ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়াতে গেলেই তার বন্ধুরা তাকে হাত ধরে
বসিয়ে দিলো। তারপর পরামর্শ শুরু হলো কী করা যায়। নারায়ণ আবুলদের বন্ধু, শারীরিকভাবে ছোটোখাটো কিন্তু ভীষণ বিচক্ষণ। সে
বললো: “কুছ পরওয়া নেহি। যাবি শার্দুলের মতো মাথা উঁচু করে। বরাদ্দ কাগজ টানবি।
পড়ে দেখার প্রয়োজন নেই। যেন অন্যমনস্ক, এমনভাবে ছিঁড়ে ফেলে দিবি। তারপর তোর বিষয় ঘোষণা করবি: চট্টগ্রামের আঞ্চলিক
গালিগালাজ। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।” তারপর নারায়ণ সকলের দিকে তাকিয়ে বললো: “আমার
পুঁজিতে যা আছে আমি লিখে দিচ্ছি, তোদের সঞ্চয়গুলো
কাগজে লিখে আবুলকে দিয়ে দে, দেখি ব্যাটা
‘সিদ্দিকী’ যায় কোথায়।” অবশ্য আবুল এই সব কিছুই করলো না। পাঠ্য বইয়ের বাইরের
পঠন-পাঠনের জোরে সে বেশ ভালোভাবেই উতরে গেলো। আবুলের পালা এলে সে ধীরেসুস্থে মঞ্চে
গেলো। একটা 'বিষয় লেখা'
কাগজ টানলো। তার ভাগ্যে
পড়লো “অর্থই অনর্থের মূল"। সে দিন সেখ কী বলেছিলো তার একটি শব্দও মনে নেই।
কেবল এইটুকু এখনো তার স্মৃতিপটে অম্লান: গোটা হল ঘরটাই যেন দাঁড়িয়ে হাততালিতে
তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলো। হাততালি শেষ হওয়ার আগেই সিদ্দিকী তার দলবল নিয়ে
অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে। প্রতিযোগিতার ফলাফল হাততালির অনুকূলেই গিয়েছিলো। ফোর্থ
ইয়ারের তুখোড় বাগ্মী নিবেদিতা বড়ুয়াকে পিছন ফেলে আবুলই প্রথম হলো। বক্তৃতায়
আবুলের সেই প্রথম, তারপর পেছনে
তাকাতে হয়নি আর।
কলেজে নির্বাচনী
পরীক্ষা হয়ে গেলো। প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে আবুল পরীক্ষায় বসলো এবং বেশ ভালোভাবে
উতরে গেলো। ফরম পূরণের টাকা সংগ্রহে কোনো সমস্যা না হলেও 'প্রবেশপত্র' নেয়ার সামান্য কটা টাকা আর কিছুতেই জোগাড়
হচ্ছে না। আবুলের বাবার সাফ জবাব তাঁর কাছে কানাকড়িও নেই। বিয়ের পর থেকে আবুল
তার বাবার ভিতর কেমন একটা পরিবর্তন লক্ষ করলো। তা আরও জটিল হয়ে উঠলো আবুলের
কারণেই। বড়-ছোটো সকলেই আবুলের বাবার বউকে মেনে নিলেও আবুল কিছুতেই মেনে নিতে
পারলো না। তাকে কিছু বলেই সম্বোধন করে না। একই ঘরে রাত্রিযাপনের সুবাদে আবুলের
বাবা এবং সৎ মায়ের অনেক কথা আবুলদের কানে আসে। আর তারা নীরবে অশ্রু বিসর্জন বৈ আর
কিচ্ছুটি করতে পারে না। লজ্জায় এ কথাগুলো কারো সাথে শেয়ার করতেও বাধে। তা পারলে
হয়তো মনের অনেকটা কষ্ট লাঘব হতো। একদিন ভোর-রাতে আবুলের কানে আসে তার সৎ মায়ের
চাপা কণ্ঠ। তিনি অনেকটা আবদারের ঢঙে আবুলের বাবাকে বলছেন: “আর কেন, এবার তুমি বাড়ি চলে আসো। তোমার ছেলে বড়
হয়েছে তাকেই কোনো একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দাও। লেখাপড়া করে কোন জজ-ব্যারিস্টার
হবে। আর হলেও তাতে আমাদের কী। কী বেয়াড়া ছেলেরে বাবা।"
আবুল তার বাবা কী
জবাব দেন, তা শোনার জন্য
উৎকর্ণ হয়ে থাকলো। না, ভালো-মন্দ কিছুই
বললেন না তিনি। সকাল হতেই জামাটা হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। সে বেশ বুঝতে পারলো,
এখানে আর থাকা চলবে না।
পড়ালেখা করতে চাইলে আগে একটা নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন। কোথায় পাবে সে এ আশ্রয়,
আবুল তা জানে না। ভবিতব্যের
হাতে তা ছেড়ে দিয়ে আপাতত পরীক্ষার প্রবেশপত্র তোলার টাকা সংগ্রহের চিন্তাটাই
মাথায় নিলো। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে
সে। কী করে বলবে বাবা তাকে প্রবেশপত্র তোলার টাকা দিচ্ছে না। অসহায় আবুলের
একমাত্র সম্বল অশ্রু, তাই সে নীরবে
বিসর্জন করছে। আবুল সাতসকালে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমে কবরস্থানে গিয়ে মায়ের কবরের
পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো, তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে আপন মনে
বড়ুয়াপাড়ার দিকে হাঁটতে লাগলো। চৌধুরীবাড়ি থেকে উত্তর-দক্ষিণ যে রাস্তাটা
বড়ুয়াপাড়ার দিকে গেছে, আবুল এখন সে
রাস্তাটা ধরে হাঁটছে। রাস্তাটার মাঝামাঝি এক চিলতে পোড়োভূমি । সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত,
কিছুটা উঁচু। কয়েকটা
ঝোপঝাড় আর একটি প্রাচীন অশত্থ গাছ জায়গাটকে কেমন একটা জংলা জংলা রূপ দিয়েছে।
কথিত আছে কোনো এক সময় এ জায়গাটা বড়ুয়াদের 'চিতা' ছিলো। এখনও মৃতশিশুদের এখানে কবর দেওয়া হয়। তাই এ জায়গাটায় আসলে কেমন একটা
ভয় ভয় ভাব জাগে। আজ অবশ্য আবুলের মনে ভয়-ডর কিছু নেই। ঘাসগুলো এখনো শরতের
শিশিরে ভেজা। পুবদিগন্তে দিনের দেবতা উঁকি দিচ্ছে। অনেক দূরের গ্রামের গাছপালার
ফাঁকফোকর গলে তার কোমল রশ্মি বানভাসি ধানিজমিতে লুটিয়ে পড়েছে। যার এক ফালি এসে
পড়েছে আবুলের নাকে-মুখে। আবুল আর হাঁটলো না, মন্ত্রমুগ্ধের মতো অশখের একটা মোটা শিকড়ে বসে
পড়লো। তার পিছনে আগাছায় ভরা পোড়োজমি, সামনে দিগন্ত-বিস্তৃত ধানিজমি। বানের পানিতে সবুজ ধানের গাছ পচে জমির সাথে
লেপ্টে গেছে। অবশ্য মাঝে মধ্যে পচা ধান গাছের গোড়া থেকে দু-এক গাছি সবুজ পাতা
উঁকি দিচ্ছে। অনেক সময় মরা ধানগাছের গোড়া থেকে গজানো গাছগুলোই বেচারা কৃষকদের
নিশ্চিত উপোসের হাত থেকে বাঁচায়। আবুল ভাবছে, সেও তো এক বানভাসি মানুষ, সে বন্যায় তার সব সুখ, সব স্বপ্ন ভেসে গেছে। এখন তাই সে খড়কুটো
খুঁজছে, যার আশ্রয়ে সে আপাতত
রক্ষা পাবে।
নিজের চিন্তায়
এতটাই মশগুল ছিলো যে আবুল বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণ খুইয়ে বসেছিলো। অকস্মাৎ একটি শব্দে
সে এতোটাই চমকে উঠলো যে, সে বসা থেকে
দাঁড়িয়ে গেলো। একটু ধাতস্থ হয়ে বুকে থুথু ছিটিয়ে সামনে যাকে দেখলো, তাতে ভয়ও পেলো, ভরসাও পেলো। ভয় পেলো এই ভেবে যে, এখন এর এখানে আসার কথা নয়। জায়গাটা খুব একটা
ভালো নয়। কোনো অশরীরী আত্মা নয় তো? আর ভরসা পেলো এই ভেবে, তার বর্তমান
সমস্যা থেকে কেবল এ-ই উদ্ধার করতে পারেন তাকে। হয়তো আবুলের অবচেতন মনে এঁরই কথা
সুপ্ত ছিলো। আবুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মোজাহের। বড়ুয়াপাড়া পেরিয়ে, আরাকান সড়কের উত্তর পাশে তাদের বাড়ি। এদিক
দিয়ে তাদের সচরাচর গতায়াত নেই। মোজাহেরকে আবুল ‘মোজাহের বদ্দা' বলে ডাকে। সে সরাসরি আবুলের দিকে তাকিয়ে তাকে
প্রশ্ন করলো: “কী রে, তোর কী হয়েছে? এই সাতসকালে চিতায় এসে বসে আছিস?” আবুল ফ্যাল ফ্যাল করে মোজাহেরের মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকলো, কিচ্ছুটি বলতে
পারলো না। মোজাহের আবুলের কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললোঃ সমস্যা? তুই আমাকে বল?” মোজাহেরের স্নেহমাখানো কথায় আবুল আর নিজেকে
ধরে রাখতে পারলো না। কষ্টে আর অপমানে সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আবুলের সব কথা শুনে
মোজাহের বললো: “যতই কষ্ট হোক, পরীক্ষায় তোকে
বসতে হবে। একই মায়ের পেটে না জন্মালে বুঝি ভাই হওয়া যায় না? তোর মায়ের অনেক স্নেহ আমি পেয়েছি, আজ তা শোধ দেয়ার সময় এসেছে। আমি বেঁচে থাকতে
তোর কোনো সমস্যা হবে না। চল, ওঠ বাড়ি যাবি।
মনের কষ্ট মনের মধ্যে কবর দিয়ে দে। কোমর বেঁধে পড়তে বসে যা। এই নে টাকা। আজকেই
গিয়ে প্রবেশপত্র নিয়ে আসিস।"
যথাসময়ে
পরীক্ষায় বসলো আবুল। তিন বিভাগে মিলে প্রায় হাজারের কাছাকাছি পরীক্ষার্থী ।
বাংলা 'প্রথম পত্র' প্রথম পরীক্ষা। আবুলের আশাতীত ভালো হলো।
পরীক্ষার তোড়ে মনের সকল কষ্ট তিরোহিত। এখন কেবল একটাই চিন্তা কীভাবে পরীক্ষায়
ভালো করা যায়। আশপাশের সবকিছু বেমালুম বিস্মৃত হয়ে আবুল পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আদাজল খেয়ে লাগলো ।
কিন্তু বিধিবাম, পরদিন পরীক্ষা
দিতে গিয়ে সব খুইয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলো আবুল। এই যন্ত্রণা মাতৃবিয়োগের
যন্ত্রণাকেও ম্লান করে দিলো ।
আবুল আগে থেকে
জানতো কলেজে শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের মধ্যে দুটি সুস্পষ্ট গ্রুপ রয়েছে। এদের
মধ্যে নিরন্তর ঠান্ডা যুদ্ধ বিদ্যমান। কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের দলে টানার
অপপ্রয়াসও স্পষ্ট। বিশেষত পরবর্তী ‘অধ্যক্ষ’ কে হবেন, তা নিয়েই চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব। কিন্তু
দ্বন্দ্বের বিষফল এমনি করে হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জীবনটাকেই নষ্ট করে দেবে কে
ভেবেছিলো । পরদিন ছিলো বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। এ বিষয়ে আবুলের প্রস্তুতি
খুব ভালো। পরীক্ষার দেড় ঘণ্টায় আবুলের সত্তর ভাগ উত্তর লেখা শেষ । এমন সময় একট
হুলুস্থুল তার কানে এলো। চারদিকে কাট-কাট, মার-মার শব্দ, ছাত্র-ছাত্রীদের
এলোপাতাড়ি পৌড়াদৌড়ি, টুল-টেবিল ভাঙার
বিকট আওয়াজ, ইট-পাটকেল ছোড়ার
ভীতিপ্রদ দৃশ্য দেখে, আবুলের হাত চলে না। এমন সময়
হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রসায়নের মোজাম্মেল স্যার। তিনি আবুলের পাশে দাঁড়ালেন
এবং বললেন: “তোমার কোনোদিকে কান দিয়ে কাজ নেই। আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়েছি,
তোমার কোনো ভয় নেই।
তোমার লেখা তুমি লেখো।" স্যারের কথা স্যারের মুখেই থেকে গেলো, মানবিক বিভাগের একটা অতিপরিচিত ছাত্র এসে
আবুলের উত্তরপত্রটি কেড়ে নিয়ে এক টানে দু ভাগ করে দিলো। স্যার কেবল বিমর্ষ বদনে
বললেন: “বাবা, আমি তোমাকে
বাঁচাতে পারলাম না।" ছেড়া উত্তরপত্র জামার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আবুল বেরিয়ে
এলো পরীক্ষার হল থেকে। বাইরে এসে যা দেখলো তা আবুল সহজে বিশ্বাস করতে পারলো না।
কলেজের মাঠের মাঝখানে একটি ‘জিপ' দাউ দাউ করে
জ্বলছে। একজন সাহেবমতো মানুষের মাথা ফেটে দর দর করে রক্ত ঝরছে। সব মিলিয়ে কলেজে
একটা নারকীয় পরিবেশ। উত্তরপত্রটা কারো হাতে জমা দেবে সেরকম কাউকেও খুঁজে পাওয়া
গেলো না। অগত্যা উত্তরপত্রসহ বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে আবুল শুনলো কোনো এক নেতা
গোছের ছাত্রের উত্তরপত্র নকল করার দায়ে বাতিল করার নতিজা এটা। এডিসি জেনারেল
চট্টগ্রাম, এসেছেন সেন্টার
ভিজিটে। তাঁর হাতেই ধৃত হয়ে ক্ষিপ্ত ছাত্রনেতা তাঁর গাড়ি জ্বালিয়ে দিলো,
তাঁকে শারীরিকভাবে ভীষণ
প্রহার করলো। একটা সদ্য স্বাধীন দেশে এমন একটা ঘটনা দেশপ্রেমিকদের অন্তরের গভীরে
দাগ কাটলো। ঐদিনের সকলের পরীক্ষা বাতিল। তারপর শুরু হলো ধরপাকড়। গ্রেফতার হলো
একজন খুব জাঁদরেল শিক্ষক, কয়েকজন ছাত্র,
যার মধ্যে সিদ্দিকীও আছে।
এ মামলায় তার দু বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিলো।
আবুলের পরীক্ষা
দেওয়া হলো না। এর সব দায় এসে বর্তালো আবুলের কাঁধে। আবুল বুঝতে পারলো, সে তার সৎ মায়ের সংসারে একরকম বোঝা। আবুলের
অবস্থা দেখে মোজাহের তাকে এক জায়গায় বে
না। এমন সময়
হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রসায়নের মোজাম্মেল স্যার। তিনি আবুলের পাশে দাঁড়ালেন
এবং বললেন: “তোমার কোনোদিকে কান দিয়ে কাজ নেই। আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়েছি,
তোমার কোনো ভয় নেই।
তোমার লেখা তুমি লেখো।" স্যারের কথা স্যারের মুখেই থেকে গেলো, মানবিক বিভাগের একটা অতিপরিচিত ছাত্র এসে
আবুলের উত্তরপত্রটি কেড়ে নিয়ে এক টানে দু ভাগ করে দিলো। স্যার কেবল বিমর্ষ বদনে
বললেন: “বাবা, আমি তোমাকে
বাঁচাতে পারলাম না।" ছেড়া উত্তরপত্র জামার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আবুল বেরিয়ে
এলো পরীক্ষার হল থেকে। বাইরে এসে যা দেখলো তা আবুল সহজে বিশ্বাস করতে পারলো না।
কলেজের মাঠের মাঝখানে একটি 'জিপ' দাউ দাউ করে জ্বলছে। একজন সাহেবমতো মানুষের
মাথা ফেটে দর দর করে রক্ত ঝরছে। সব মিলিয়ে কলেজে একটা নারকীয় পরিবেশ।
উত্তরপত্রটা কারো হাতে জমা দেবে সেরকম কাউকেও খুঁজে পাওয়া গেলো না। অগত্যা
উত্তরপত্রসহ বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে আবুল শুনলো কোনো এক নেতা গোছের ছাত্রের
উত্তরপত্র নকল করার দায়ে বাতিল করার নতিজা এটা। এডিসি জেনারেল চট্টগ্রাম, এসেছেন সেন্টার ভিজিটে। তাঁর হাতেই ধৃত হয়ে
ক্ষিপ্ত ছাত্রনেতা তাঁর গাড়ি জ্বালিয়ে দিলো, তাকে শারীরিকভাবে ভীষণ প্রহার করলো। একটা সদ্য
স্বাধীন দেশে এমন একটা ঘটনা দেশপ্রেমিকদের অন্তরের গভীরে দাগ কাটলো। ঐদিনের সকলের
পরীক্ষা বাতিল। তারপর শুরু হলো ধরপাকড়। গ্রেফতার হলো একজন খুব জাঁদরেল শিক্ষক,
কয়েকজন ছাত্র, যার মধ্যে সিদ্দিকীও আছে। এ মামলায় তার দু
বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিলো।
আবুলের পরীক্ষা
দেওয়া হলো না। এর সব দায় এসে বর্তালো আবুলের কাঁধে। আবুল বুঝতে পারলো, সে তার সৎ মায়ের সংসারে একরকম বোঝা। আবুলের
অবস্থা দেখে মোজাহের তাকে এক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। এ প্রস্তাব
পেয়ে আবুল যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেলো। এক সিনিয়র ভাইয়ের বোনের বিয়ে, আনোয়ারার প্রান্তিক অঞ্চলে। একটা ছোট্ট ব্যাগে
কয়েকটা কাপড় নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে আবুল বাড়ি ছাড়লো। সন্ধ্যা নাগাদ তারা
বিয়েবাড়িতে গিয়ে হাজির। পুরানো আমলের বিশাল বাড়ি। মাটি আর কাঠের তৈরি, দ্বিতল। ছাউনি ঢেউ টিনের।
বাড়ির সামনে
বিস্তৃত দাওয়া। ইটের বাধানো। তারপর বিশাল উঠা উঠোনেই বিয়ের আয়োজন। বাড়ির পিছনে
বিভিন্ন ফলগাছের সাজানো বাগান। সামনে দিঘির মতো বিশাল পুকুর। এককালে এরা জমিদার
ছিলো। এখনো দত্তবাড়ি বললে এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই একনামে চেনে। এলাকায়
মোজাহেরের খুব একটা সুনাম ছিলো না। গৃহস্থ ঘরের ছেলে। পড়ালেখায় মাঝারি। স্বভাবে
রগচটা। অনেকেরই ধারণা পানের অভ্যাস আছে। কিন্তু এই বিয়েতে গিয়ে আবুল গাবদা-গোবদা,
কৃষ্ণবরণ মানুষটার ভেতরের
অনুপম সুন্দর মানুষটির সন্ধান পেলো। বিয়ের লগ্ন শেষ রাতে। বরযাত্রীরা যে যেখানে
জায়গা পেয়েছে নিজেদের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। আবুলের সিনিয়ের ভাইয়েরা দত্তপুকুরে
দক্ষিণ-পূর্ব কোনার নিরিবিলি স্থানে আগুন জ্বেলে দস্তুরমতো আসর জমিয়ে বসেছে।
সকলের হাতে পানপাত্র। কে একজন আবুলকে অফার করলে, সে হাত বাড়িয়ে নিলো, কিন্তু এমন সময় মোজাহের কোথা থেকে এসে এমন
জোরে চড় কষলো যে পানপাত্রসহ আবুল মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সবটুকু পানীয় মাটিতে
পড়ে গেলো। তারপর আবুলকে উদ্দেশ্য করে বললো: “ তোমার মতো একজন ভালো ছেলের সর্বনাশ
করার জন্য আমি এখানে নিয়ে আসিনি। উপস্থিত কষ্টের যাতে কিছুটা লাঘব হয়, আপন ছোট ভাইটি ভেবে এখানে এনেছি। খবরদার,
জীবনে কোনোদিন ওপথে পা
দিও না।"
তিন দিন পর আবুল
বাড়ি ফিরলো। তখন পড়ন্ত বিকেল। বাংলোর উত্তরের দরোজা দিয়ে সে ঘরে ঢুকলো। তখন তার
বাবা জায়নামাজে। আছরের নামাজ পড়ছেন । নামাজ শেষে সালাম ফিরাতে গিয়ে প্রথমে
ডানদিকে মুখ ফিরাতে গিয়েই, তড়িঘড়ি করে বাম
দিকে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলেন। আবুল বুঝতে পারলো, তার চোখাচোখি হওয়াটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য
বাবার এ অযৌক্তিক আচরণ। আবুলের কিশোর মনটা হু-হু করে কেঁদে উঠলো। বুঝতে পারলো না,
সে এমন কী অপরাধ করেছে যে,
বাবা তার মুখও দর্শন করতে
চাইছেন না। আজ তিনদিন সে বাড়িতে নেই, তা নিয়ে কারো দুশ্চিন্তা, অভিযোগ, অনুযোগ কিছুই নেই। একটা পোষা কুকুরও যদি
যথাসময়ে ঘরে না ফেরে, তার জন্যেও
মালিকের চিন্তার অন্ত থাকে না। তা হলে কি সে ঘরের মানুষের কাছে একটি পোষা কুকুরেরও
অধম!
