ফেরা (এক টুকরো রোদ) - ৩
ফেরা
শেষ রাতের মিথিলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে আর শুয়ে থাকতে পারে না। বালিশ থেকে মাথা তুলে হাঁটু মোড়া করে বিছানায় বসে থাকে। আধারের মাঝে চোখ মেলে দেখতে চায়।ঘরের ভেতরের আধার আর বেড়ার ফাঁকে বাইরের আঁধার তার ভেতরটা আচ্ছন্ন করে তোলে। থেমে থেমে রাত জাগা পাখির ডাক তার ভাবনাকে টুকরো টুকরো করে দেয়। অতি চেনা পাখিরাও হটাৎ নতুন সুরে গাইতে থাকে। আজ কিন্তু পাখিদের কন্ঠের সাথে নিজেকে মেলাতে পারে না। সে ।স্বপ্নের ঘোরে কখনো ঘুমভেঙ্গে গেলে এতদিন বুনোদের ডাক অশুভ কান্নার মত মনে হতো ।নিশাচর পাখিরা কান্নার ভেতর দিয়ে অমঙ্গলের আগাম বার্তা শুনিয়ে ভেতরটা তোলপাড় করে দিতো ।
সবুজ পাতায় পাতায় জমে উঠা শিশির বিন্দু বিন্দু হয়ে নিশি রাতে গাছতলায় শুকনো পাতায় ঝরে পড়ে। নিথর নীরব অরণ্যে শুকনো পাতায় শিশিরের শব্দ সে কান পেতে শুনে। একের পর এক সব স্বপ্নরা ভেঙ্গে গেলেও একটি স্বপ্ন সে হারাতে পারেনি। সেই স্বপ্নটিই এতদিন তাকে অপেক্ষায় রেখেছে। এমনিতেই খুব ভোরে জেগে উঠে সে।
রাতের আঁধারটা যখন ধীরে ধীরে আলোর ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে। প্রকৃতির রং বদলের এই আদিম খেলায় পাখিরা যখন সমবেত কন্ঠে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে। মাচার নীচে খোয়ারের ভেতর শুয়রেরা ভয়ে পোষাদের নিঃশ্বাসের শব্দ বাতাসকে কাঁপিয়ে দেয়। ভোরের আলোর সাথে সাথে বুনোরা গভীর অরণ্যে চলে যেতে শুরু করে। মিথিলা পোষাদের খোঁয়াড় আর খোপ থেকে বের করে দিয়ে কিছুক্ষন কবুতর জোড়ার সাথে আপন মনে কথা বলে। তারপর বাসি হাড়ি পাতিল আর মাটির কলস নিয়ে খালের দিকে পা বাড়ায়। তখন পায়ে পায়ে হাঁস আর শুয়োরের ছানা কয়টি এগিয়ে যায়।
মিথিলা কয়েকবার গতি ফেরাতে চেয়েও পারে না। কোনমতে পিছু ছাড়ে না। রাতের কুয়াশায় ভিজে যায় আশপাশ টিলা পথ। পথের দু'ধারের লতাগুলা কুয়াশার ভারে নুয়ে পড়ে লালচে মাটির ওপর। পোষা শুয়রেরা আগে হেঁটে হেঁটে পাতায় পাতায় জমে উঠা কুয়াশা যেন লোমশ শরীরে জড়িয়ে নেয় হাঁসের পালক আর মিথিলার পায়ের পাতা কুয়াশায় সিক্ত হয়ে উঠে। পায়ের তালুতে লালচে মাটি লেগে পা যুগল ভারী ঠেকে সে পরনের থামি হাঁটু বরাবর তুলে। পায়ের গোড়ালীতে কখনো হাঁসেরা ঠোঁট লাগিয়ে যেন আদরের ছোঁয়া দিয়ে যায়। সে ফিরে আসতে বারে বারে থেমে যায়। তার মায়া হয়।
আসলে পোষাদের মত করে কেউ ভালবাসে না। কথা বলতে না পারলে কি হবে। এদের ভাষা একবার বুঝতে পারলে হয় । কি যে অকৃত্রিম এদের সান্নিধ্য । নিঃশব্দ রাতের অন্ধকারেও টের পায় রাহুল যে রাতে এসেছিল অমাবশ্যার অন্ধকার নেমেছিল সে রাতে । কোথাও পাতা পড়ার শব্দও ছিল না। সে উঠানে এস দাঁড়াতে পোষারা এমন চুপিসারে ডেকে উঠলো যা আগে কখনো মিথিলা শুনেনি। কিছুতেই দু'চোখের পাতা সে এক করতে পারছিলো না। কৈশোরের স্মৃতিরা একের পর এক চোখের উপর ভাসতে থাকে । খেলার সাথী থেকে কিভাবে যে রাহুল মনের সাথী হয়ে উঠলো টেরও পায়নি সে।