বিষয়টা সে
চুপচাপ মেনে নিতে পারলো না। সে ডুকরে কেঁদে ওঠে বাংলো থেকে বেরিয়ে এলো। কান্না
শুনে তার ছোট ভাই ও ছোট বোনটির সাথে বাড়ির অনেকেই এসে তার পাশে অটলা পাকালো।
লজ্জায় এবং ঘৃণায় সে কাউকে কিছু বললো না। তার চাচিকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। অবচেতন মনে বারবার আত্মহননের ইচ্ছা জাগলো। না, আবুল সে পথে গেলো না। সে ভাবলো এবার বাড়ির পাট
চুকোতে হবে। কিন্তু যাবে কোথায়?
আবুলের বাবার
ঘটনাটা কানাঘুষোয় হয়তো অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাই কোনো কথাবার্তা ছাড়া
আবুলের মেজো আপা এসে হাজির। পিঠেপিঠি ভাইবোন। কিন্তু ভাই-অন্তপ্রাণ। এসেই
ভাই-বোনদের জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করার পর আবুলকে নিয়েই পড়লো। “কী রে,
তোর কী হয়েছে বল?”
মেজ আপার এ প্রশ্নের কোনো
জবাব না দিয়ে আবুল উল্টো বললো: “তোর শ্বশুরবাড়িতে কটা দিন রাখবি? এখানে আর এক দণ্ডও থাকতে ইচ্ছে করছে না।”
আবুলের কথা শুনে তার বোনের মুখে রা সরলো না। সে তার ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে ভাইয়ের
মুখের দিকে নীরবে চেয়ে থাকলো। তার চোখ উপচে টপ টপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। রাত্রে
খেতে গিয়ে আবুল অনেকটা না খেয়েই ওঠে এলো। বিষয়টা তার মেজ আপা খেয়াল করলো। সে
আবুলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো: “কীরে, তুই এতো
তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠলি যে?” আবুল বললো: “শুধু
আলুভর্তা দিয়ে আর কটা ভাত খাওয়া যায়?” আবুলের কথা শুনে আপা যেন আসমান থেকে পড়লো। সে কোনো কথা না বলে আবুলদের
রসুইঘরে গিয়ে ঢুকলো। তারপর বাজখাই কণ্ঠে গোটা বাড়িটাকে মাথায় তুললো। তার সৎ
মাকে ডেকে সরাসরি চার্জ করলো। বললো: “তোর পাকঘরে মাছ, মাংস থরে থরে সাজানো, কিন্তু আমার ভাইয়ের পাতে কেবল আলুভর্তা কেন?”
আবুলের স্যা মিনমিনে
গলায় বললো: “তোরা আমাকে দুষছিস কেন? তোর বাপ যে তোর ভাইকে ভালো কোনো তরকারি দিতে মানা করেছে।" এ কথা শুনে
আবুলের বোন কান্নাকাটি করে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিলো তারপর ঐ রাতেই খালি মুখে
শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো। আবুলও তার সাথে গেলো।
আরাকান সড়কের
উত্তর পাশ ঘেঁষে বেশ বড়সড় লোকালয়। নাম দক্ষিণ হুলাইন। এ এলাকারই একটি ছেলে
ইসলাম। পরার্থে আত্ম-উৎসর্গিত বেমেছাল এক যুবক। আবুলের সাথে তার বেশ খাতির। একদিন
বলা নেই, কওয়া নেই একজন
অপরিচিতকে নিয়ে আবুলের কাছে এলো। এসেই বললো: “ইনি আমাদের বড় ভাই। বাড়ি পাশের
গ্রামে। তবে তিনি থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। আমি ওনাকে বলেছিলাম তোর জন্য একটা লজিং
ঠিক করতে। তিনি তা-ই করেছেন। এখন কি তুই যাবি?” ইসলামের কথা শুনে আবুল আকাশের দিকে তাকালো।
সূর্য এখনো পুৰ-গগনে। বেলা আনুমানিক এগারটা। কথা হচ্ছিল পেশকার বাড়ির পুকুরপাড়ে।
আবুল ইসলামদের একটুখানি অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির দিকে ছুটলো। এবং নিঃশ্বাস বদলানোর
পূর্বেই কাপড় পাল্টে, একটি ছোট্ট ব্যাগ
কাঁধে ঝুলিয়ে এসে হাজির। এতক্ষণ ইসলামের সাথের লোকটা কোনো কথা বলেন নি। এবার
সরাসরি আবুলের দিকে তাঁর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আবুলও হ্যান্ড শেকের উদ্দেশ্যে
তার ডানহাত বাড়িয়ে দিলো। হ্যান্ড শেষ হলো কিন্তু আগন্তুক আবুলের হাত ছাড়লেন না।
হাত ধরা অবস্থায় তিনি বললেন: “দ্যাখ, আমি তোমার সব কথা জানি, তবে মনে রেখো
কষ্টের হোক, বাড়ি বাড়িই,
লজিং কখনো বাড়ি হয় না।
বেশি কিছু প্রত্যাশা করো না। যাদের প্রত্যাশা বেশি তাদের কষ্টও বেশি। ভালো-মন্দ,
সুখ-দুঃখ মানুষের হাতে
নেই। সব আল্লাহর হাতে। কখনও মানুষের মুহতাজ হবে না।” তারপর তিনি তার পরিচয় দিলেন
এবং আবুল কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়াতে পারবে তা জানতে চাইলেন। আবুল কিছু বলার আগেই
ইসলাম বলে উঠলো: "দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক বিভাগের সব বিষয় খুব ভালোভাবে
পড়াতে পারবে।” এ কথা শুনে কেমন এক লজ্জায় আবুল তার মাথাটা নিচু করে পায়ের নখ
দেখতে লাগলো । সামনাসামনি প্রশংসা আবুল খুব একটা নিতে পারে না। শুরু হলো আবুলের
নতুন জীবন। প্রথম যে বাড়িতে তার লজিং হলো, তা এক্কেবারে নোংরা এলাকায়। ছাত্রও তারচেয়ে
বয়সে এবং মাথায় বড়। সবচেয়ে কষ্টের সকালের প্রাতঃক্রিয়া সারা। বারোয়ারি
ওয়াশরুম। নিচে খালি, দরোজায় ছালার
চট। সকাল হতে না হতেই সব বয়সের নারী-পুরুষ সারি দিয়ে দাঁড়ায়। কারো মুখে লাগামও
নেই, লাজলজ্জার বালাইও নেই।
কথা শুনেই কেমন বিবমিষার উদ্রেক হয়। পরন্ত গোটা এলাকাটা জুড়ে বরাহপালের নিত্য
আনাগোনা। না, সপ্তাহখানেকের
বেশি সেখানে আবুল টিকলো না। উপকারী বড় ভাইটি এবার তাকে নিয়ে গেলেন তাঁর আপন
মামার বাসায়। বাসা নয়, নিজ বাড়ি।
ছয়তলার এক বিশাল অট্টালিকা। অট্টালিকা বিশাল হলেও আবুলের থাকার জন্য বরাদ্দ
জায়গাটা নিতান্তই ছোটো। ছাত্র-ছাত্রী গণ্ডা দেড়েক। সব করানই মাথামোটা। তবে
বয়সের চেয়ে পাকা বেশি। বাড়ির মালিক শিক্ষিত, সুদর্শন এবং রাশভারী প্রকৃতির। আবুলের বাবাকে
ভালোমতোই চেনেন। কিন্তু বাড়ির অন্দর আর বাহির পুরাটারই নিয়ন্ত্রণ তাঁর দ্বিতীয়
স্ত্রীর হাতে। মধ্যবয়সে প্রেম করে বিয়ে করা বট। সুন্দরী ও বিদূষী, তবে ধর্ম ভিন্ন। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বালিকা
উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। এই বিয়ে ভদ্রলোকের ইমেজ নিজ এলাকায়
শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। এ কথা আবুল জানতো। আবুল আরো জানতো কেবল এ কারণে
একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্কুল চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আবুল তার ছোট্ট
ঘরটায় ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে বসে আরো একজনের উপস্থিতি স্পষ্ট টের পেতো। আবুলের
কামরাটা ছিলো পাঁচতলায়, সিঁড়ির পাশে।
প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও, ক্রমশ বুঝতে
পারলো ইনি মালিকের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। আবুলের যোগ্যতা পরখ করছেন আড়ালে
দাঁড়িয়ে। না, আবুল সেখানেও
বেশি দিন টিকলো না। অনেক লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে
আবুল এবার এলো মুনিরদের বাসায়। আবুলের উপকারী বড় ভাইটি মুনিরদের বাসায় ভাড়ায়
থাকেন। সে সুবাদে মুনিরের সাথে আবুলের পরিচয়। আর সে পরিচয়ের পথ ধরেই বন্ধুত্ব।
মুনিরেরও সৎ মা। নিজের এবং সৎ ভাই-বোন মিলে মুনিরেরা দশজন। একজন মুনিরের বড়,
অন্যরা ছোটো। মুনিরের
পিঠাপিঠি ভাইটির পড়ালেখায় কোনো মনোযোগ নেই। সকল প্রকারের দুষ্টবুদ্ধিতে তার
মস্তিষ্ক ঠাসা। মুনিরের ইচ্ছা আবুল তার ভাইটিকে পড়াক। শহরে এইটি আবুলের শেষ লজিং।
অবশ্য লজিংটি আর লজিং থাকেনি, নিজের বাড়ি হয়ে
উঠেছে। সেই যে এসেছে আবুলের আর বাড়ি যাওয়ার নামগন্ধ নেই। ঈদে চাঁদেও নয়। অবশ্য
মুনিরেরা এ কথা জানতো না। বাড়ির লোকেরা ভাবতো আবুল লজিংয়ে, লজিংওয়ালারা ভাবতো বাড়িতে, আর আবুল তখন বেওয়ারিশ কুকুরের মতো শহরের
ফুটপাথে হাঁটছে। পুরো শহর জনশূন্য। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া নেই বললেই চলে। এমন
অবস্থায় একটা ছেলের উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা যে কারো সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে এটা
ভেবে আবুল সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতো, আর শামুকের মতো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখতো। এখানে থাকতেই একটি অঘটন
ঘটিয়ে ফেললো আবুল। একদিন উপকারী বড় ভাইটি একটি খবরের কাগজ নিয়ে হাজির। এখন আবুল,
মুনির আর বড় ভাইটি একই
কামরায় থাকে মুনিরদের ঘর। মুনির আর আবুল থাকে বিনি পয়সায় আর বড় ভাইটি
কেরেয়ায়। খবরের কাগজটি আবুলকে দিয়ে তিনি একটি বিজ্ঞাপনের দিকে আবুলের দৃষ্টি
আকর্ষণ করলেন। আবুল দেখলো এটি একটি প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন। বারই রবিউল আউয়াল
উপলক্ষে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আলাদা আলাদা বিষয়ে প্রতিযোগিতা। আবুল বিজ্ঞাপনটা
দেখলো, কিন্তু কিছুই বুঝলো না।
তখন তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে বললেন, "আমি চাই এ প্রতিযোগিতায় তুমি অংশগ্রহণ করো।
যতদূর সম্ভব আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো।” তিনি এতটুকু বলে বেরিয়ে গেলেন, আবুলকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না। আবুল যেন অথৈ
পাথারে পড়লো। না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে।
মাঝে মধ্যে দুয়েকটা কবিতা বৈ অন্য কোনো ধরনের রচনার অভ্যাস তার নেই। তবে হাতে
সময় বিস্তর। সময়কে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে কলম ধরলো আবুল। বিষয়- ‘সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হজরত মুহাম্মদ (সা.)'। দিনদুয়েক 'লাইব্রেরি ওয়ার্ক' করে লেখা একটা দাঁড় করালো আবুল। তারপর
পত্রিকায় প্রদত্ত ঠিকানায় পোস্ট করে দিলো। আর ফলাফল ঘোষণার দিনই ঘটলো অঘটন—আবুল
পেলো রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার ।
বিজ্ঞান বিভাগ
থেকে আবুলের আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না। এক বছর পর মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষায় বসে
কোনো মতে উত্তরে গেলো। আবুলের খুব ইচ্ছে অনার্স পড়বে। কিন্তু অবস্থার
পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিতে দোটানায় পড়লো আবুল। শেষ পর্যন্ত পটিয়া কলেজে বিএ
পড়া স্থির হলো। লজিংয়ের সাথে স্কুলে শিক্ষকতা, তারপর পড়ালেখা। কলেজে প্রথম বর্ষেই সকলের
দৃষ্টি কাড়ে আবুল। ভর্তির এক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় কলেজের সাহিত্য সংস্কৃতি ও
ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায়
আবুল অংশ নেয়।
ক্রীড়াতে দাবায় চ্যাম্পিয়ন, ক্যারামে রানার্স
আপ এবং সাহিত্যের সব কটি শাখায় প্রথম স্থান অর্জন করে কলেজের অতীতের সব রেকর্ড
ভেঙে দেয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা ঘটেছে উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায়।
বিশাল কলেজ, অনেক প্রতিযোগী,
আবার এদের অনেকেই জাতীয়
পর্যায়েও বাগ্মিতায় তাদের স্বাক্ষর রেখেছে। এদের মধ্যে আবুল নিতান্তই অর্বাচীন ও
অপরিচিত। বিচারকের আসনে আছেন অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী। এঁদের একজন ইংরেজি
বিভাগের প্রধান শহীদুল্লাহ স্যার, যিনি পরবর্তী
পর্যায়ে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যক্ষের পদসহ আরও বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদ
যোগ্যতার সাথে আঞ্জাম দিয়েছেন। একে একে অনেক প্রতিযোগিতাই তাদের স্ব স্ব ঢঙে
যথেষ্ট মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখে গেলো। অবশেষে এলো আবুলের পালা। যথাবিধি মঞ্চে
ওঠে আবুল বক্তৃতার বিষয় লেখা একটা কাগজ তুললো। তার ভাগ্যে পড়লো 'চেনা মানুষকে দেখলাম অচেনা গণ্ডিতে'। আবুল তার স্বভাবসুলভ আবেগময় কণ্ঠে তার
বক্তব্য উপস্থাপন করলো। কিন্তু বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ থেকে নামার আগেই শহীদুল্লাহ