মুখ খুলে বলার সুযোগও হয়নি কোনদিন। কিভাবে হবে?খেলার কোন সময়ে পেরে না উঠলে রাহুল ক্ষেপে যেতো। খেলা শেষে প্রায় মিথিলা তার হাতে মার খেয়ে ঘরে ফিরতো। রাহুল চুপচাপ স্বভাবের হলেও বড়ই একরোখা । সহজে কোন কিছু মেনে নিতে পারতোনা । সেই কিশোর বালকটি একদিন এসে মিথিলাকে বললো, আমি চলে যাচ্ছি। কবে ফিরি ঠিক নেই, হয়ত জীবনে নাও ফিরতে পারি ।
মিথিলা রাহুলের কথা শুনে অবাক কণ্ঠে বলে, কোথায় যাচ্ছিস তুই? তা বলা যাবে না। কেন ? এমনকি বাবা মাকেও না।
মিথিলা গলা নামিয়ে বলে এমন কোন্ জায়গা যেখানে যাচ্ছিস অথচ কাউকে বলতে পারছিস না। রাহুল এবার বলে আমি নিজেও জানি না। তবে এতটুকু তোকে বললাম আর কেউ জানে না আমি যে চলে যাচ্ছি। সেদিন মিথিলা কথাগুলো পুরাপুরি বুঝতে পারেনি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে কথাটি যখন জানাজানি হয়ে গেল তখন সে বুঝতে পারল রাহুল শান্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে । হঠাৎ মনটা শিহরে উঠলো, সেখান থেকে তো ফেরার কোন পথ নেই । তবুও হৃদয়ের ভেতরটা দিনের পর দিন বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে উঠতে শুরু করলো।
মিথিলা গলা নামিয়ে বলে এমন কোন্ জায়গা যেখানে যাচ্ছিস অথচ কাউকে বলতে পারছিস না। রাহুল এবার বলে আমি নিজেও জানি না। তবে এতটুকু তোকে বললাম আর কেউ জানে না আমি যে চলে যাচ্ছি। সেদিন মিথিলা কথাগুলো পুরাপুরি বুঝতে পারেনি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে কথাটি যখন জানাজানি হয়ে গেল তখন সে বুঝতে পারল রাহুল শান্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে । হঠাৎ মনটা শিহরে উঠলো, সেখান থেকে তো ফেরার কোন পথ নেই । তবুও হৃদয়ের ভেতরটা দিনের পর দিন বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে উঠতে শুরু করলো।
প্রথম প্রথম মিথিলা এসব ভাবনা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে । ভয় আর লজ্জায় তাকে আঁকড়ে ধরে। নিজের কাজকর্মে লেগে থাকে সারাদিন। তাঁতে কাপড় বোনায় সময় দেয় বেশি। সাদা সুতাকে লাল কালো রঙে ভিজিয়ে শুকায় আগে তারপর দু'রঙা থামি বোনার কাজে লেগে যায়। কিন্তু মন থেকে রাহুলকে ফেলতে পারেনা। তাঁতের মাঝে লাল আর কালো সুতার বুনন যখন পর পর সাজাতে থাকে তখন রাহুল যেন তার পুরো কাজটাকে এলোমেলো করে দিতে চায়।
কেন এত কষ্ট করে কাপড় তৈরী করছিস। তুইতো ঠিক মূল্য পাবি না। তোকে ঠকিয়ে বেপারী চড়া দামে বিক্রি করবে। কিন্তু আমার থেকে যে বেপারী ছাড়া কেউ নেবে না। কিছুদিন অপেক্ষা কর আমরা ফিরে এলে নিজেরাই বাজারে বিক্রি করব। ব্যাপারীদের কোন কাপড় নেব না । সে রাতে পোষাদের অচেনা ডাক মিথিলাকে তুলে। সে অনুমান করতে পারে বাইরে কেউ না কেউ এসেছে। হয়ত গহীন অরণ্য থেকে এমন কিছু নেমে এসেছে যা পোষারা আগে কখনো দেখেনি। মাঝে মাঝে হাতির পাল নেমে আসে। শুড় দিয়ে আশে পাশের গাছ দুমড়ে মুচড়ে জায়গাটাকে যেন কাঁপিয়ে তোলে তখন পোষারা ভয়ে প্রানহীনের মত অসাড় দেহ এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে।
কেন এত কষ্ট করে কাপড় তৈরী করছিস। তুইতো ঠিক মূল্য পাবি না। তোকে ঠকিয়ে বেপারী চড়া দামে বিক্রি করবে। কিন্তু আমার থেকে যে বেপারী ছাড়া কেউ নেবে না। কিছুদিন অপেক্ষা কর আমরা ফিরে এলে নিজেরাই বাজারে বিক্রি করব। ব্যাপারীদের কোন কাপড় নেব না । সে রাতে পোষাদের অচেনা ডাক মিথিলাকে তুলে। সে অনুমান করতে পারে বাইরে কেউ না কেউ এসেছে। হয়ত গহীন অরণ্য থেকে এমন কিছু নেমে এসেছে যা পোষারা আগে কখনো দেখেনি। মাঝে মাঝে হাতির পাল নেমে আসে। শুড় দিয়ে আশে পাশের গাছ দুমড়ে মুচড়ে জায়গাটাকে যেন কাঁপিয়ে তোলে তখন পোষারা ভয়ে প্রানহীনের মত অসাড় দেহ এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে।
এখন এমন কেউ এসেছে যাকে ওরা ভয় পাচ্ছে না। আবার তেমন আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে না। মিথিলা কান পেতে রাখেনা বাইর থেকে কোন শব্দ কানে আসেনা কিন্তু সে বুঝতে পারে বাইরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কে হতে পারে এই নিশি রাতে। অনেক সময় পাহাড়ী গয়াল নেমে আসে, উঠানে দাড়িয়ে গাছের সাথে ঘাড় ঘষে ঘষে বিচুটি তাড়ায়। তবে একা নয় দল বেঁধে। টং গরুও আসে পথ হারিয়ে। ঘরের চারপাশে হাম্বা রব তুলে চষে বেড়ায়। সে রাতে ঘুমানো যায় না কিছুতে। একবার হরিণেরা এসে মাচার পেছনে সারারাত কাটিয়ে দেয়।
ভোরের আগে সবকটি হরিণ অরণ্যের পথ ধরতে পারলেও একটি পারেনি। দল ছাড়া হরিণটি পথ হারিয়ে ভোরের আলোতে ভীরু দৃষ্টি মেলে তাকায় টানা টানা চোখ দু'টি অব্যক্ত দুঃখের জলে ভরে উঠে সকালের কোমল রোদে হরিণীর নয়ন যুগল আলোর সব রেখা টেনে আনে। কিন্তু মানুষের চোখের রেখার বাইরে আসতে পারে না। কত রকমের ফাঁদ পাতে অসহায় হরিণটিকে ধরার জন্য। শিকারীরা নিজেদের আড়াল করে রাখে পথের ঝোপে। যখন হরিণটা পালাতে চাইবে তখন জালে আটকা পরে যাবে।
হরিণ ধরার মজা আলাদা। চড়া দাম পাওয়া যায় সৌখিন লোকদের কাছ থেকে। চামড়ায় কোন ফুটো না হলে তাও ভালো মূল্যে বিক্রি করা যায়। অভিজাত ঘরের দেওয়ালে আস্ত চামড়াটি শোভা পায় বছরের পর বছর। বেলা পড়ার সাথে সাথে অসহায় হরিণটিকে আর চুপচাপ থাকতে দেয় না। বাঁশের গুতা আর ভিলকিবাজিতে নিরীহ প্রাণীটি ছুটতে থাকে। লাফ মেরে কয়েকটি বাধা পার হতে পারলেও শেষ রক্ষা হয় না। আটকা পড়ে যায়, শিকারীর জালে । আহা কি মায়া না লাগলো সেদিন হরিণটির জন্য । এখনও কি সেরকম কোন দলছুট হরিণ এসে দাঁড়িয়ে আছে কিনা কে জানে।