স্যার নিজেই মঞ্চে উঠে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আর উপস্থিত শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের
মতো একসাথে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ হাততালি দিয়ে বক্তাকে পুরস্কৃত করলো। আবুল তার
জীবনে এতো বড় পুরস্কার বড় বেশি পায়নি।
পটিয়া কলেজে এসে
প্রথম লজিংটা পেলো আবুল তার এক বন্ধুর বাড়ি। বেশ অবস্থাপন্ন পরিবার। যশখ্যাতির
সাথে জ্ঞানচর্চাও সমপরিমাণে বিদ্যমান। বছর ছোটো ছোটো ভাই-বোনদের পড়াতে হবে আবুলকে।
সমস্যা সংখ্যা নিয়ে। ওদের যৌথ পরিবার। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ন্যূনাধিক দেড়গণ্ডা।
দুয়েক জনকে বাদ দিলে আর সব কজনই গর্দভের হাড্ডি। এ পরিবারের প্রতিবেশী পরিবারটির
দীর্ঘদিন ঢাকায় বাস। পরিবারপ্রধান বাংলাদেশ সরকারের সচিব পর্যায়ের
কর্মকর্তা-টর্তা হবেন। অবসরে এসে সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে উঠেছেন। সাধুসজ্জন
ব্যক্তি। উপরি আয়ের ধার ধারেননি। তাই অবসরের পর পেনশনই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র
উপায়। ফলে গ্রামে ফেরা। আবুল তার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে বসলেই পিচ্চি একটা কোলে
নিয়ে এই পরিবারের বড় মেয়েটি আসে। বয়স পনেরো-ষোলো, গায়ের রঙ কালোর দিকে, নিয়মিত মাজা ঘষায় ফর্সা মনে হয়, তবে হাত
পায়ের রঙ অন্য
কথা বলে, বব কাট চুল,
পটলচেরা চোখে সর্পের
দৃষ্টি, পান পয়োধর-উদ্ধত,
পুরু অধর ওষ্ঠ কিঞ্চিৎ
ফাঁক, সে ফাঁকে দৃষ্টি হয়
গজমুক্তার মতো দাঁত; সব কিছু মিলিয়ে
ভয়ঙ্কর সুন্দর; যতটা কাছে টানে
তারচেয়ে বেশি দূরে ঠেলে—এসে আবুলের চেয়ার ঘেঁষে অথবা চেয়ারের পেছনে এমনভাবে
দাঁড়ায় যে, তার গায়ের গন্ধে
যুবক আবুল অস্থির হয়ে ওঠে। মাঝে মধ্যে তার বুকের ওড়নাটা ছল করে আবুলের মাথার উপর
ফেলে, আর চেয়ারের তলায় আবুলের
পায়ের উপর একটি পা আলতো করে রেখে আবুলের দু চোখে তার দৃষ্টি নিবন্ধের চেষ্টা
চালায়। আবুল বোকা হলেও মেয়েটির নির্লজ্জতা তাকে আহত করে। এক দিন, দু দিন, তিন দিন কাঁহাতক আর এই নির্লজ্জতা সহ্য করা ।
অবশেষে একদিন আবুল সব ঘটনা তার বন্ধুকে খুলে বলল কিন্তু ফল হয় উল্টো। পরদিন
মেয়েটি তার মাকে নিয়ে হাজির। ভদ্রমহিলা মধ্যবয়সী। সাজ-পোশাক বলে দেয়, মেয়েটি মায়েরই প্রতিবিম্ব। মেয়েটির মা কোনো
ভূমিকা না করেই আবুলের ছাত্র ছাত্রীর সামনে বলতে শুরু করলেন: “এই মাস্টার, তুমি এতো ব্যাকডেটেড কেন? আমার মেয়ে তোমার পাশে একটু দাঁড়িয়েছে,
তাতে মহাভারত এমন কী
অশুদ্ধ হয়ে গেলো? তুমি আবার ভেবে
বসো না, তোমার মতো আবুলের সাথে
আমার মেয়ে প্রেম করতে এসেছে। শুনেছি ভালো ছাত্র, এতো সংকীর্ণমনা কেন?
মহিলাটি অনর্গল
বকে যেতে লাগলেন, লজ্জায় আর
অপমানে আবুল মাথা নিচু করে রাখলো। তার দু চোখে নামলো বৃষ্টি। এরপর ভদ্রমহিলা
মেয়ের হাত ধরে কক্ষ ত্যাগ করলেন। আর আবুলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন: “যারা যা বোঝে
না, তাদের সাথে কেন তা করতে
যাস?” পরদিনই আবুল একটা অজুহাত
দেখিয়ে লজিং ছেড়ে চলে এলো। তবে আসার সময় কী এক অজানা কষ্ট আবুলের হৃদয়টা
দুমড়ে-মুচড়ে দিলো। তার বারবার মনে হতে লাগলো তার বন্ধুর যে বোনটি ষষ্ঠ শ্রেণির
ছাত্রী, সে জীবনানন্দের 'বনলতা সেন'। হাজার নয় লক্ষ বছর পথ হাঁটলেও তার সন্ধান
মেলা ভার ।
স্বাধীনতার এক
দশক ছোঁয় ছোঁয়। এখনও দেশগঠনের কাজ সিকিভাগও হয়নি। সরকারের সাথে পাল্লা দিয়ে
বিভিন্ন এলাকায় এ মহতী কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন কতিপয় আত্মোৎসর্গিত ব্যক্তি।
আবুলদের এলাকায় খাল খনন, রাস্তা নির্মাণ,
স্কুল প্রতিষ্ঠার মতো
কাজে যাঁরা তাদের দিনের আট প্রহরই ব্যয় করছেন তাদের অনেকেরই সাথে আবুলের ঘনিষ্ঠতা
রয়েছে। এলাকার মুরব্বি ছালাম সাহেব, আবুল যাকে চাচা বলে ডাকে, ভীষণ বিচক্ষণ
ব্যক্তি, একটি স্বনির্ভর
ইউনিয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তিযোদ্ধা
কমান্ডার মহসীন খান ইউপি চেয়ারম্যান; পরবর্তীকালে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান; জাঁদরেল প্রধান শিক্ষক, কর্মনিষ্ঠ শিক্ষাবিদ মুহম্মদ মুসা; শিক্ষানুরাগী ও মুক্তিযোদ্ধা এমদাদ সাহেব ও আরো
অনেকেই মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন “ইউনিয়ন কৃষি উচ্চবিদ্যালয়"। আবুল এই স্কুলের
দ্বিতীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বিশ-বাইশ বছরের যুবক। পটিয়ার লজিং ছেড়ে স্কুলের পাশেই চলে এলো। স্কুল
পরিচালনা পরিষদের অত্যুৎসাহী এক সদস্য অনেকটা জোর করে আবুলকে তাঁদের বাড়িতে ঠাঁই
দিলেন। স্কুল নতুন কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী সে তুলনায় সন্তোষজনক। গুনে গুনে একটি বছর
আবুল এই স্কুলে প্রধানের দায়িত্ব পালন করে। দায়িত্ব পালনকালীন দীর্ঘদিন তার
অন্তরে লালিত অনেক জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজেছে সে। এক্কেবারে শৈশবে শিশু আবুল
পরীক্ষায় বসে যখন দেখতো ছাত্র-ছাত্রীরা চুরি করবে এটা ধরে নিয়েই শিক্ষক-ছাত্র
চোর-পুলিশ খেলছে, তখন তার ভীষণ
লজ্জা লাগতো। নিজেকে কেমন যেন চোর চোর মনে হতো। এখন তার সুবর্ণ সুযোগ, সহকর্মী সকলেই সমবয়সী এবং বন্ধু শ্রেণির।
পরিচালনা পরিষদ স্কুলের পড়ালেখার ব্যাপারে তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। সুতরাং
এখনই সময়।
দায়িত্ব পেয়ে
আবুল একদিন স্কুলের সকল শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়ে বসলো। সে তাদের সম্মতি নিয়ে বলতে
শুরু করলো, “দেখুন আমরা এখনও
কেউই পেশাদার শিক্ষক হয়ে উঠিনি । তাই আমি আপনাদের কথাগুলো বলার সাহস পাচ্ছি। আমার
ইচ্ছা যতদিন আমি এ বিদ্যাপীঠের দায়িত্বে আছি ততদিন আমার চূড়ান্ত প্রয়াস হবে
গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে ওঠে এটিকে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। আর এ লক্ষ্যে
আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে ছাত্র ছাত্রীদের মন থেকে শিক্ষকভীতি দূর করা। ভয়ের
স্থানে তাদের মনে শিক্ষকদের জন্য থাকবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিশ্বাস। আমরাও আমাদের
ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসবো আর অকৃত্রিম বিশ্বাস করবো ষোলোআনা, আর প্রতিটি ক্ষেত্রে দেবো নিজেদের চূড়ান্তটা।
আমরা এ কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের মন ও মননে এই দৃঢ় বিশ্বাসের বীজ উপ্ত করবো:
‘পড়ালেখার একমাত্র উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন, ভেতর দিয়ে নিজেকে দু-পাওয়ালা জীব থেকে মানুষে
পরিণত করা। পরীক্ষায় পাস করে সনদ অর্জন নয়। আমাদের সামনের পরীক্ষাটা
পরীক্ষামূলকভাবে নিতে চাই, কক্ষ
পরিদর্শকবিহীন স্বাক্ষরসহ উত্তরপত্র, অতিরিক্ত উত্তরপত্র, প্রশ্নপত্র এবং
আর সব প্রয়োজনীয় সামগ্রী পরীক্ষা শুরুর ঠিক পনেরো মিনিট পূর্বে পরীক্ষা কক্ষের
নির্ধারিত স্থানে রেখে আসা হবে। শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে এসে নিজ নিজ প্রয়োজনীয়
কাগজপত্র সংগ্রহ করে, স্ব স্ব আসনে বসে
জবাব লিখে উত্তরপত্র যথাস্থান রেখে প্রস্থান করবে।”
আবুলের এ কথা
সমর্থন করলেন কেবল একজন। তাও শিক্ষক নন। কেরানি কাম শিক্ষক। প্রতিবাদ করলেনও একজন।
তিনি বললেন; “ ক্ষেত্র তৈরি না।
করে বীজ বুনন যেমন পন্ডশ্রম, এক্ষেত্রেও ফল
হবে নেতিবাচক।” অন্যরা মিসকে ভরা মুচকি হাসি হাসলেন। আবুল হাসিটা গায়ে মাখলো না,
তবে প্রতিবাদটা গ্রহণ করে,
বললো; “আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আর তাই আজকে
আপনাদের নিয়ে বসেছি। আজ থেকে আগামী পুরো সপ্তাহটা আমরা স্ব স্ব ক্লাসে কনসেপশনটা
ছাত্র-ছাত্রীদের মগজে স্থাপনের আন্তরিক চেষ্টা চালাবো।” আবুলের এ প্রচেষ্টা প্রায়
ষোলোআনা সফল হয়েছিলো । ছাত্র-ছাত্রীরা বিষয়টা আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলো। এবং
অনেকটা ঈদের আনন্দ নিয়ে পরীক্ষায় বসে ছিলো। শের আলী নামের অষ্টম শ্রেণির একজন
ছাত্র টুকতে গিয়ে সহপাঠীদের হাত ধৃত হয়ে স্কুল থেকে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হলো।
আবুলের সফলতায় সকলেই পেলো বোকামির গন্ধ । অনেক ঝানু পেশাদার শিক্ষক বললেন: এটি
আষাঢ়ে গল্প। তবে আবুলের প্রতিষ্ঠানের ভিন্নমতালম্বীরা ঘটনা চাক্ষুষ করে কেবল
নিজেদের বদলে নিলেন না, বরং এই কনসেপশনের
প্রচারকের দায়িত্বও স্বেচ্ছায় গ্রহণ করলেন। তখন ‘কৃষি' শব্দটা আলঙ্কারিক অর্থেই স্কুলের নামের সাথে
যুক্ত ছিলো না। বরং এ বিদ্যানিকতনের মূল আদর্শই ছিলো দেশের কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা
হলেও অবদান রাখা। তাই প্রতিটি শ্রেণিতে হাতে-কলমে কৃষি-শিক্ষা একটি আবশ্যক বিষয়
ছিলো। আবুলের দায়িত্ব পালনের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের নিজ হাতে ফলানো মূলা, বাঁধা কপি, ফুলকপি আকারে আর ফলনে জাতীয় রেকর্ড সৃষ্টি
করেছিলো । এ উপলক্ষে স্কুলে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর এ অনুষ্ঠানে প্রধান
অতিথি হয়ে এলেন স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ‘মাহবুবুল আলম চাষী'। তিনি দেখলেন এবং মুগ্ধ হলেন। আশ্বাস দিলেন
সর্বপ্রকারের
সহযোগিতার। এক পর্যায়ে তিনি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আবুলের কাছে চুপে চুপে জানতে
চাইলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের খোঁজ। আবুল, বোকা আবুল তাঁকে কিচ্ছুটি বলতে পারলো না,
কেবল মুখটা নিচু করে
রাখলো। কিন্তু সভাপতির আসনে উপবিষ্ট, এলাকার গর্ব, যিনি এই কিছুদিন
আগে সরকারি নকরিকে গোলামি বলে ত্যাগ করে কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেছেন—ডাবল এম এ
নুরুল আলম। স্মিতহাস্যে চাষি সাহেবকে জানালেন, “আপনার সঞ্চালকই আপনার প্রধান শিক্ষক।” চাষী
সাহেব কতক্ষণ বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে আবুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং আবুলের পিঠ
চাপড়ে তাকে উৎসাহ দিলেন। বিদায় বেলায় তিনি আবুলের নাম-ধাম লিখে নিলেন, এবং বললেন: “তোমাকে আমার দরকার। অতি সত্বর আমি
তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।” কিন্তু সে সৌভাগ্য আবুলের হয়নি। কারণ এর কিছুদিনের
মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
জীবনের আহ্বানে
স্কুলের দায়িত্ব ছাড়তে হলো আবুলকে। সামনে বিএ পরীক্ষা, ন্যূনতম প্রস্তুতি ছাড়া পরীক্ষায় বসে কী করে? স্কুলের সাথে
লজিংও ছাড়লো। এখন একটি নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন। প্রতিবেশী এক সিনিয়র ভাই, বন্ধুর মতো, ভীষণ টেলেন্ট ছাত্র, নিজের সমস্যার কথা আবুল তাকে বললো। সে এলাকার একটি অবস্থাপন্ন শিক্ষিত পরিবারে
থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলো। বিভিন্ন কারণে
আবুল এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলো না। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এর চেয়ে ভালো কোনো
ব্যবস্থা করতে না পেরে আবুলকে রাজি হতেই হলো।
নতুন লজিংয়ে
ছাত্র-ছাত্র তিনজন। কিন্তু প্রথম দিন পড়াতে বসে আবুল পেলো দুজনকে। একজন ছাত্র
অষ্টম শ্রেণির অন্যজন ছাত্রী, নবম শ্রেণির । তারাই বললো, তাদের আপাকেও পড়াতে হবে। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। আজ আসবে না, কারণ আজ সে বাড়িতে নেই, মামার বাসায় বেড়াতে গেছে। প্রথম দিনই আবুল