হঠাৎ গাছের শুকনো পাতা করে পড়ার শব্দ হয়। মিথিলা একটু চমকে উে কিন্তু এক বিন্দুও ভয় পায় না। তারপর আবার সবকিছু নিমকতায় ডুবে যায় । মিথিলার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে আর কিছুই বলতে পারে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাচা থেকে উঠানে নেমে যে অবাক হয়ে যায়। সিঁড়ির পাশে বাঁশের ছুটিতে তামার চেইন বুলানো দেখে সে উঠানে বসে পড়ে। রাহুলের চেইন কি করে এলো এখানে, এটাতো ওর গলায় ঝুলতো সবসময়। তাহলে সে কি এসে ছিল রাতে? নাকি অন্য কেউ তার কোন দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছিল। না তা কিভাবে হতে পারে? যেই আসুক না কেন অন্তত আমাকে না জানিয়ে চলে যাবে কেন?
সে থেকে মিথিলার মনটা আর স্থির রাখতে পারে না। গানের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেও কোন ফাঁকে মনটা গহীণ অরণ্যে চলে যায় সে নিজেও টের পায় না। পাহাড়ের বুক চিরে করে পড়া করার স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা ধারায় কখনো। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাটির কলসটি পাহাড়ের কোলে জেগে উঠা উষের শীতল পানিতে ডুবিয়ে রেখে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় বিভোর হয়ে পড়ে। উঁচু উঁচু টিলার চূড়ায় চূড়ায় তখন পড়ন্ত বিকেলের শেষ রোদটুকু যেন চুমু খেয়ে খেয়ে আছড়ে পড়ে সবুজের সীমানায়। কয়দিন থেকে এসব ভাবনার যেন নতুন পাখা গজিয়েছে।
হরিণ ধরার মজা আলাদা। চড়া দাম পাওয়া যায় সৌখিন লোকদের কাছ থেকে। চামড়ায় কোন ফুটো না হলে তাও ভালো মূল্যে বিক্রি করা যায়। অভিজাত ঘরের দেওয়ালে আস্ত চামড়াটি শোভা পায় বছরের পর বছর। বেলা পড়ার সাথে সাথে অসহায় হরিণটিকে আর চুপচাপ থাকতে দেয় না। বাঁশের গুতা আর ভিলকিবাজিতে নিরীহ প্রাণীটি ছুটতে থাকে। লাফ মেরে কয়েকটি বাধা পার হতে পারলেও শেষ রক্ষা হয় না। আটকা পড়ে যায়, শিকারীর জালে । আহা কি মায়া না লাগলো সেদিন হরিণটির জন্য । এখনও কি সেরকম কোন দলছুট হরিণ এসে দাঁড়িয়ে আছে কিনা কে জানে।
হঠাৎ গাছের শুকনো পাতা করে পড়ার শব্দ হয়। মিথিলা একটু চমকে উে কিন্তু এক বিন্দুও ভয় পায় না। তারপর আবার সবকিছু নিমকতায় ডুবে যায় । মিথিলার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে আর কিছুই বলতে পারে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাচা থেকে উঠানে নেমে যে অবাক হয়ে যায়। সিঁড়ির পাশে বাঁশের ছুটিতে তামার চেইন বুলানো দেখে সে উঠানে বসে পড়ে। রাহুলের চেইন কি করে এলো এখানে, এটাতো ওর গলায় ঝুলতো সবসময়। তাহলে সে কি এসে ছিল রাতে? নাকি অন্য কেউ তার কোন দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছিল। না তা কিভাবে হতে পারে? যেই আসুক না কেন অন্তত আমাকে না জানিয়ে চলে যাবে কেন?