বুঝলো ছেলেটি মেধাবী কিন্তু মিসকে শয়তান, ছাত্রীটি মাঝারি
মেধার কিন্তু ভীষণ চপলা । ঘণ্টাখানেক পর আবুলের ভিতর বাড়িতে ডাক পড়লো। দেউড়িতেই
আবুলের থাকার এবং পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। কাঠের কাঠামো, বাঁশের বেড়া, ছাউনি টিনের মেঝে ইটের বাঁধানো, বেড়ার ছাদে চমৎকার কারুকাজ,
দু কক্ষবিশিষ্ট ঘর।
আবুলের একার পক্ষে থাকার জন্য বেজায় বড়। আগে কখনও এতো বড় ঘরে আবুল একা থাকেনি।
একা থাকার কথা ভাবতেই কেমন ভয় ভয় অনুভূতি হচ্ছে। দেউড়ির যে কক্ষে আবুল পড়াচ্ছে
তা পশ্চিমে এবং দক্ষিণে দরোজা । পশ্চিমের দরোজা দিয়ে ভিতর বাড়িতে যেতে হয়।
ছাত্রটির পিছনে পিছনে সে উঠোনে পা রাখলো। বেশ পরিচ্ছন্ন ছিমছাম উঠোন। উঠোনের
পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বেশ সুন্দর একতলা পাকা বিল্ডিং, উঠোন থেকে
সামান্য উঁচু। অনেকটা 'E' প্যাটার্নের বাড়ি। মাঝখানে দাওয়া, রেলিংঘেরা। উঠোন থেকে তিন সিঁড়ি উঁচু। সিঁড়ির দু পাশে বেশ দুটো বড়সড়
গন্ধরাজের ঝাড়। আর গোটা দাওয়া জুড়ে বিভিন্ন রঙের পাতাবাহারের গাছ। বাড়ির উত্তর
পাশে
উঠোন ঘেঁষেই একটা
মাঝারি আকারের পুকুর। পুকুরের স্ফটিক স্বচ্ছ জলে ঘরের উত্তর পাশের দাওয়া থেকেই
ধাপে ধাপে নেমে গেছে সিঁড়ি—অনেক দূর অবধি। বিল্ডিংয়ে প্রাচীনত্বের চিহ্ন থাকলেও
পরিচ্ছন্নতা প্রশংসনীয়। ছাত্রটির পেছন পেছন গিয়ে আবুলকে যেখানে থামতে হলো, সেটি বাড়ির সর্ব-দক্ষিণ-পূর্ব কক্ষ। ঘরটাও গোছানো। মেঝে ঝকঝকে, কোথাও ময়লার এতটুকু চিহ্ন পর্যন্ত নেই, একটা অতি সাধারণ
টেবিল সাজানোর গুণে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। কয়েকটি ধর্মীয় বই, দুয়েকটি কবিতার বই নজরুল, রবি ঠাকুর, ফররুখের পাশাপাশি
জীবনানন্দকেও দৃষ্ট হচ্ছে। টেবিলের ঠিক মাঝ বরাবর একটি বিশেষ আকারের কাঁচের বোতলে
ডাঁটাসহ কয়েকটি গোলাপ রাখা। টকটকে লাল ভীষণ সজীব, গন্ধে গোটা ঘরটা
মৌ মৌ। টেবিলটা পরিষ্কার, সাদা টেবিল ক্লথ দিয়ে আচ্ছাদিত। টেবিল থেকে
একটু দূরে ঘরের ঠিক মাঝামাঝি দক্ষিণে বাতায়ন পাশে একটি আরাম কেদেরা। যদিও
ময়লাযুক্ত নয় তবু দেখামাত্র একজন অর্বাচীনও বলে দিতে পারবে এটির বয়েস অনেক এবং
ব্যবহৃত। টেবিলের পূর্ব পাশ ঘেঁষে একটি খাট। আকারে মাঝারি; রঙ, কাঠ, আর ডিজাইন দেখে
অনায়াসে বলে দেয়া যায়- এই খাট শত বছরের প্রাচীন। খাটের চাদর শ্বেতবরণ, বালিশের কভারও সাদা। তার উপর উপবিষ্ট একজন অতি সুদর্শন প্রৌঢ়।
একটি বড়সড়
গ্রন্থের মধ্যেই তিনি নিবিষ্ট। ভদ্রলোক আবুলের পূর্ব পরিচিত। কিন্তু রাশভারী
চরিত্রের বেড়া সরিয়ে তাঁর পাশ ঘেঁষার সাহস আবুলের হয়নি কোনো দিন। তিনি বই থেকে
চোখ না সরিয়ে বললেন, 'বসো'। ভারী কিন্তু
মধুর কণ্ঠস্বর । এ স্বরের মধ্যে কেমন এক ভাব যা শ্রোতাকে সহজেই বশ করে নেয়। আবুলও
বসতে গিয়ে দেখে গোটা ঘরটায় আরাম কেদেরাটা বৈ বসার আর কোনো আসবাব নেই। বোকা হলেও
আবুল বুঝতে পারলো আর যা কিছুতেই বসা যাক কিন্তু আরাম কেন্দ্রেরায় নয়। আবুল পিছনে
ফিরে দেখে তাকে ঢুকিয়ে দিয়েই তার ছাত্রটি উধাও। অগত্যা আবুল ধীর পায়ে গিয়ে
খাটের পৈতানে বসে পড়লো। খাটের শিয়রে বসে পেতানে পা দুটো ঈষৎ টেনে দিয়েছেন
ভদ্রলোক। পরনে সাদা ট্রাউজার, গায়ে সাদার উপর সাদা ফুলের টি-শার্ট, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, দুধে আলতা মেশানো গায়ের রঙ, সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সেও মুখমণ্ডলের বলিরেখাগুলো অস্পষ্ট, শ্বেত-শত্রু নাতিদীর্ঘ
সারা অঙ্গে আভিজাত্যের সুস্পষ্ট ছাপ। খাটে বসেই আবুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো দু হাতে
ভদ্রলোকের দু পা ছুঁয়ে সালাম করলো। এবার ভদ্রলোক চমকে ওঠে
আবুলের চোখে চোখ রাখলেন। আবুল লজ্জা ও সংকোচে মাথাটা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকলো ।
এবার তিনি বইটা
বন্ধ করে টেবিলে রেখে দিলেন। এবং সরাসরি আবুলের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাস্যে বলতে
শুরু করলেন: “দ্যাখো, আমি তোমার সম্পর্কে সব জানি। এ-ও জানি, তোমার মধ্যে কেমন এক জাদু আছে,
তাই অনেক গাধা ছেলেকে
পড়িয়ে তুমি এসএসসির বেড়া পার করিয়ে দিয়েছো। আমিও তা চাই। তোমার বড় ছাত্রীটি
এমনিতে গবেট নয়, কিন্তু পড়ালেখায় একেবারে অমনোযোগী, উপরন্তু গণিতে ভীষণ কাঁচা, আমি চাই তোমার নিজের পড়ালেখার ক্ষতি না করে এই
মেয়েটিকে কোনোমতে এসএসসিটা পার করিয়ে দাও। আর দ্যাখো, এটাকে পরের বাড়ি ভেবো না, এটা তোমার আরেক বাড়ি। তোমার যখন যা প্রয়োজন
হয়, আমাকে জানাতে সংকোচ করো না।” এতটুকু বলে তিনি
আবার ভাঁজ করে রাখা বইটি হাতে তুলে নিলেন। আবুলও তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে
নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো।
পরদিন সকালে আবুল
আর গেলো না । বইপত্র, বক্স-পেটরা নিয়ে এক্কেবারে বিকেলে গিয়ে
হাজির। আবুলকে দেখে ছাত্রটা ভীষণ খুশি। সবকিছু গোছগাছ করতে সে স্যারকে দু হাত
খুলেই সাহায্য করলো। নবম শ্রেণির ছাত্রীটাও তার অনভ্যস্ত কোমল হাতে গোটা ঘরটাতে
ঝাড়ু দিলো। দেখেই বোঝা গেলো- দুজনেই তাদের নতুন স্যারকে পেয়ে হাতে যেন আসমানের
চাঁদ পেয়েছে- অমন খুশি। অবশ্য এরই মধ্যে আবুলও ছাত্রটার সাথে বেশ জমিয়ে নিয়েছে।
এবং কায়দা করে এ কথাটাও আদায় করলো: আগামী পরীক্ষায় সে তার শ্রেণিক্রমের
সংখ্যাটা 'এক'-এ নিয়ে আসার
জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে। ছাত্রটা তার এ কথা রেখেছিলো। এবং এরপর স্কুলের কোনো
পরীক্ষায় সে প্রথম বৈ দ্বিতীয় হয়নি।
আবুল মাগরিবের নামাজ
পড়ে এসে দেখলো, গতকালের দুজনই টেবিলের সামনের চেয়ারে দুটিতে
বসে আছে। পশ্চিম পাশের চেয়ারটা খালি । তৃতীয় জনের ব্যাপারে জানার ইচ্ছেটা অনেক
চেষ্টায় সংযত করে উপস্থিত ছাত্র ছাত্রীর দিকেই আবুল মনোনিবেশ করলো। দেখলো যতটুক
দুর্বল ভেবেছিলো এরা কোনো বিষয়ে ততটুকু দুর্বল নয়, তবে অধ্যবসায়ের
অভাবটা প্রকট। আবুল অত্যন্ত মনোনিবেশ সহকারে তার ছাত্রকে আঁক কষাচ্ছিলো, হঠাৎ একটা ঘর্ষণের শব্দে তার মনোযোগ ছিন্ন হয়। সে
মাথা তুলে যাকে দেখলো, তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো এবং নিজের
জায়গায় তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলো। স্যারের আচমকা দাঁড়ানো দেখে ছাত্র-ছাত্রী
দুজনেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে স্যারের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো নির্বাক। কিন্তু
আগন্তকের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলো না। ওড়নাটা চাদরের ঐ মতো সারা
অঙ্গে মোড়ানো; আর ঐ অবস্থায় এক্কেবারে নির্মোহ ভঙ্গিতে খালি
চেয়ারটা টেনে উপবেশন করলো। চেয়ারটা টানতে গিয়েই ঘর্ষণটা হয়েছিলো। আবুলের
ধাতস্থ হতে অন্তত মিনিট পাঁচেক লাগলো । ছাত্র-ছাত্রী দুজনই অনুধাবন করলো 'ডাল মে কুচ কালা হ্যায়'—কিন্তু কিছু বললো না। আবুল ধীরে-সুস্থে নিজের
আসনে বসল, আগন্তুক তার মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে দুই দুই চোখ
দুটো এক্কেবারে আবুলের চোখের উপর রেখে বললো। “আসসালামু আলাইকুম। আমি আপনার তিন
নম্বর ছাত্রী। এ বছর নিউ টেনে । নাম...” এতটুকু বলে থেমে গেলো । নাম আর জানা গেলো
না । কিন্তু মাঝপথে ছাত্রটা বললো: “আমার আপা । একটা ভালো নাম আছে। কিন্তু কিছুদিন
আগে একজন অচেনা পথচারী আপার নাম দিয়েছেন অনামিকা, আপা এখন ঐ নামেই
পরিচিত হতে বেশ পছন্দ করে।” কথাগুলো শুনে আবুল খুব অস্বস্তিবোধ করে। একটা অজুহাত
দেখিয়ে ওদের সাততাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের
ছুটি দিয়ে সংকোচ আর লজ্জায় আবুল অনেকক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে এক ঠাঁয় বসে থাকলো। কেমন
যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। তার এক মন বলে: ‘এখনই পালিয়ে যাও'। আরেক মন বলে: 'না, দ্যাখো না কী
হয়।' মাস দুয়েক আগের কথা। প্রায় অর্ধ যুগ পরে
গ্রামে ফিরেছে সে। উদ্দেশ্য পটিয়া কলেজে পড়া। নতুন প্রজন্মের বলতে গেলে কাউকেই
চেনে না। একদিন সকালে বিনা কাজে আরাকান সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটছিলো আবুল এবং
আরো কয়েকজন। তাদের মধ্যে সিনিয়র ভাই সিরাজও ছিলো। আবুল তাকে মামা ডাকতো। এমন
রসিক এলাকায় দ্বিতীয়টি আর ছিলো না। এমন এমন কথা বলতো নিজে হাসতো না, অন্যরা হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেতো। কিন্তু জীবনের রসিকতায় এমন প্রাণবন্ত
মানুষটি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অল্প বয়েসে আর না ফেরার দেশে চলে গেলো । তারা
হাঁটছিলো একমনে। সিরাজই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বললো: “দ্যাখো দ্যাখো এক ঝাঁক প্রজাপতি কেমন নির্বিঘ্নে হেঁটে চলে
যাচ্ছে।” আবুল কিছু বুঝতে না পেরে বলে উঠলো: “ এতোদিন জেনে আসছি প্রজাপতি উড়ে, হাঁটতে তো দেখিনি।” সিরাজ বলে ওঠলো: “এতোদিন চট্টগ্রাম শহরে থেকেও দেখছি তোমার
কোনো উন্নতি হয়নি ভাগনে। তবে কথা সেটা না, কথা হলো ঝাঁকের
সর্ব-উত্তরের প্রজাপতির যে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে, তাকে আমি মনসার টেকে নিয়ে চা খাওয়াবো।” এবার আবুল কথাটা বুঝতে পারলো এবং
চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলো। তবে সফল হলে একা আবুলকে নয়, সকলকেই খাওয়াতে হবে। আর বিফল হলে আবুল সকলকে খাওয়াবে। এ রকম কোনো চ্যালেঞ্জ
আবুল পূর্বে কোনোদিন নেয়নি। তারপরও কেন যে তার স্থির বিশ্বাস, একবার মেয়েটির সামনে যেতে পারলে, মেয়েটি বারবার
তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। আবুল একটু জোরে হেঁটে মেয়েদের
দলটাকে অতিক্রম করে সামনে চলে গেলো। তারপর অত্যন্ত ধীরে ধীরে তার নিজের কালো
ঘন-দীর্ঘ চুলে আঙুল চালাতে চালাতে নিজ দলে ফিরে এলো। এতে কাজ হলো জাদুর মতো।
প্রথমে মেয়েদের গোটা দলটা পিছনে ফিরে আবুলের দিকে তাকালো। তারপর যতক্ষণ দেখা যায়, উত্তর পাশের মেয়েটি ততক্ষণ কেবল আবুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
সিরাজ অবশ্য তার কথা রাখলো না, অর্ধপথ থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আবুল আরও
এককদম এগিয়ে কাব্য করে বললোঃ “ওগো অনামিকা, আর কি কভু হবে
দেখা?”
দোটানায় পড়লো
আবুল। একটি মনের টান, আরেকটি মননের টান। শেষ পর্যন্ত মনেরই জয় হলো।
নিম্নচাপটা জিতে গেলো। থেকেই গেলো আবুল। যতই দিন গড়াতে থাকলো, ততই ছাত্র-ছাত্রীর সাথে আবুলের সম্পর্কটা সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে লাগলো। আবুলও
মনে মনে একটা অদৃশ্য টান অনুভব করতো, তবে সে দক্ষিণের
না পশ্চিমের ঠিক বুঝে উঠতো না। অন্তরের চোরা স্রোত কোন পথে দিয়ে যাচ্ছে তা বুঝার
জন্য তিন তিনটি মাস আবুলকে ধৈর্য ধরতে হলো। মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে হারিকেনের
আলোতে পড়াতো আবুল। তখন টেবিলের নিচে পা রাখা আবুলের জন্য নিরাপদ ছিলো না। বাতাসের
অভাব মিটাতো তালপাতার হাত পাখা। এটির উপর একচেটিয়া অধিকার থাকতো নবম শ্রেণির ছাত্রীটির।
বেশ জোরে পাখা চালিয়ে সে ভীষণ আনন্দ পেতো। আবুল বুঝতে পারতো না কীসে তার এতো
আনন্দ। তাই লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলো:
“কীরে, তুমি এতো জোরে পাখা চালাও কেন?"