সে থেকে মিথিলার মনটা আর স্থির রাখতে পারে না। গানের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেও কোন ফাঁকে মনটা গহীণ অরণ্যে চলে যায় সে নিজেও টের পায় না। পাহাড়ের বুক চিরে করে পড়া করার স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা ধারায় কখনো। আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাটির কলসটি পাহাড়ের কোলে জেগে উঠা উষের শীতল পানিতে ডুবিয়ে রেখে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভায় বিভোর হয়ে পড়ে। উঁচু উঁচু টিলার চূড়ায় চূড়ায় তখন পড়ন্ত বিকেলের শেষ রোদটুকু যেন চুমু খেয়ে খেয়ে আছড়ে পড়ে সবুজের সীমানায়। কয়দিন থেকে এসব ভাবনার যেন নতুন পাখা গজিয়েছে।
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নেরা একের পর এক জড়ো হতে থাকে। দূর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আকাশের শেষ সীমানায় বিস্তীর্ণ নীলিমায় মানচিত্রের মত। মেঘখন্ড যেন রাহুলের ছবি ভেসে উঠে বার বার । ওরা নাকি ফিরে আসছে রাতের আঁধার থেকে দিনের আলোতে। কথাটি প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পরে যখন সবাই বললো একই কথা তখন ভাবনারা স্বপ্নের ভেতর হারিয়ে যেতে শুরু করলো।
মিথিলা আর বিছানায় বসে থাকতে পারে না, হাঁটুতে ঝিম ধরে আসে। আড়ষ্ঠতার ভেতর থেকে সে উঠে দাঁড়ায়। হাত দু'টি উপরের দিকে তুলে শরীরটাকে টেনে নেয়। আলসে ভাবটা কাটাতে চেষ্টা করে। বাইরের গাঢ় আঁধার হালকা হয়ে উঠে তার এখনো অনেক কাজ বাকী। কাল সারাদিন ঘরের জিনিষপত্ৰ এটা সেটা গুছিয়েছে। ভিতর বাহির ঝাড় দিয়ে মুছে ফেলেছে পুরানো সব মাকড়সার জ
বাহারী লতা পাতারা ঘরের বেড়া জড়িয়ে চালার আগা ছুঁয়েছে। সহজে টেনে টুনে ছিড়ে ফেলা যায়। এতদিন ফেলেনি। রাহুল ঝোপঝাড় পছন্দ করে না। এসব অগাছার শিকড় টেনে হিচড়ে উপরে ফেলে মিথিলা। রাহুল তো ফিরে এসে এখানে উঠবে। কোথায় যাবে সে? তাদের তো ঘর নেই। সে শান্তি বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরে তার বাপ-মা ভিটে মাটি আঁকড়ে থাকতে পারেনি। দেশ ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়েছে। এখনও ফিরে আসেনি।
মিথিলা দু'পা এগিয়ে গিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। বুক বারী টেনে তুলে বাঁশের ঝাপ ঠেলে বাইরে আসে। আঁধারকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে দিয়ে চারিদিক ফর্সা হয়ে উঠে। পাখিদের সমবেত কন্ঠের গান এখনও শেষ হয়নি। মিথিলা উঠানে দাঁড়িয়ে পোষাদের খোঁয়াড়ের দিকে তাকায়। একে অপরের সাথে নাক ঘষে ঘষে দরজায় বার বার শব্দ করে। এখনও ছেড়ে দেওয়ার মত আলো এসে পৌঁছেনি । তবুও মিথিলা খোঁয়াড়ের দরজা খুলে দেয়। শুয়োরের কুঁই কুঁই শব্দ করে উঠানে কয়েক চক্কর দেয় । তখন কবুতরেরা খোপের ভেতর সমস্বরে ডেকে উঠে । মিথিলা একে একে সকল পোষার বাঁধন খুলে দেয় ।
ভোরের সব কাজ সেরে নেয় তাড়াতাড়ি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দুই টিলার মাঝ পথে থলির মত জায়গাটিতে। থলির গা ঘেষে খালের বাঁক ফিরেছে, সেখানে হাজার রকমের বুনো ফুলের মেলা বসে। সে পছন্দের সব ফুল তুলে একের পর এক মালা গেঁথে নেয়। এরকম একটা মালা গাঁথার আশা মিথিলা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। এভাবে হারানো স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাবে তাও পুরাপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি । দিনের আলোতে ওদের ফিরে আসার সংবাদটা দ্রুত সবাই জেনে যায়। রাস্তার তেমাথা থেকে বেলা উঠার পর পর দল বেঁধে এক সাথে রওনা দেওয়ার কথা হয়।
মিথিলা আর দেরী করে না। ফুলে ফুলে সাজিয়ে নেয় নিজেকে। খোঁপায় গুছিয়ে। নেয় সাদা গোলাপ কয়টি। কপালে পাতার টিপ লাগায়। মুখে আর ঠোঁটে চন্দনের ছোঁয়া লাগায়। জরি পাড়ের লাল আর কালো সুতায় নিপুন হাতের তোলা থামিটি পরে গায়ে লাল ব্লাউজের ওপর কারুকাজের চাদর এগিয়ে সে এগিয়ে যায়। সাজানো মালাটা শিশির সিক্ত পাতায় এমন করে জড়িয়ে নেয় যেন প্রতিটি পাপড়ি সতেজ থাকে।
মিথিলা আর বিছানায় বসে থাকতে পারে না, হাঁটুতে ঝিম ধরে আসে। আড়ষ্ঠতার ভেতর থেকে সে উঠে দাঁড়ায়। হাত দু'টি উপরের দিকে তুলে শরীরটাকে টেনে নেয়। আলসে ভাবটা কাটাতে চেষ্টা করে। বাইরের গাঢ় আঁধার হালকা হয়ে উঠে তার এখনো অনেক কাজ বাকী। কাল সারাদিন ঘরের জিনিষপত্ৰ এটা সেটা গুছিয়েছে। ভিতর বাহির ঝাড় দিয়ে মুছে ফেলেছে পুরানো সব মাকড়সার জ
বাহারী লতা পাতারা ঘরের বেড়া জড়িয়ে চালার আগা ছুঁয়েছে। সহজে টেনে টুনে ছিড়ে ফেলা যায়। এতদিন ফেলেনি। রাহুল ঝোপঝাড় পছন্দ করে না। এসব অগাছার শিকড় টেনে হিচড়ে উপরে ফেলে মিথিলা। রাহুল তো ফিরে এসে এখানে উঠবে। কোথায় যাবে সে? তাদের তো ঘর নেই। সে শান্তি বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরে তার বাপ-মা ভিটে মাটি আঁকড়ে থাকতে পারেনি। দেশ ছেড়ে শরণার্থী হতে হয়েছে। এখনও ফিরে আসেনি।