সে তার লাবণ্যভরা মুখ
তোলে, বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকিয়ে, আদরের কন্ঠে বললো: “কেন স্যার,
আপনি জানেন না? আপনার লম্বা কালো চুল যখন বাতাসে উড়ে তখন আমার দেখে থাকতে ইচ্ছে করে। আর মনে
হয়, সাত-সমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে কোনো রাজকুমার
বাতাসের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে, দীর্ঘ কালো চুল উড়িয়ে আমাকে নিয়ে যেতে আসছে।
কিন্তু বিধি বাম, আমার রাস্তাটা বন্ধ । তাই চুল উড়ানোর মধ্যেই
আমার আনন্দটাকে বেঁধে রেখেছি। দোহাই আপনার, আমার এটুকুন
আনন্দ কেড়ে নেবেন না।” ছোট্ট একটি মেয়ের মুখে এমন পাকা পাকা কথা কথা শুনে আবুল
হাসবে না কাঁদবে ঠাওর করতে পারলো না। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। দেখলো কিশোরীর মুখে হাসি, চোখে জল, কণ্ঠটা ধরা ধরা। আর কিছু জানতে চাওয়ার সাহস
আবুলের হলো না। *
এর মধ্যে তিন মাস
অতিক্রান্ত। স্কুলের একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। ফলাফলও হাতে এসেছে। ফল হয়েছে
আশাতীত। ছেলেটা তার ক্লাসে অন্তত বিশজনকে টপকে প্রথম হয়েছে, নবম শ্রেণির মেয়েটা তৃতীয় এবং দশম শ্রেণির অনামিকা গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর
পেয়ে দশের মধ্যে এসেছে। সবচেয়ে মজার কথা, এয়ারকুবদণ্ডী
পোস্ট অফিসের সিলে আবুলের হাতে একটা উড়ো চিঠি আসে। চিঠির হস্তান্তর যেমন-তেমন, ভাষা শুদ্ধ এবং প্রাঞ্জল, বিষয় নিখান প্রেম। চিঠির লেখিকা গোটা চিঠিটা
জুড়ে ইনিয়ে বিনিয়ে আবুলের প্রতি তার স্বার্গীয় প্রেম জাহির করেছে। সে দিন
দ্বিপ্রহর। সূর্য পশ্চিম গগনে একটু হেলেছে। তার তির্যক রশ্মি পশ্চিমের দরোজা ও
জানালা গলে আবুলের কক্ষে সতেজে লুটিয়ে পড়েছে। তার অসহনীয় উষ্ণতা থেকে বাঁচার জন্যে
আবুল দরোজা ও জানালা বন্ধ করে চিঠিটা হাতে নিয়ে তার চৌকিতে শুয়েছিলো, আর আপন মনে ভাবছিলো: ‘কে হতে পারে এ চিঠির প্রেরিকা।' এমন সময় পুবের দরোজা দিয়ে চুপে চুপে প্রবেশ করে সিরাজ। এটা সিরাজের তাওই
বাড়ি। তাই যখন-তখন এখানে তার গতায়াত আছে। ঢুকেই সে আবুল কিছু বুঝে ওঠার আগে তার
হাত থেকে চিরকুটটা ছিনিয়ে নেয়। চিঠিতে কারো নাম নেই। না প্রেরকের না প্রাপকের
ঠিকানা কেবল খামের উপর। ওটা আবুল ছিড়ে ফেলেছে। তবে চিঠিটা পড়ে এক্কেবারে
অর্বাচীনের পক্ষেও সহজে প্রাপককে চেনা সম্ভব। তারপরও আবুল অস্বীকার করলো। বললো
মসজিদে যাওয়ার সময় রাস্তার মাঝখানে কুড়িয়ে পেয়েছে। সিরাজ কিছু বললো না। একটুখানি বাঁকা হাসি হেসে চিঠিটা নিয়ে চলে
গেলো। আবুল পড়লো মহা ফাঁপরে। এরপর আবুলের গ্রহে শনির আবির্ভাব। ঐদিন সন্ধ্যায়
অনামিকা পড়তে এলো না। অন্য দুজনের মুখমণ্ডল গোমড়া। ঘরে পরিবেশ কেমন ভারী। আবুলের
মনে কী এক আশঙ্কা উকি দিচ্ছে বারবার। কিন্তু সঙ্কোচে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
লজ্জাবতী পাতার মতো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিলো। অবশেষে এ অচল অবস্থার নিরসন
করলো নবম শ্রেণির ছাত্রীটি। সে সরাসরি আবুলের চোখে চোখ রেখে বললোঃ "স্যার, আপনি কি রুনাকে কোনো চিঠি দিয়েছেন?” আবুল অনেকক্ষণ
জবাব দিতে পারলো না। তার মায়াভরা চোখ থেকে বড় বড় দু ফোঁটা অশ্রু টপ টপ করে ঝরে
পড়লো। স্যারের চোখে জল দেখে ছাত্রীটি কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। কিন্তু
ক্ষণকালের জন্য। তারপর ঐ ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ আসন ছেড়ে স্যারের পাশে গিয়ে
দাঁড়ালো এবং মায়ের পরম মমতায় স্বীয় ওড়না দিয়ে নিঃসঙ্কোচে আবুলের দু চোখের জল
মুছে দিলো। আবুলের মনে হলো আজ অনেক দিন পর সে আবার মায়ের হাতের পরশ পেলো। আবুল
এখন জানে না তার মায়ের মতো মেয়েটি কোথায়। **
রুনা সিরাজের
ভাবীর ছোটো বোন। আবুলের ছাত্রীটির সাথে একই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। মেধাবী
ছাত্রী। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। সিরাজ হস্তাক্ষর দেখেই চিঠিটার লেখিকাকে চিনতে
পারে। তখন সে ঘটনাটা গোটা বাড়িতে ফাঁস করে দেয়। 'এক হাতে তালি
বাজে না।' এই অনুমানে সকলেই এ ঘটনায় আবুলের সংশ্লিষ্টতা
কল্পনা করে নিয়ে তাকে দুষছিলো। কিন্তু পুরো বিষয়টা আবুল সাফ সাফ জানিয়ে দিলো ।
ছেঁড়া খামটা কুড়িয়ে তাদের হাতে দিলো। এবং বললো রুনা নামের কারো সাথে তার কনিষ্ঠ
পরিমাণও পরিচয় নেই । এরপর আবুলের আকাশ মেঘমুক্ত হলেও গ্রহ শনিমুক্ত হলো না । এই
শনির নাম 'রুনা'। সে তক্কে তক্কে
থাকলো কীভাবে আবুলকে বিপদে ফেলা যায়। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো ফলাফল লভিংয়ে আবুলের
অবস্থানটা কিছুটা দৃঢ় করলো। উপরন্ত এ সময় গ্রামে 'গ্রাম সরকার' নির্বাচনের তারিখও ধার্য হলো। গোটা গ্রামে প্রার্থী দুজন। একজন মাঝিবাড়ির বড়
তরফ, অন্যজন আবুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা। সরকারপক্ষ
মাঝিবাড়ির দিকে। কাশেম শরীফ থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত, আবুলের বন্ধু
সরাসরি মাঝিবাড়ির বড় তরফের পক্ষে রায় দিলো। তখন আবুল উপস্থিত সকলের অনুমতি
নিয়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বক্তব্যে গ্রাম সরকার বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ
করলো তার স্বভাবসুলভ আবেগময় ভাষায়। আবুলের
বক্তব্যের তোড়ে কাশেম শরীফের ষড়যন্ত্র খড়কুটোর মতো ভেসে গেলো। উপস্থিত জনগণ
এতোটাই ক্ষেপে গেলো যে কাশেম শরীফেরা অনেকটা পালিয়েই প্রাণ বাঁচালো। এ ঘটনায়
লজিং বাড়িতে আবুলের আসন আরো পাকাপোক্ত হলো।
আবুল পাঁচ
ওয়াক্ত নামাজই মসজিদে গিয়ে আদায় করে। ফজরের নামাজ পড়ে যখন রুমে ফেরে তখনও
চারপাশে আবছা অন্ধকার। দুয়েকজন মুরব্বি ছাড়া গোটা পাড়াটা ঘুমে অচেতন।
গ্রাম-সরকার নির্বাচনের ঘটনার পরের দিনের কথা। আবুল যথারীতি ফজরের নামাজ আদায় করে
এসে তার রুমে ঢুকতে যাবে, দেখে দরোজার শিকল খোলা। কিন্তু আবুলের পষ্ট মনে
আছে মসজিদে যাওয়ার সময় দরোজায় তালা না দিলেও সে শিকল দিয়ে গিয়েছিলো। তাহলে...? হঠাৎ তার চিন্তায় ছেদ পড়ে। একটা কোমল ফর্সামতন হাত দরোজার ভেতর থেকে বেরিয়ে
এসে আচমকা তার হাত ধরে টান মেরে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। সে তাল সামলাতে না পেয়ে
আগন্তুকের বুকের উপর আছড়ে পড়ে। আগন্তুক এর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলো। সে
এতটুকু টললো না। বরং আবুলকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনাটা এতই দ্রুত ঘটে গেলো
যে, আবুল কিচ্ছুটি বুঝতে পারলো না। সে অনেকটা ভূতে
পাওয়া মানুষের মতো হতভম্ব অবস্থায় নিজেকে আগন্তুকের বুকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করলো।
এ অবস্থায় আবুল কতক্ষণ ছিলো জানে না। এক সময় আস্তে আস্তে বাহুর বন্ধন শিথিল হয়, আবুল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক কদম পিছিয়ে এসে আগন্তুকের মুখের উপর দৃষ্টি
নিবন্ধ করে। দেখে ঐ মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে কী এক স্বর্গীয় দ্যুতি, নিষ্পলক দু চোখে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। সে হঠাৎ তার বুকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কী
একটা বের করলো, তারপর উপুড় হয়ে আবুলের পায়ের উপর তা রেখে
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। আবুল বস্তুটা হাতে তুলে নিয়ে প্রথমে
ঘরে বাতি জ্বালালো, তারপর ধীরেসুস্থে নিজ আসনে বসে বস্তুটা দেখলো।
একটি সাদা কাগজের মোড়কে ছিলো বস্তুটা। আবুল মোড়কটা খোললো; একটি তাজা গোলাপ। সদ্য ছেঁড়া। ডাঁটাসহ। কয়েকটা কাঁটাও আছে। কাগজে কিছু লেখা।
আবুল পড়লো: “আমার গাছের প্রথম গোলাপ । স্বেচ্ছায় তোমাকে দিলাম। আমি মানি, আমি দুষ্টু, ভীষণ দুষ্টু। কিন্তু সে দিন স্কুলে যাওয়ার পথে
তুমি দুষ্টুমি করতে গিয়ে আমার মনটা ছিনিয়ে নিয়ে, সে দুষ্টু আমিকে
খুন করছো। এখন আমি বাচলেও তোমার জন্য বাঁচবো, মরলেও তোমার জন্য
মরবো। আর বিশ্বাস করো জীবনে এই প্রথম আমি কাউকে গোলাপ দিলাম। অতীতে নিইনি, ভবিষ্যতেও দেবো না। ইতি তোমারই অনামিকা।" চিরকুটটা পড়ে অনেকক্ষণ আবুল
পাথর হয়ে বসে থাকলো। তারপর মনে মনে ভাবলো, এ কীসে জড়াচ্ছে সে। এ কী অক্টোপাশ, নাকি সোনার শিকল! আবার মনকে যুক্তি বলছে: 'শিকল, সে সোনার হলেও শিকল। যত দোষ বয়সের, ঝুঁকি নিতে
ভালোবাসে। আবুলও ঝুঁকি নিলো ।
এরপর ফজরের নামাজ
পড়তে যাওয়ার সময় ঘরে আর তালা দেয় না আবুল, কেবল শিকলটা
দিয়ে চলে যায়। আর নামাজ শেষে এ আশায় ফিরে ঘরে আবছা আঁধারে তার জন্যে অপেক্ষা
করছে তার পরম আরাধ্য উষ্ণ আলিঙ্গন। কিন্তু না, একে একে তিন দিন
অতিক্রান্ত, কেউই এলো না। আশাভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে আবুল
যখন ছটফট করছে, ঠিক তখনই তৃষ্ণার্ত চাতকের জন্যে দু বিন্দু
বারি হয়ে একদিন নিন দ্বিপ্রহরে একটি চিরকুট উড়তে উড়তে এসে পড়লো আবুলের
বিছানায়। দুদিকের দরোজা ভেজানো থাকলেও, জানালা দুটিই
খোলা; চিরকুটটি ঠিক কোন পথে এলো আবুল ঠাওর করতে পারলো
না। লেখা সামান্যই, ঠিকানাবিহীন, তবে হস্তাক্ষর
ভীষণ চেনা। আবুল শোয়া থেকে ওঠে বসে চিরকুটটি পড়লো: “গোলাপের জবাব পাইনি। এক হাতে
কতক্ষণ তালি বাজাবো।” যা বোঝার বুঝলো আবুল। তার অশান্ত মন হলো শান্ত। হঠাৎ করে তার
মনে হলো, 'সুখী, আবুল ভীষণ সুখী।' আবুল বুঝতে পারলো না কী করে তার মনের কথা অনামিকাকে জানাবে। আর জানাবেই বা কী? 'আমি তোমাকে ভালোবাসি (?); না, কথাটা বহু দিনের
পুরানো এবং হালকা। তাহলে? কী বলে আবুল তার সম্মতি জানাবে? কথার জাদুকর আবুলের আজ বড্ড কথার অভাব। হয়তো এ জন্যেই বলে: 'ভাব যেখানে গভীর, ভাষা সেখানে স্তব্ধ। সে রাত্রে পড়াতে বসে আবুল
তার নবম শ্রেণির ছাত্রীটিকে উদ্দেশ্য করে বললো: “কবিতার দুটি পঙক্তি শোনাই।' আবুল আর যায় কোথা। সে বইপত্র সব গুছিয়ে হাত দুটি ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে, তার উপর মাথা রেখে বললো: “এ তো মেঘ না চাইতে জল, এর জন্য সম্মতির
প্রয়োজন নেই। শোনান স্যার।” এই সপ্রতিভ মেয়েটি আবুলকে এক অজানা পবিত্র বন্ধনে
বেঁধে ফেলছে ক্রমশ। আবুল বললো, তা হলে শোনো: “চোখের পরে চোখ রেখো না, পাছে ভীষণ কষ্ট পাবে, সাগর জলে ডুব দিও না, অথই জলে খাবি
খাবে।"
ছাত্রীটি রচয়িতার নাম জানতে চাইলে আবুল নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে এড়িয়ে গেলো
কিন্তু এই ফাঁকে অনামিকা যেন নিজেকে নিজে শুনিয়ে বললো: “আমি পাকা সাঁতারু।
প্রয়োজনে পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
আবুল বুঝলো তার
উদ্দেশ্য সফল। তার প্রমাণও পেলো পরদিন। ফজরের নামাজ পড়ে এসে দেখে দরোজার শিকল
খোলা, তার বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে। আবুল গিয়ে
তার বিছানার একপাশে বসলে শুয়ে থাকা অনামিকা ওঠে বসলো এবং আবুলের ডান হাতটা তার দু
হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থাকলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। কতক্ষণ বসেছিলো আবুল আন্দাজ
করতে পারেনি। তবে আবুলের মনে হয়েছে জন্ম-জন্মান্তর ধরে এমনি করে একজন অন্যজনের
হাত ধরে এক ঠাঁয় বসে আছে। এমনি করেই চলতে পারতো অনামিকার অভিসার। কিন্তু রুনার
ঈর্ষার পাঁকে অনামিকার পবিত্র সম্পর্কটা পঙ্কিলতায় একাকার হয়ে গেলো। একদিন সকালবেলা
বাংলো থেকে অনামিকাকে বের হতে দেখে রুনা তাতে রঙ মেখে এমনভাবে গোটা এলাকায়
ছড়িয়ে দিলো যে, লজ্জায় আর অপমানে আবুল কাউকে কিছু না বলে
একখানা চিঠিতে, “আমি চলে যাচ্ছি। আর আসবো না” এ কথা কয়টা লিখে
টেবিলের উপর চাপা দিয়ে, আপাতত বাড়িতেই চলে এলো। তখন আনুমানিক সকাল
দশটা। আবুল তাদের সামনের পুকুরে গোসল করতে নেমেছে। সাঁতার কাটা আবুলের প্রিয় শখ।
পুকুরে নেমেছে অথচ সাঁতার কাটেনি,
এমন ঘটনা আবুলের জীবনে
কখনও ঘটেনি। সে দিনও আবুল সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের মাঝখানে গিয়েছে, এমন সময় তার ছোটো বোন চিৎকার করে, তাকে ডেকে বললো:
“দাদা, ওঠে এসো, তোমার মেহমান
এসেছে।” আবুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুকুর থেকে উঠে এলো। আর ঘরে গিয়ে যাদের দেখলো, তাদের দেখে তো আবুলের চক্ষু চড়কগাছ। আবুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী এবং তাদের
কাজের মেয়েটা আবুলের খাটে বসে নাস্তা খাচ্ছে। আবুলকে দেখে তার ছাত্রীটি ফুঁপিয়ে
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো: “বাবা আপনাকে এখনই আমাদের সাথে যেতে বলেছেন।” আবুল
আর কথা বাড়ালো না। জামাটা গায়ে চাপিয়ে তাদের পিছে পিছে চললো । বাংলোতে সে ঢুকলো
না। সরাসরি ছাত্রীর বাবার কক্ষে গিয়ে ঢুকলো এবং খাটের উপর তাঁর পায়ের পাশে বসে, তাঁর পা ছুঁয়ে তাঁকে সালাম করলো। তিনি আপন মনে বই পড়ছিলেন, তা-ই করে যেতে লাগলেন, আবুলের দিকে একটি বারও তাকালেন না। তারপর