মিথিলা দু'পা এগিয়ে গিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। বুক বারী টেনে তুলে বাঁশের ঝাপ ঠেলে বাইরে আসে। আঁধারকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে দিয়ে চারিদিক ফর্সা হয়ে উঠে। পাখিদের সমবেত কন্ঠের গান এখনও শেষ হয়নি। মিথিলা উঠানে দাঁড়িয়ে পোষাদের খোঁয়াড়ের দিকে তাকায়। একে অপরের সাথে নাক ঘষে ঘষে দরজায় বার বার শব্দ করে। এখনও ছেড়ে দেওয়ার মত আলো এসে পৌঁছেনি । তবুও মিথিলা খোঁয়াড়ের দরজা খুলে দেয়। শুয়োরের কুঁই কুঁই শব্দ করে উঠানে কয়েক চক্কর দেয় । তখন কবুতরেরা খোপের ভেতর সমস্বরে ডেকে উঠে । মিথিলা একে একে সকল পোষার বাঁধন খুলে দেয় ।
ভোরের সব কাজ সেরে নেয় তাড়াতাড়ি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দুই টিলার মাঝ পথে থলির মত জায়গাটিতে। থলির গা ঘেষে খালের বাঁক ফিরেছে, সেখানে হাজার রকমের বুনো ফুলের মেলা বসে। সে পছন্দের সব ফুল তুলে একের পর এক মালা গেঁথে নেয়। এরকম একটা মালা গাঁথার আশা মিথিলা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু একেবারে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। এভাবে হারানো স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাবে তাও পুরাপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি । দিনের আলোতে ওদের ফিরে আসার সংবাদটা দ্রুত সবাই জেনে যায়। রাস্তার তেমাথা থেকে বেলা উঠার পর পর দল বেঁধে এক সাথে রওনা দেওয়ার কথা হয়।
মিথিলা আর দেরী করে না। ফুলে ফুলে সাজিয়ে নেয় নিজেকে। খোঁপায় গুছিয়ে। নেয় সাদা গোলাপ কয়টি। কপালে পাতার টিপ লাগায়। মুখে আর ঠোঁটে চন্দনের ছোঁয়া লাগায়। জরি পাড়ের লাল আর কালো সুতায় নিপুন হাতের তোলা থামিটি পরে গায়ে লাল ব্লাউজের ওপর কারুকাজের চাদর এগিয়ে সে এগিয়ে যায়। সাজানো মালাটা শিশির সিক্ত পাতায় এমন করে জড়িয়ে নেয় যেন প্রতিটি পাপড়ি সতেজ থাকে।
মিথিলা তেমাথায় এসে দেখে জড়ো হয়েছে সবাই। এতক্ষনে যেন তার জন্যই অপেক্ষা করেছে। সে পৌঁছেতেই যাত্রা শুরু হয়। দল বেধে দীর্ঘ পথ হেটে এরা বর্ণাঢ্য এক শোভা যাত্রায় মিশে যায়। বাদ্য যন্ত্রের আওয়াজের সাথে এগিয়ে যায় সমবেত জনতার সমাবেশ। পশু আর পাখিদের ঢল দেখেছে কিন্তু মানুষের ঢল সে আগে কখনো দেখেনি। বাঙালী, পাহাড়ী কিংবা অপাহাড়ী কারো সাথে কোন ভেদাভেদ নেই, সবাই যেন একই মাটির মানুষ, এক মায়েরই সন্তান। আনন্দের অভিন্ন ধারায় শান্তির
মোহনায় মিলিত হয়েছে বিশাল মাঠে মিথিলারা কাঁটা তারের বাইরে অপেক্ষা করে সেই শুভ মুহুর্তের জন্য । সুর আর সংগীতের মূর্ছনায় মানুষের ঢেউয়ের সাথে জায়গাটিতে থেমে থেমে কাঁপন লাগিয়ে দেয় মিথিলারা কল্পনার রাজ্যেও ঠাঁই করতে পারে না এত বিশাল আয়োজন। বিস্ময়ভরা নয়নে চঞ্চল হরিণীর মত তাঁর চোখ দু'টি রোদের আলোতে ছল ছল করে উঠছে। নতুন জীবনের আলোর দিকে ফিরে আসা তারুন্যের ভেতর সে নির্বাক দৃষ্টিতে খুঁজে ফিরে হৃদয়ের পাতায় চিত্রিত মুখখানি।
মোহনায় মিলিত হয়েছে বিশাল মাঠে মিথিলারা কাঁটা তারের বাইরে অপেক্ষা করে সেই শুভ মুহুর্তের জন্য । সুর আর সংগীতের মূর্ছনায় মানুষের ঢেউয়ের সাথে জায়গাটিতে থেমে থেমে কাঁপন লাগিয়ে দেয় মিথিলারা কল্পনার রাজ্যেও ঠাঁই করতে পারে না এত বিশাল আয়োজন। বিস্ময়ভরা নয়নে চঞ্চল হরিণীর মত তাঁর চোখ দু'টি রোদের আলোতে ছল ছল করে উঠছে। নতুন জীবনের আলোর দিকে ফিরে আসা তারুন্যের ভেতর সে নির্বাক দৃষ্টিতে খুঁজে ফিরে হৃদয়ের পাতায় চিত্রিত মুখখানি।
বিউগলের শব্দের সাথে সাথে সবাই যেন প্রাণ সংগীতে মেতে উঠে। বনের সব পাখিরা কন্ঠ মিলিয়ে আকাশের সীমানা ছেড়ে সমবেত হয়েছে মাঠের উপরে মিথিলা টেরও পায়নি তার পোষা পাখিরা উড়ে উড়ে কার সাথে সাথে এখানে চলে এসেখে। সে অবাক নয়নে দেখে পাখিরা উড়ে গিয়ে শত তারুণ্যের মাঝে ঘুরে ঘুরে ডিগবাজী খায় বার বার । সে দৃষ্টি স্থির করে পাখিদের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে হটাৎ তার দৃষ্টি বিমূর্ত হয়ে উঠে । রোদেও ঝলমল পারে না । সে দাঁড়িয়ে হাত দু'খানি উপরে তুলে উচ্চ কণ্ঠে ডেকে উঠে। সেসময় প্রতিটি অস্ত্রের বদলে এক একটি গোলাপ জায়গা করে নেয়।
শাস্তির পায়রার পাখা মেলে পত পত করে উড়ে যায়। আনন্দ আর উল্লাসের বন্যায় ডুবে যায় সবকিছু। এতদিনের পুঞ্জীভূত আঁধারের ওপর বিদ্যুৎ চমকে যায়। সব আঁধার যেন আলোর মাঝে বিলীন হয়ে যায়। হাজারো শব্দের ভেতর মিথিলার কন্ঠ শুনতে পায় রাহুল। মুহুর্ত বিলম্ব না করে হাতের গোলাপ উঁচিয়ে সে সাদা মেঘের মত ভেসে আসে। তখন সহস্র পাখির কলতান, সংগীতের মূর্ছণা আর নৃত্যের ছন্দে মুখরিত হয়ে উঠে চারিদিক ।
শাস্তির পায়রার পাখা মেলে পত পত করে উড়ে যায়। আনন্দ আর উল্লাসের বন্যায় ডুবে যায় সবকিছু। এতদিনের পুঞ্জীভূত আঁধারের ওপর বিদ্যুৎ চমকে যায়। সব আঁধার যেন আলোর মাঝে বিলীন হয়ে যায়। হাজারো শব্দের ভেতর মিথিলার কন্ঠ শুনতে পায় রাহুল। মুহুর্ত বিলম্ব না করে হাতের গোলাপ উঁচিয়ে সে সাদা মেঘের মত ভেসে আসে। তখন সহস্র পাখির কলতান, সংগীতের মূর্ছণা আর নৃত্যের ছন্দে মুখরিত হয়ে উঠে চারিদিক ।