একসময়, আনুমানিক মিনিট পাচেক
পর বইটা বন্ধ করে
ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে দিলেন। তারপর অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে ডাকতে লাগলেন: “ও
মমতার মা, একটু এদিকে আসো তো।” মমতা তাঁর বড় মেয়ের নাম।
তাঁর ডাক শুনে বাড়ির ভিতর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা ধীর পায়ে এসে
কক্ষটির দরোজায়
দাঁড়ালেন। পরনে লাল পেড়ে শাড়ি। গায়ে ফুল হাতা লাল রঙের ব্লাউজ। মাথায় ঘোমটার
ফাঁকে যেটুকু চুল দেখা যাচ্ছে সবটাই কুচকুচে কালো। গায়ের রঙ ঈর্ষণীয় ফর্সা।
মাথায় খাটো, শরীরের কাঠামো স্থূলতার দিকে। এবার তিনি আবুলের
দিকে তাকিয়ে বললেন: “বলো, তোমার বক্তব্য কী?” আবুল কতক্ষণ আমতা আমতা করে,
শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয়
করে বললো: “দেখুন, আমি আপনাকে অনেক অনেক সম্মান করি। আমি চাই না
আমার জন্যে আপনার এবং আপনার পরিবারের বদনাম হোক । নোংরামি আমার ভালোও লাগে না।
সহ্য করতেও পারি না। তারচেয়ে ভালো,
আপনি আমাকে অনুমতি দেন, আমি চলে যাই।" তখন তিনি বললেন: “শোনো মমতার মা, ছেলে কী বলছে। ছেলে, তুমি কারো কোনো কথায় কান দিও না, নিজের এবং তোমার ছাত্র-ছাত্রীর পড়ালেখা চালিয়ে যাও। বাকিটা আমি দেখবো। তুমি
কী বলো, মমতার মা?” মমতার মা কিন্তু
একটি কথাও বললেন না, যেভাবে ধীর পায়ে এসেছিলেন, সেভাবেই ভিতর বাড়িতে চলে গেলেন। অগত্যা আবুলেরও আর যাওয়া হলো না।
আবুল তার লজিংয়ে
থেকে গেলো। অপরদিকে রুনাও তার মিশন সমানে চালিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে আবুলের
ছাত্র-ছাত্রীদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ । অবশিষ্ট কেবল অনামিকার এসএসসি। এখন ছাত্রী
একা অনামিকা। অন্যরা ইচ্ছে হলে আসে নচেৎ নয়। এ সুযোগটাকে বেশি করে কাজে লাগালো
রুনা। সে 'হয়'কে করলো 'নয়', 'নয়'কে 'হয়'। 'রাত'কে করলো 'দিন', দিন'কে 'রাত'। এলাকায় এমনও
রটে গেলো, অনামিকার সাথে আবুলের বিয়ে হয়ে গেছে। আবুল
ভাবতেও পারে না তেরো-চৌদ্দ বছরের একজন কিশোরী কেমন করে এমন বিষ উগরে দিতে পারে।
তার রটানো কুৎসায় গোটা এলাকায় ঢি ঢি পড়ে গেলো। আবুল কেবল নিজের এবং অনামিকার
পরীক্ষার কথা ভেবে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলো। যথাসময়ে আবুলের বিএ পরীক্ষা শুরু হলো।
প্রথম দিন ইংরেজি। আবুল পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই খবর এলো, তার একমাত্র চাচা
এইমাত্র ইন্তেকাল
করেছেন। অগত্যা আবুলকে বাড়ি হয়েই যেতে হলো। এতে তার পরীক্ষায় বসতে হলো বিলম্বে।
ক্রমে অনামিকার পরীক্ষাও শেষ। আবুল সিদ্ধান্ত নিলো আর নয়, এবার গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে। অবশ্য এর মধ্যে আরেকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলো।
অনামিকার সেজো ভাই, ভীষণ রগচটা; উগ্র ও অশোভন
আচরণের জন্যে পুরো এলাকায় তার বদনাম আছে। ঘরে আর বাইরে তার সমান আচরণ। এমন কী
নিজের মা-বাবাকেও ঈষৎ পরিমাণ সমীহ করে না। কারো গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না।
অনামিকাদের বাংলোর সামনে বিশাল খোলা প্রাঙ্গণ। পুরোটা সবুজ দূর্বায় ঢাকা। মাঝখানে
এক বিরাট আমগাছ। ভালো জাতের আম,
ধরেও ভালো; তাই দেখতে অশোভন মনে হলেও রেখে দিয়েছে। অনামিকার মেজ ভাই সে আমগাছ তলে
দাঁড়িয়ে আবুলকে ডেকে পাঠালো। আবুল তখন চলে যাওয়ার জন্যে বইপত্তর গোছগাছ করছিলো।
সে একটু সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে অনামিকার মেজো ভাইয়ের কাছে গেলে সে কোনো ভূমিকা
ছাড়া বলতে লাগলো: “দ্যাখো, আমি জানি তুমি একজন ভালো ছেলে। তোমার নিজেরও
বোন আছে। আমাদের এলাকার মানুষ শিক্ষিত হলেও নোংরা। পরম্ভ মেয়েদের ব্যাপারটা
এমনিতে সংবেদনশীল। আমি তোমার হাত ধরছি তুমি...।” আবুল তাকে কোনো কথা বলতে দিলো না।
বললো: “তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি এখান হতেই চলে যাচ্ছি। এবং আজকেই
গ্রাম ত্যাগ করবো। আমার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখেছি। দয়া করে আজকের মধ্যে আমাদের
বাড়িতে পাঠিয়ে দিও।” এতটুকু বলে আবুল আর পিছনে ফিরেও তাকালো না, হনহন করে চলে এলো। এদিকে রুনা রটিয়ে দিলো আবুলকে অনামিকার মেজো ভাই মেরে
তাড়িয়েছে।
আবার গ্রাম
ছাড়লো। উঠলো পুরানো ভেরায়। ইতোমধ্যে মুনির পড়ালেখা করে ঢাকার চুকিয়ে আবার
চট্টগ্রাম ফিরেছে। এবার থাকার ব্যবস্থা হলো অন্য স্থানে, কোতোয়ালি থানার সামনে, দরবার হোটেলের পশ্চিম পাশের একটি ছিমছাম ছোট্ট
কক্ষে। মুনিরের বোনদের একবেলা পড়ার বিনিময়ে ও রাতের আহার জোটে, থাকার ব্যবস্থা তো আছেই। বিএতে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছে আবুল। না, চাকরি বাকরি খুঁজছে কপালে থাক,
এমএ পাসের আগে পিছনে
ফিরবে সে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিলিমিনারিতে এডমিশন নিলো, বিষয় বাংলা সাহিত্য। সকালের নাস্তা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের
অর্থের সংস্থানের জন্য আবুল একটি টিউশনি নিলো হাটহাজারীর মদুনাঘাটে, সপ্তাহে তিন দিন। এই তিনদিন অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়ে ওঠে না।
এভাবে টানাপড়েনের ভিতর দিয়ে আবুল খুব ভালোভাবে এটা পাস করে গেলো। কিন্তু পিছনে
রেখে আসা জীবন তাকে একটি মুহূর্তের জন্যও ছাড়লো না। সপ্তাহ, বেশি জোর পক্ষকালের মধ্যে অনামিকা আবুলের সাথে অন্তত একটিবার দেখা করেছে। কখনো
ফয়েজ লেকে, কখনো ট্রেনে ইস্টিশনে, কখনো কোনো বন্ধুর বাসায়। তারা পলকের জন্যও ভাবতে পারেনি, কোনো অশুভ শক্তি তাদের আলাদা করবে। তাদের ভালোবাসার শক্তি ছিলো পবিত্রতা।
এবার আবুল ফিরে
গেলো গ্রামে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে তার সময় কাটে। কী করবে তা
এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি। উদ্দেশ্য একটা ছিলো, কিন্তু তাতে
ভাগ্য পানি ঢেলে দিয়েছে। তার প্রিয় নেশা বটে, তবে এতে আপত্তি
অনামিকার। সময়, এতটুকুন সময় দিচ্ছে না আবুলকে। এ ফাঁকে একবার
সচিবালয়ে যাওয়া হয়েছিলো আবুলের। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সচিব, আবুলদের প্রতিবেশী এবং সম্পর্কে চাচা। আবুলের বলেছেন, এই লোকটির পড়লেখায় যারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন,
তাঁদের মধ্যে
আবুলের বাবাও আছেন। অফিসকক্ষের দরোজায় নেইম প্লেটে চেনা নাম দেখতেই আবুল ভিতরে
ঢুকলো এবং নিজের পরিচয় দিয়ে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলো। অনুমতি পাওয়া
গেলো। আবুল ভিতরে ঢুকে সচিব মহোদয়কে নিজের পরিচয় দিলো এবং তাঁর পায়ে হাত দিয়ে
কদমবুসি করলো। তিনি ইশারায় আবুলকে বসতে বললেন, সে অতীব প্রাচীন
রংচটা একটা চেয়ারে বসে পড়লো তখন তিনি আবুলের সচিবালয়ে যাওয়ার কারণ জানতে
চাইলেন। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলেন আবুলদের এলাকার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি
সর্বজনমান্য আফম শামসুদ্দিন সাহেব,
তাকে দেখেই সচিব মহোদয়
নিজেরই জায়গায় ওঠে দাঁড়ালেন,
আবুল গিয়ে শামসুদ্দিন
সাহেবকেও কদমবুসি করলো। তিনি আবুলকে উদ্দেশ্য করে সচিব মহোদয়কে বললেন, “সদাগর বাড়ির ছেলে, বড় ভালো ছেলে, পড়ালেখায় ভীষণ
মনোযোগী। যতদূর জানি নিজের চেষ্টায় এমএটা ভালোভাবেই পাস করেছে।” উনার কথা শুনে
আবুল সংকোচ এবং লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকলো। এবার সচিব মহোদয় আবুলের দিকে
তাকালেন, প্রথমে ওনার চোখ পড়লো আবুলের মাথায়। সেখানে
কুচকুচে কালো কালো লম্বা চুল আবুলের স্বভাবমতো এলোমেলো। সেটা দেখেই তিনি বললেন:
“লম্বা চুল আমাদের বংশে নেই; আর দ্যাখো চাকরি-বাকরি খোঁজো না, ব্যবসা করো। আমি যে সরকারের এতো বড় পোস্টে আছি তুমি কতোদূর দেশের বাড়ি থেকে
এসেছো, ইচ্ছে করলেও তোমাকে একশটা টাকা দেবো সে
সামর্থ্য আমার নেই।” আবুল বললো: “চাকরি কিংবা টাকা চাইতে আমি আপনার কাছে আসিনি।
এলাকায় আপনার ভীষণ সুনাম। বাবার মুখে আপনার সততার অনেক তারিফ শুনেছি। তাই দরোজার
নেইম প্লেটে আপনার নাম দেখে, আপনার সাথে দেখা করার লোভ সামলাতে পারিনি। তাই
আসা। এবার আসি ।" এতটুকু বলে দুজনকে কদমবুসি করে আবুল স্মিতহাস্যে কক্ষ থেকে
বেরিয়ে এলো। আবুল সচিব মহোদয়ের কথা শুনে ভীষণভাবে আহত হলো। মনে মনে নিজেকে অনেক
অনেক ধিক্কার দিলো। তারপর সোজা বাড়ি চলে এলো। এখন ভাবনা একটাই, সম্মানজনক একটা চাকরির ব্যবস্থা করা, যেখানে বয়সের
বার নেই। চাকরি নিজের জন্য নয়,
চাকরি অনামিকার জন্য ।
ইতোমধ্যে একদিন
আবুলকে ডেকে পাঠালো অনামিকা। সাক্ষাতের স্থান জিইসি, সময় সকাল দশটা। কাকতালীয়ভাবে দুজনই একই সাথে
ভিন্ন গাড়ি। থেকে নামলো। অনামিকা আবুলকে কিছু না বলে একটি রিকশায় উঠে বসলো, আবুলও সুবোধ বালকের মতো অনামিকার পাশের আসনে বসেই রিকশার হুড়কো লাগিয়ে দিলো।
আকাশ মেঘাচ্ছ, বৃষ্টি করছে ঝির ঝির, রিকশার পর্দা নেই, অগত্যা ভিজো।রিকশাওয়ালা দুয়েক প্যাডেলও মারতে
পারেনি, আচমকা বৃষ্টি এলো মুষল ধারে, তার সাথে বেজায় জোরে হাওয়া। আবুলেরা কাকভেজা, রিকশা চালানো
হয়ে পড়লো অসম্ভব। কী একটা উপলক্ষে ইস্কুল বন্ধ ছিলো, এই সুযোগে রিকশাওয়ালা নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে রিকশা ঢুকিয়ে
দিলো। ওয়াশ রুমে গিয়ে আবুল এবং অনামিকা যথাসম্ভব নিজেদের শুকিয়ে নিলো। এবার
আবুল অনামিকাকে বললো: “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?” অনামিকা আবুলের
চোখের দিকে মুখ তুলে তাকালো কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। ঘণ্টাখানেক পর বাতাস থামলে
অনামিকা গিয়ে রিকশায় উঠে বসলো,
আবুলও তার পাশে গিয়ে
বসলো। অনেকক্ষণ চলার পর রিকশা গিয়ে থামলো বায়োজিদ বোস্তামী দরগার গেইটে। রিকশা
থেকে নেমে রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে অনামিকা আবুলকে কোনো প্রশ্নের সুযোগ
না দিয়ে, তার হাত ধরে মাজার শরিফের দিকে হাঁটতে লাগলো।
মাজারের পুকুরের জলে অনামিকা নিজে ওজু করলো, আবুলকেও ওজু
করালো। তারপর সে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে কতক্ষণ কুরআন পড়ে বেরিয়ে
এলো। পরে মাজার পেরিয়ে পাহাড়ের উপর একটি গাছের শাখায় লাল রঙের ডুরি বাঁধলো।
আবুল যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো অনামিকার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলো। এবার সে মাজার
শরিফ থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এলো আবুলও। বাইরে এসে মুখ খুললো অনামিকা, সে বললোঃ "কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে হারাতে চাই না। বাবা তোমাকে
ভীষণ পছন্দ করে। বড়ভাই আর ভাবীর কান ভারী করেছে রুনা। তা ছাড়া ভাবী তো এমনিতেও
আমাদের ভালো পছন্দ করে না। আলালের ঘরের অর্ধশিক্ষিতা দুলালী। আমরা পড়ালেখা করি
তাতে তার ভীষণ আপত্তি। দরগাহ শরিফে আর্জি দিয়ে আসলাম, দেখি কী হয়।” আবুল কেবল শুনে গেলো। কোনো মন্তব্য করলো না । তখন অনেক বেলা
গড়িয়ে গেছে। কারও কিছু খাওয়া হয়নি। আবুল অনামিকাকে কিছু খেতে বললে সে বললো:
এমনিতেও আজ কপালে দুঃখ আছে। আর বিলম্ব
হলে রক্ষা নেই। এখানে মুখে খেলে বাড়িতে গিয়ে পিঠে খেতে হবে। তারচেয়ে বরং তুমি
আমাকে একটা গাড়িতে তুলে দাও। তুমি পরে আসো।” আবুল আর কথা বাড়ালো না। তাকে একটা
গাড়িতে তুলে দিয়ে, তার ভিজে আসা চোখ দুটো রুমাল দিয়ে মুছে নিলো।
কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে সেও পথের গাড়ি ধরলো।
পরদিন আবুলের
চাচাতো বড় বোনের ছেলে বসির বাড়িতে এসে হাজির। সম্পর্কে ভাগনে হলেও বয়সে বড়, তাই আবুল তাকে মামা ডাকে। বছরখানেক আগে একবার এসেছিলো আবুলকে বিসিএস পরীক্ষায়
বসার অনুরোধ করতে। বলেছিল: “মামা-ভাগনে একসাথে বসলে আমাদের কেউ ঠেকাতে পারবে না।
পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তরে যাবো।” কিন্তু বোকা আবুল সম্মত হলো না। তার এক কথা: “
এমএ পাস না করে আর কিছু ভাববো না।” এবার এসেছে যুগপৎভাবে একটি সুসংবাদ ও একটি
অনুরোধ নিয়ে। সুসংবাদ এই যে বিসিএসে মনোনীত হয়ে তার পোস্টিং হয়ে গেছে। আর
অনুরোধ হচ্ছে, এখন সে যে কলেজে আছে, আবুল যেন সে কলেজে তার পরিবর্তে কিছুদিন সময় দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মামা-ভাগনে দুজনই বাংলা সাহিত্যের এমএ। আবুল এক কথায় রাজি হয়ে গেলো এবং পরের
দিন থেকে যাওয়ার কথা দিল।
বেকার আবুলের 'কার' হলো। হোক না বদলা । প্রথম দিন ভাগনের সাথেই
গেলো মামা। গিয়েই বুঝলো ভাগনে অত্যন্ত সফল শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে ঈর্ষণীয়
ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। আবুল মনে মনে শঙ্কিত হলেও মুখে কিছু বললো না। তার ইস্কুলে
শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আছে, কলেজে একদিনেওর না। শিক্ষকতটা নেওয়ায় সবচেয়ে
বেশি বেজার হলো অনামিকা। শিক্ষকতায় তার কেমন যেন এলার্জি। আবুলের জীবনের
বাস্তবতাটা সে বুঝতে নারাজ। চাকরি না করলে তাকে যে না খেয়ে থাকতে হবে, এ কথাটা সে কিছুতেই অনামিকাকে বুঝাতে পারছে না। বুঝাতে পারছে না শিক্ষকতা করে
অনায়াসে ভদ্রভাবে জীবন কাটানো সম্ভব। সম্ভব মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপন।
প্রথম দিন আবুল
দুটি ক্লাস নিলো। একটি প্রথম বর্ষের, একটি তৃতীয়
বর্ষের। কোনো সঙ্কোচ ছাড়া আবুল তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে ক্লাসগুলো নিলো।
কিন্তু তাতেই
কেল্লাফতে। ছাত্র-ছাত্রীরা তড়িঘড়ি করে ঐদিন চতুর্থ ঘণ্টার পর অধ্যক্ষ মহোদয়ের
অনুমতিক্রমে নতুন বাংলা স্যারের বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো। আবুল যতই বলতে লাগলো 'আমি একজন বদলি শিক্ষক', তাদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেলো। তার কথা কেউ কানেই
নিলো না।
এভাবেই চলতে
পারতো। কিন্তু না, চললো না। একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। আবুল
প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকালে পেশকার বাড়িতে পিয়াসের ভাগনিদের পড়াতে গেলো।
ঘণ্টখানেক পর তার জন্য নাস্তা আসলো। নাস্তা খাওয়ার পর কী হলো কিছুই আবুল বুঝলো না
তার শরীরের মধ্যে যেন ভূমিকম্প শুরু হলো। মনে হচ্ছে এখনই তার কিচ্ছু একটা হয়ে
যাবে। হাত-পা সব অবশ হয়ে আসছে। সে গায়ের জামা খুলে ভিতর রুমে খাটের উপর শুয়ে
পড়লো। একটু ধাতস্থ হয়ে কম্পিত পায়ে ধীরে ধীরে বাড়িতে চলে এলো। তারপর শুরু হলো
ডাক্তার-বদ্যি। কোনো ডাক্তারই কোনো রোগ নিশ্চিত করতে পারলেন না, কেবল গ্যাসট্রিকের ওষুধ খাওয়াতে লাগলেন। দিন গড়াতে লাগলো, কিন্তু আবুলের ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো
আবুল পাগল হয়ে গেছে। উন্নততর নার্সিং এবং চিকিৎসার জন্য আবুল তার নানাবাড়িতে চলে
গেলো। আবুলের মামি মন-প্রাণ দিয়ে তার যত্ন-আত্তি করছেন। মিজান এখন ভালো চাকরি করে
। তার কড়া নির্দেশ টাকা-পয়সার জন্য যেন আবুলের চিকিৎসায় অবহেলা না হয় ।
কিছুদিন হলো আবুলের ছোটো মামা ইন্তেকাল করেছেন। এখন আর কারো উপর আবুলের কোনো
অভিমান নেই। এখানে আসার পর কলেজের নাম করে অনামিকা প্রতিদিন আসে; আর সারাদিন আবুলের সেবা যত্ন করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। তার ব্যবহারে আবুলের
নানাবাড়ির সকলেই তুষ্ট। আবুলের মামি তো তাকে বউমা বলে ডাকতে শুরু করে দিলেন।
ডাক্তার-বদ্যির পাশাপাশি তাবিজ-কবজের চিকিৎসাও সমানে চললো কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো
না। আবুলের বন্ধু সাহাদাত নিয়মিত তাকে বিভিন্ন ডাক্তার ও ওঝার কাছে নিতে লাগলো।
এমনি করে অর্ধবছর চলে গেলো। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কলেজ কর্তৃপক্ষ
মাসান্তে পিয়ন দিয়ে আবুলকে তার প্রাপ্য সম্পূর্ণ বেতন নিয়মিত পাঠিয়ে
দিচ্ছিলেন। যখন চট্টগ্রামে কোনো ফল পাওয়া গেলো না, তখন সকলের
সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আবুলকে ঢাকা পাঠানো হলো। উদ্দেশ্য
জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার নুরুল ইসলামকে দেখানো। তিনি চেম্বারে এবং পিজিতে একটানা
তিন দিন আবুলকে দেখলেন এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করালেন। অবশেষে চমৎকার
হস্তাক্ষরে লিখে একটা ব্যবস্থাপত্র দিলেন। তাতে ওষুধের নামের স্থলে ছিলো No Medicine | ব্যবস্থাপত্র হাতে দিয়ে তিনি আবুলকে বললেন:
“দেখো, তোমার শরীরে কোনো রোগ নেই, যে কোনো কারণে মানুষ সংজ্ঞা হারাতে পারে। তোমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে ।
ডাক্তারেরা অনুমানের উপর ড্রাগ দিয়ে তোমাকে যথার্থই অসুস্থ করে তুলেছে।
সকাল-বিকাল নিয়মিত হাঁটবে, স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করবে আর মনে সাহস রাখবে, দেখবে পনেরো দিনের মধ্যেই তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছো।” ডাক্তারের কথা শেষ
হবার আগেই আবুল একটা কাণ্ড করে বসলো। সে উপুড় হয়ে ডাক্তারের পা ছুঁয়ে তাকে
কদমবুসি করলো। ডাক্তার সাহেব এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অনেকটা অপ্রস্তুত
অবস্থায় আবুলের মাথায় হাত রেখে বললেন: “থাক, থাক।”
আবুল আবার কলেজে
যোগ দিলো। ওষুধ বর্জন করেই সে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। নানাবাড়ি ছেড়ে
এখন নিজ বাড়িতে। ফলে অনামিকার সাথে তার দেখা-সাক্ষাৎও হচ্ছে কালেভাদ্রে। এর মধ্যে
জীবনের মূল্যবান আরও একটি বছর অতিক্রান্ত । কলেজে এখন তার খুব সুনাম। ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী, পরিচালনা পরিষদ ও অভিভাবক সকলেরই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তি আবুলকে এমনিভাবে আপ্লুত করেছে যে, সে অন্য কিছু
ভাবতেও পারছে না। অধিকন্তু তার অসুস্থতার সময় পূর্ণ বেতন প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি
তাকে কৃতজ্ঞতার অদৃশ্য রজ্জুতে আষ্টপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। অথচ অনামিকার সাথে দেখা
হলেই তার প্রথম কথা: “তুমি মাস্টারিটা ছাড়ছো কখন? এখন গার্মেন্টসে
প্রচুর সুযোগ, তুমি না হয় কোনো গার্মেন্টসে যোগ দাও। আমি
বাবাকে বলে সুযোগ করে দেবো।” আবুল মুখে কিছু বলে না, কেবল ফ্যালফ্যাল
করে অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবুল মনে মনে ভাবে, 'জীবনে কি টাকাটাই সব, ভালো লাগা, মন্দ লাগা বলে কি
কিছু থাকতে পারে না?' একদিন এ দ্বন্দ্বটা চূড়ান্ত রূপ নেয়। আবুল
কলেজ থেকে ক্লাস শেষে বেরুচ্ছে,
দেখে কলেজ গেইটের এক পাশে
দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। আবুলকে কিছু বলতে না দিয়ে, তাকে দেখেই হাঁটা
দিলো । অগত্যা আবুলেরও আর কী করা,
সেও অনামিকার পিছন পিছন
হাঁটতে লাগলো। কলেজের
উত্তর-পূর্বে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই রেল লাইন। অনেকটা নির্জন। অনামিকা ওদিকেই
হাঁটছে। রেল-লাইনে ওঠে দু লাইনে দুজন দাঁড়িয়ে হাত ধরে ধরে লাইনের উপর দিয়ে
হাঁটা আবুলদের প্রিয় সখ। আজকেও অনামিকা সেভাবে একা লাইনের উপর দিয়ে ইস্টিশনের
দিকে হাঁটছে। আবুল খেয়াল করলো সদা-উৎফুল্ল অনামিকার আজ মুখ গোমড়া, ফর্সা মুখে বিষাদের ছাপ। ইস্টিশন খুব দূরে নয়, মিনিট দশেকের
মধ্যে তারা ইস্টিশনে পৌঁছালো। ইস্টিশনে পৌঁছে সোজা টিকেট কাউন্টারে দিয়ে টিকেট
নিয়ে ফিরতে না ফিরতেই চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারীর দুপুরের ট্রেনের বাঁশি শোনা গেলো।
এতক্ষণে অনামিকা বললো: 'আমরা দোহাজারী যাচ্ছি।' আবুলেরা যে বগিতে উঠলো, ধরতে গেলে সেখানে যাত্রী তারা দুজনই । কয়েকজন
স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে। তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, অন্যদিকে তাকাবার ফুরসতই নেই। এবার অনামিকা একই আসনে আবুলের পাশে ঘনিষ্ঠভাবে
বসে তার ডান হাতটা দু হাতের মধ্যে নিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে দিলো। আবুল হতাশ। মুখে
রুচি নেই; বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মোচড়ে একাকার। আবুলকে
অনামিকা ভালোবেসে মানিক বলে ডাকতো। আজকেও মুখটি আবুলের কানের কাছে নিয়ে কান্না
ভেজা কণ্ঠে চুপে চুপে বললো: “মানিক,
আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো
না। কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি তোমাকে হারাতে চাইনে। খোদার কসম, আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো, না হয় আমি বাঁচবো না।” আবুল তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে যে-ই হাতটা অনামিকার
পিঠে রাখলো অমনি তার মুখ দিয়ে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক শব্দ বেরিয়ে আসলো । সে শব্দে
আবুল চমকে উঠলো। এবং বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে অনামিকার জামা তুলে দেখলো, সেখানে দগদগে ঘা। দেখে তার নিজের চৈতন্য হারানোর দশা। সে নিজেকে সামলে রাখতে
পারলো না, অনামিকার হাত দুটো তার বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে, পারিপার্শ্বিকতার কথা ভুলে হু হু করে কেঁদে উঠলো। এবার অনামিকা বললো: “বাবার
ধারণা, তুমি আমাদের এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, বিসিএসে বসলে এক চান্সে উত্তরে যাবে। তাছাড়া এমনিতেই তিনি তোমাকে পছন্দ করেন।
কিন্তু ঘরের আর সকলের কান ভারি করেছে রুনা। তোমার সম্পর্কে তাদের ধারণা যা-তা। এই
অবস্থা থেকে তুমিই আমাকে উদ্ধার করতে পারো। তুমি অন্তত একবার বিসিএসে বসো। তারপর কপালে
যা থাকে হবে । আজকের পর তোমার সাথে আমার দেখা হবে না। আমার বিএ পরীক্ষা শেষ। কলেজ
বন্ধ। আর কোনো অজুহাতেই ঘর থেকে বের হতে পারবো না।”
আবুল কতক্ষণ
চুপচাপ অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু তার চোখে অনামিকার মুখ নয়, বেত্রাঘাতে ঘা হয়ে যাওয়া পিঠটাই ভাসতে লাগলো। আবুলের নিজেকে মনে হলো বড্ড
বেশি অপরাধী। তারপরও সে বললো: “দ্যাখো অনামিকা, তুমি কি আমাকে
ভালোবেসেছো, না আমার মেধাকে? যদি আমি বিসিএসে
না বসি, তাহলে কি তুমি আমাকে ভুলে যেতে পারবে? আর আমি বিসিএসে বসেও যদি কৃতকার্য না হই, তাহলে?”
অনামিকা আবুলের
কথা শুনে খুব হতাশ হলো। এবং বললো: "তুমি আগে থেকে সব নেতিবাচক ভাবছো কেন? তুমি কী আমার জন্য হলেও একটু পজেটিভ হতে পারো না?” অগত্যা আবুলকে মুখ খুলতে হলো। সে বললো: “দেখো অনামিকা, আমার মতো ভাগ্য নিয়ে যাদের জন্ম তাদের কিছু আশা করা পাপ। আমরা যখনই কোনো
আশায় বুক বাঁধি, তখন মাথার উপর মুচকি হাসে। না হয় আমারও খুব
ইচ্ছা ছিলো আর কিছু না হোক, তোমাকে আমি বিসিএসটা উপহার দেবো। কিন্তু
বিসিএসের ফরম পূরণ করতে গিয়ে দেখি,
আমার বয়স বেশি হয়ে
গেছে। মাত্র তিন দিনের জন্য বিসিএস আমার নিকট থেকে লক্ষ লক্ষ যোজন দূরে চলে গেলো ।
এখন তুমি বলো আমার করণীয় কী?” আবুলের কথা শুনে অনামিকা বজ্ৰাহত মানুষের মতো
নিশ্চল পাথর হয়ে গেলো। দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না । যার যার মতো করে দুজনেই
বাড়ি ফিরে গেলো ।
আবুল এখন নিজেকে
বাড়ি এবং কলেজের মধ্যে গণ্ডীবদ্ধ করে ফেলেছে। বাজার ছেড়েছে, ছেড়েছে আড্ডা, ছেড়েছে বন্ধু-বান্ধব। এমন কী তার জীবনের
অচ্ছেদ্য অঙ্গ পঠন-পাঠন তাও এক রকম বন্ধ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে, বৃষ্টি বাদলের আশঙ্কা না থাকলে,
সাঁঝটা কাটায় চোরাবিলের
মাঝখানে গ্রাম্য-রাস্তার পাশে। আকাশে একট-দুটা করে তারা ফুটে ওঠে, কালো কালো লেজ লম্বা ফিঙেগুলো ছোটো ছোটো রঙ-বেরঙের ফড়িংগুলো ধরে ধরে খায়।
ছোটো ছোটো কতো চেনা-অচেনা পাখি ফিরছে কুলায়, আপন খেয়ালে, আর কোনো দিকে নেই তাদের খেয়াল। অনেক দূরের গ্রামের অন্ধকার রেখা ভেদ করে
বাতির মিটি মিটি আলো চোখের আলোতে মিশে একাকার। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে আনছে অমিয়
শান্তি, যাতে দেহ আর মন দুটোই জুড়িয়ে শীতল। উপরে আকাশ, নিচে দিগন্ত-বিস্তৃত ধানি জমি,
সর্পিল মেঠো পথে একটি
বিন্দু আবুল, আর কিছু নেই কেউ নেই। শূন্য চারদিক শূন্য।
এমনিই চলছে, এমনিই চলতে পারতো অনন্তকাল। কিন্তু না, ভবিতব্য তা হতে দিলো না। এলাকায় রটে গেছে সওদাগর বাড়ির আবুল অসুস্থ। তার
মাথার ঠিক নেই। জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামও কোনো ওষুধপত্র না দিয়ে এক প্রকার
জবাব দিয়ে দিয়েছেন। কথাগুলো আবুলের কানেও এসেছে, কিন্তু সে কোনো
প্রকার জবাব দেয়ারও চেষ্টা করেনি। কেবল মনে মনে হেসেছে। আর ভেবেছে অনামিকা এবং
তাদের পরিবার বিষয়টা কীভাবে নিচ্ছে। কারণ গোটা এলাকার মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস
আবুলের এই অবস্থার জন্য দায়ী জাদু। এবং এ জাদু-টোনা করেছে স্বয়ং অনামিকা কিংবা
তার পরিবার। আবুলের পরিবারেরও এ বিশ্বাস। তাই তারা সোজা পথ ছেড়ে বাঁকা পথে অনেক
টাকা-পয়সা নষ্ট করেছে। এমন কী গোটা গোটা ছাগলও সদকা করে দিয়েছে। কেবল আবুলেরই
বিশ্বাস এসবই অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রয়া ।
এখন ঘটনাটা আর
দুটো পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধতা নেই। এলাকার দুজন মানুষও একত্র হলেই এ ঘটনা আলোচনা
করে। শুনেছে অনামিকাকে বাড়িতে রাখেনি। দূরে কোনো আত্মীয় বাড়িতে পাঠিয়ে
দিয়েছে। অন্যদিকে চলছে বিয়ের তোড়জোড়।
শোনা কথা যদি সত্যি হয় তবে এ বিয়েতে অনামিকারও সম্মতি আছে। তারপরও সাবধানের মার
নেই, তাই অনামিকাকে বাড়িতে না রাখা। অবশ্য আবুলের
মনে অন্য ভাবনা। মা নেই, মায়াও নেই। নেই মমতার বন্ধনও। বড় বোনেরা নিজ
নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত, ভগ্নিপতিরা ভীষণ ভীষণ নীতিবাগীশ, আবুলের পাগলামির বিপরীতে তাদের অবস্থান; বন্ধু-বান্ধব
জীবিকার তাগিদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। কেবল ছোটো বোনের দাদা অন্তপ্রাণ ৷ তারও
বিশ্বাস তার দাদার বিনাশের কারণ অনামিকা। তাই তার দায়িত্ব দাদাকে অনামিকা থেকে
হাজার যোজন দূরে রাখা।
সেদিন
বিষ্যুদবার। শারদীয় চাঁদের রুপালি জোছনা কচি কচি ধানগাছে স্বপ্নের আসর বসিয়েছে।
নীল আসমানের নীল পরীরা ধান গাছের হিল্লোলে হিল্লোলে খাচ্ছে দোল। মাঝে মাঝে দুষ্টু
চাঁদ সাদা মেঘের ওড়নায় ঢাকছে মুখ। আকাশের অগুনতি তারা চাঁদের আলোয় কেমন আলো
হারা। ভালো নেই আবুলেরও মন। আজ অনামিকা আন্-বাড়ি যাবে তারই 'আঙ্গিনা দিয়া'। ভাবনায় বিভোর সে। সকলের অজান্তে সন্ধ্যা
নামতেই তাই ঠাঁই নিয়েছে চোরাবিলের মেঠো পথে। এখানে প্রকৃতি বড়ো উদার, মানুষের সংকীর্ণতা ধুয়েমুছে একাকার। চাঁদ, তারা, কচি সবুজ ধানগাছের আনন্দনৃত্য- এসবের ভিতর কতক্ষণ আত্মনিমগ্ন ছিলো আবুল, তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু যখন কল্পনার নীল পরী লাল বেনারসিতে সেজে
রূপ-অপরূপ বেশে আবুলের সামনে এসে হাজির তখন তার সম্বিত ফেরে। হাতে ঘড়ি নেই সময়
দেখবে, চাঁদ দেখেও আন্দাজ করতে পারছে না রাত কতো
হয়েছে। বেনারসি দেখেই আবুলের যা বোঝার বুঝলো। তার পালস বেড়ে গেলো, শুরু হলো হৃদকম্প। কোনো মতে কম্পিত কণ্ঠে বললো; “তুমি!” সে আর
বিলম্ব করলো না। আগন্তুকের হাত ধরে দ্রুত বাড়ির পথ ধরলো। ছোট পুকুরের আগে মেঠো
পথটি পুবদিকে বাঁক গিয়েছে। সে বাঁকে এসে আবুল দেখে তার ছোটো বোন হারিকেন হাতে
দাঁড়িয়ে। আবুলকে দেখেই সে বললো: “দাদা, এতোদিন আমি
তোমাদের বিরোধিতা করেছি, কিন্তু আজ তোমাকে মিনতি করছি, অনামিকাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না,
তুমি ভেবে দেখো, কখন একটি মেয়ে একা এতো রাতে বিয়ের বাসর থেকে পালিয়ে আসতে পারে?” আবুল হাঁটতে হাঁটতেই বলল: “দেখ বোন, আমি সব বুঝি। সে
গতকাল এমন কী আজ সকাল কিংবা দুপুরে এলেও আমার প্রাণের বিনিময়ে
হলেও রেখে দিতাম। আমি জানি এ বিয়ে তার সম্মতিতে ঠিক হয়েছে; বর আর বরযাত্রী এসে গেছেন, এখন যদি আমি একে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাই,
তাহলে তার পরিবারের
অবস্থা কী দাঁড়াবে। মেহমানদের কী জবাব দেবে, কাল সকালে এলাকায় তার বাপ-ভাইয়েরা মুখ দেখাবে
কী করে! না বোন, আমি আমার একার
সুখের জন্য একটি পরিবারের এত্তো বড় সর্বনাশ করতে পারবো না, যা তুই বাড়ি চলে যা, আমি একে ওর বাপের হাতে তুলে দিয়ে এখনই ফিরছি।
আমার জন্য ভাবিস না, আমার কিচ্ছু হবে
না।
এতক্ষণে অনামিকা
মুখ খুললো। বললো: “তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি আর ফিরে যাবো না। এখন আমার সাথে যা আছে তাতে দুজনের এক বছর চলে যাবে। তুমি
শুধু আমাকে আজ রাতের মতো কোথাও লুকিয়ে রেখো। কাল সকালেই আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে
করে দূরে কোথাও চলে যাবো। যেখানে আমার বাপ-ভাইয়েরা কেউই নেই।” আবুল মন দিয়েই
অনামিকার কথা শুনলো। তারপর বললো: “আমি বোকা মানুষ। তোমার মতো অতো হিসাব আমি বুঝি
না। তুমিই আমাকে পথে নামিয়েছো, আর যেই শুনলে,
আমার সরকারি চাকরির বয়স
অতিক্রান্ত, ওমনি মাঝপথে
ফেলেই চলে গেলে। কিন্তু তারপরও আমার মৃত্যুর পরও তোমার জন্য আমার হৃদয়ে তোমার
স্থানটা শূন্যই থেকে যাবে। কিন্তু এখন আমার করার কিছু নেই। আবেগের বশে আমি কিছু
করলে, একদিন তুমিই আমাকে ঘৃণা
করবে, আমাকে ক্ষমা করবে না
কোনোদিন।” এই বলে আবুল অনামিকার হাত ধরে অনেকটা টানতে টানতে তাদের বাড়ির দিকে
চললো।
আবুল অনামিকাকে
সোজা ঘাটা দিয়ে নিলো না। সে পথে বহু লোকের আনাগোনা। বিয়েবাড়ি বলে কথা। বাড়ির
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, হয় অনামিকার
পালিয়ে যাওয়া এখনো কেউই জানে না, না হয় বিষয়টাকে
আপাতত গোপন রেখে পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার চেষ্টা চলছে ভিতরে ভিতরে। আবুল ঘুর পথে
রুনাদের বাড়ির ঘাটা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলো, সেখানে রুনাসহ কয়েকজন মহিলা জটলা করছে। আর
ফিসফিস করে কী যেন বলাবলি করছে। আবুলের সাথে কনের বেশে অনামিকাকে দেখে রুনা হঠাৎ
করে কোথায় উধাও হয়ে গেল; এবং দণ্ডের মধ্যে
অনামিকার সেজো ভাইকে সাথে নিয়ে হাজির। অনামিকার সেজো ভাই এমনিতে ভীষণ
দুষ্ট প্রকৃতির, তার উপর অনামিকার
বিয়ের বাসর থেকে পলায়ন; সবকিছু মিলিয়ে
এখন সে যুদ্ধংদেহী। হাতে বাশের শক্ত লাঠি, জামা কাপড় গুটানো। এসে একটি শব্দও না করে আবুলের মাথা বরাবর সজোরে মারলো
লাঠির বাড়ি। আবুল এর জন্য প্রস্তুত ছিলো না; বরং সে প্রত্যাশা করেছিলো তার কাজে তুষ্ট হয়ে
গোটা পরিবারটা কৃতজ্ঞ থাকবে তার প্রতি। কিন্তু অনামিকা তার সেজো ভাইকে ভালো করেই
জানতো। তাই আবুলের পরিণতি সম্পর্কে তার যথার্থ ধারণা ছিলো । এবং তার জন্য
প্রস্তুতও ছিলো। সে চোখের পলকে ছুটে এসে আবুলকে সরিয়ে দিলো, ফলে বাঁশের বাড়িটা তার মাথায় লাগলো, সাথে সাথেই ফিনকি দিয়ে ছুটলো রক্ত। অনামিকার
অবস্থা দেখে আবুলের হাত-পা কাঁপতে লাগলো। আস্তে আস্তে ওর চেতনা লোপ পেলো। চেতনা
হারাতে হারাতে সে শুনতে পেলো অনামিকার কণ্ঠ। সে বলছে: “আমার কিচ্ছু হবে না,
আমি ভালো আছি। পালাও,
তুমি পালাও। এ স্বার্থপর
জানোয়ারগুলো তোমার ত্যাগের মূল্য বুঝবে না। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
আবুলের যখন জ্ঞান
ফিরলো তখন সে চট্টগ্রাম মেডিকেলের একটি কেবিনের সিটে শুয়ে আছে। তার চারপাশে
অপেক্ষমাণ তার কাছের লোকজন। ছোট বোনটিও আছে সাথে। তখনও তার হাতে স্যালাইন লাগানো।
শরীর-মন দুটিই দুর্বল। কথা বলার শক্তিও পাচ্ছে না। তারপরও চোখ খুলে প্রথমেই জানতে
চাইলো অনামিকা কেমন আছে। উপস্থিত মুরব্বি ধরনের কেউ একজন বললেন: “সে মরেছে। তুমি
আমাদের আর ডুবাইও না। নিজের জন্য আল্লাহকে ডাকো।”
আবুল আর কিছু
বললো না, নিমীলিত নয়নে
চুপচাপ শুয়ে থাকলো ।
দু দিন পর আবুলকে
হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলে সে বাড়িতে এসে উঠলো। ডাক্তার ব্যবস্থাপত্রে পরামর্শ
দিয়েছেন সাত দিনের বেড-রেস্ট। আবুল কিন্তু পরদিনই কলেজে যোগ দিলো এবং
সপ্তাহখানেকের মধ্যে কলেজের পাশেই বাসা নিয়ে সেখানে চলে গেলো । কলেজ আর বাসা,
বাসা আর কলেজ- এখন এই হলো
তার জীবন। লেখালেখির একটা অভ্যাস ছিলো, এখন মন সেদিকেও সায় দেয় না। অনেকটা নিজেকেই নিজে নিজের কাছে বন্দি করে
রাখলো আবুল।
সময়ের রথ সদা
চলমান। কী আনন্দ, কী দুঃখ কোনো
কিছুতেই তার রথের চাকা থামা তো অনেক দূরের কথা শ্লথও হয় না। দেখতে দেখতে দুটো বছর
কেটে গেলো। শিক্ষক হিসেবে কলেজ এবং কলেজের আশপাশে আবুলের বেশ নাম। এই দু বছরে আবুল
তার বাবার দাফন-কাফন করেছে। ছোটো বোনের বিয়ে দিয়েছে। ছোট ভাই পড়লেখা ছেড়ে
চাকরি ধরেছে। আলমের ঘরে বউ এসেছে। বউয়ের কোল জুড়ে এসেছে চাঁদের মতন সুন্দর
ফুটফুটে ছেলে । কেবল বদলায়নি আবুল। তার জীবন-বৃক্ষের ডালপালা সব পত্রশূন্য । একটা
শুকনো শিকড়ের পর একটি ধূসর কাণ্ড কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে । আজ আর কোনো স্বপ্নও
নেই অবশিষ্ট। সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে ক্রমশ ভাটির দিকে যাচ্ছে সে। জানে না কতদূর আর
যেতে হবে। কখন হবে এই ভেসে চলার ইতি। জানে না, আবুল জানে না।
আবুলের বাসার কোল
ঘেঁষেই রেল রাস্তা। রাস্তা ধরে মিনিটখানেক হাঁটলে একটি গেঁয়ো ইস্টিশন। ইস্টিশনটা
মান্ধাতার আমলের। এখনও ছোট্ট একটা টিকেট ঘর আছে কিন্তু টিকেট দেওয়ার কোনো লোক
নেই। তারপরও গাড়ি এখানে স্বল্প সময়ের জন্য থামে। এখান থেকে গত দু বছরে একজন
যাত্রীকেও ট্রেনে চড়তে দেখেনি আবুল। কিন্তু কয়েকবার নামতে দেখেছে। যখন কিছুতেই
আর আবুলের সময় কাটে না, তখন এখানে এসে
আবুল নিজেকে ইতিহাসের অংশ করে নেয়। কথিত আছে আত্মগোপন করে থাকার সময় মাস্টারদা
সূর্য সেন নাকি একবার এই ইস্টিশনে নামছিলেন। পুরোটাই শোনা কথা, সত্য-মিথ্যা কিছুই আবুল জানে না। তারপরও ভাবতে
ভালো লাগে। এখন ইস্টিশনের টিকেট ঘরটা বুনো শিয়ালের নিরাপদ আশ্রয়, এলাকার ছেলে-ছোকরারা ময় মুরুব্বির দৃষ্টি
এড়িয়ে মাঝে মধ্যে তাসের আসর বসায়। আর আবুল আসে নির্জনে একটু নিজেকে ফিরে দেখতে।
বিস্মৃত স্মৃতির পাতা উল্টাতে। বাসা থেকে ইস্টিশন পর্যন্ত রাস্তার দু পাশে বুনো
লতা-পাতায় ঠাসা। মাঝে মাঝে বড় আকারের বনস্পতিও চোখে পড়ে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার
হচ্ছে এই ঘনবসতির বাংলাদেশে এখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাড়িঘরের কোনো চিহ্ন
পর্যন্ত নেই। দুয়েকটা ছোট ছোট টিলা আর একটা
বিশাল পুকুর দৃষ্ট হয় মাত্র। পুকুরের পানি, ডাবের পানির মতো পরিষ্কার। দূর-দূরান্ত থেকে
বউ-ঝিয়েরা কলসি কাঁখে আসে জল ভরতে। আসে সকাল কিংবা বিকেলে। দুপুর এবং সাঁঝে
পশু-পক্ষীও পুকুরটার ধার ঘেঁষে না। সকলের ধারণা এখানে অশুভ আত্মাদের বাস। এ নিয়ে
এলাকায় অসংখ্য মুখরোচক ভীতিপ্রদ কাহিনী প্রচলিত। আবুল অবশ্য এসব বিশ্বাস করে না।
তবে কোনো চোর-ডাকাতের আস্তানা বানানোর জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।
সেদিন শুক্রবার।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সারা সপ্তাহের সকল কাপড়-চোপড় কেচে কোনোমতে কাক-স্নান সেরে
আবুল তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লো। আবুলের কেন জানি মনে হলো, কী এক অমোঘ শক্তি তাকে বাইরের দিকে টানছে।
ব্যাখ্যাতীত এক বিষণ্ণতা নিয়ে আবুল প্রথমে আরাকান সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ
গেইটে আসলো। সেখানে তার সাথে সোনা মিঞা নামের বয়স্ক এক দপ্তরির দেখা। দীর্ঘদিন
ধরে কলেজে আছে, আবুল তাঁকে চাচা
বলে ডাকে । তিনিও আবুলকে ভীষণ স্নেহ করেন। তবে আবুলের পদের কারণে তাঁর প্রকাশিত
স্নেহে শ্রদ্ধা মিশে এক ভিন্নতর রূপ গ্রহণ করে। অনেকটা ‘তু-পনি’র মতো। আবুল তাকে
নিয়ে কলেজের গেইটের চা দোকানে গিয়ে চা আর নাস্তা সারলো। দোকানেও বেশিক্ষণ বসে
থাকতে পারলো না। কীসের এক অদৃশ্য টান সে প্রাণে প্রাণে অনুভব করতে লাগলো। সোনা
মিঞা চাচাকে বিদায় দিয়ে সে আরাকান সড়কের উত্তরপাশের মেঠো পথ ধরে ইস্টিশনের দিকে
হাঁটতে লাগলো আনমনে। আজ শুক্রবার, জুমার নামাজ আছে,
সেটাও সে বেমালুম বিস্মৃত
হলো। হঠাৎ কয়েকটা গেঁয়ো কুকুর একটি বুনো শিয়ালকে তাড়া করা শুরু করলো।
শিয়ালটা অনেকটা আবুলের দিকে ছুটে আসতে লাগলো। আবুল নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে রাস্তার
একপাশে লাফ দিলো। এতে শিয়াল-কুকুরের কবল থেকে বাঁচলেও তার বাম পায়ের জুতা-পার্টি
ছিঁড়ে গেলো। অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও যখন জুতা পার্টি ঠিক করা গেলো না তখন অন্য
পাটি জুতাও খুলে একটি ঝোপের আড়ালে রেখে দিয়ে আবুল খালি পায়ে হেঁটে ইস্টিশনে
গেলো। ইস্টিশনে পৌঁছে পুবদিকে দৃকপাত করতেই আবুল দেখলো একটি যুবক আরেকটি যুবতীর
হাত ধরে, রেলের দু লাইন
দিয়ে দুজন সাবলীলভাবে হেঁটে আসছে। আবুলের কেমন যেন রোখ চেপে গেলো, পায়ে জুতা না থাকার সুবিধাও
আছে। সে-ও যে পাশে যুবকটি আছে, সে পাশের রেললাইন
ধরে ওদের মুখোমুখি হাঁটতে শুরু করলো। আর মনে মনে ভাবলো, কারা এরা? কী এদের পরিচয়? আবুল আর অনামিকার পরিচিত কেউ? এ রাস্তা চিনলো কী করে? এটা তো অনামিকার আবিষ্কার?
এসব ভাবনার মধ্যে
আবুল ও আগন্তুক ভদ্রলোক কখন যে মুখোমুখি হয়ে গেছে, আবুল তা টেরও পায়নি। আবুলকে জায়গা করে দিতে
গিয়ে ভদ্রলোকটির হাত তাঁর সাথীর হাত থেকে ছুটে গেল, আর তিনি লাইনচ্যুত হলেন, আবুল তার পায়ে জুতা না থাকার সুবিধা পেলো,
তাই সে লাইনচ্যুত হলো না।
আগন্তুক যুবতীটি তড়িঘড়ি করে তার সাথীর হাত ধরতে গিয়ে আবুলেরই হাত ধরলো। সে
হাতের স্পর্শে আবুলের সারা অঙ্গে নিমেষেই বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সে চোখ তুলে দেখে
চমকে উঠলো। তার মনে হলো এ মুখ তার জন্ম-জন্মান্তর ধরে চেনা। রঙটা আগের চেয়ে
কিছুটা ফর্সা হয়েছে, গায়ে-গতরে কিছু
মাংস ধরেছে, আর সিঁথি বরাবর
কপালে বেশ বড় একটা কাটা অথবা ফাটার দাগ, যা অমন লম্বা এবং কুচকুচে কালো কুন্তলেও ঢেকে রাখা যায়নি। আবুল বাকরহিত,
যুবতীটি বিস্ময়াহত আর
ভদ্রলোক লজ্জিত। কতক্ষণ? না আবুল তা জানে
না।
হঠাৎ ট্রেনের
তীব্র বাশির শব্দে আবুলের চৈতন্য ফিরে আসে। ত্রিভুজাকৃতির জায়গায় খেলারত
কিশোর-কিশোরীরাও খেলা থামিয়ে দেখে ট্রেনটা আসছে কোন দিক থেকে। ইস্টিশনের দিক থেকে?
দোহাজারির দিক থেকে?
ভার্সিটির দিক থেকে?
না, এখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কেবল বাঁশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বুড়ো আবুল
এখনো বোঝে গাড়ির গতির চেয়ে শব্দের গতি অনেক বেশি। তাই আগে শব্দ, পরে ট্রেন। কিন্তু প্রেম আর জীবনের মধ্যে কার
গতি বেশি? প্রেম না জীবনের?
না, সে অঙ্ক আবুলের মেলেনি। এ পরীক্ষায় আবুলের
প্রাপ্ত নম্বর শূন্য, এক মহাশূন্য।