সহযাত্রী (এক টুকরো রোদ) - ২

Mofizur Rahman
0

সহযাত্রী (এক টুকরো রোদ) - ২

সহযাত্রী (এক টুকরো রোদ) - ২

সহযাত্রী

আজ শাতিল কোন মতে কাজে মন বসাতে পারছে না। পত্রিকার সংবাদটি বার বার তার ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। গতকাল ছিল ধর্মঘট। অফিসে কোন কাজকর্ম হয়নি। তাই আজ কাজের চাপ একটু বেশী। সকাল থেকে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু শাতিল কোনভাবেই সংবাদটি মেনে নিতে পারছে না আশেপাশে সবাই দুঃখ করেছে মেয়েটার জন্য কিন্তু পরপরই কাজে লেগে গেছে। দু'একজনের অবশ্য মন্তব্য করেছে, এমন সময়ে মেয়েটি কেন ওখানে মরতে গেল। শুধু মেয়েটির নাম আর ছবি নয় চাকুরীতে আসার ইন্টারভিউ খবরটিও রিপোর্টার ছাপিয়ে দিয়েছে।

শাতিলের সাথে মেয়েটির হঠাৎ করে, হরতালের সময় ফার্মগেটের মোড়ে পিকেটাররা সকাল থেকে রাস্তায় নেমে পড়েছে। বাস টেম্পুতো দূরের কথা একটা রিক্সাও যেন ফসকে চলে যেতে না পারে দু'একটা যেতে দিলে অন্যরাও সাহস করে নেমে পড়তে পারে। মেয়েটির রিক্সা মোড়ে আসার আগেই কয়েকজন একসাথে ঘিরে ধরে রিক্সাটির চালক ব্রেক চেপে সিট থেকে নামার সুযোগ পায় না। তার আগে দু'একজন ওকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে ফেলে। মেয়েটি সিট থেকে চেচিয়ে উঠে, ওকে এরকম করছেন কেন? ওরতো কোন দোষ নেই, আমিই ওকে নিয়ে এসেছি। দু'জন পিকেটার তখন চাকার বাতাস ছেড়ে দেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কি করেছেন আপনারা? আমি মতিঝিলে যাব কি করে? হেঁটে হেঁটে যাবেন।

এতদূর পথ একজন মেয়ে মানুষের পক্ষে কি হেঁটে যাওয়া সম্ভব? সম্ভব না হলে যাবেন না।
মেয়েটি এবার নরম স্বরে বলে, ভাই আমার যে আজ চাকরীর ইন্টারভিউ। হরতালের দিন কোন ইন্টারভিউ নেই । মেয়েটি ব্যাগ থেকে কার্ড বের বলে, এই দেখুন সকাল দশটায় উপস্থিত হতে বলেছে। আপনার এত কার্ড ফার্ড দেখার সময় আমাদের নেই। আজ হরতাল সবকিছু বদ্ধ । আপনার ইচ্ছা হলে হেঁটে হেঁটে যান। নইলে সোজা বাসায় চলে যান ।

বাসাতো মীরপুর, এত পথ কিভাবে যাব, আপনারাতো রিক্সার পাম্পও ছেড়ে দিলেন। ততক্ষনে পথচারীর অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিক্সা যাত্রীর তর্ক শুনে।

তখন একজন গেটের নীচ থেকে এসে বলে, এখানে এত গেদারিং কিসের? পিকেটার কয়েকজন পথ ছেড়ে দিয়ে বলে, মেয়েটি নাকি মতিঝিল যাবে। লোকটি রিক্সার একেবারে কাছে এসে বলে, আপনি বুঝি জানেন না আজ হরতাল ? জানি । তাহলে বের হয়েছেন কেন? সে কৈফিয়ৎ কি আপনাকে দিতে হবে? লোকটি ঠান্ডা গলায় বলে, নষ্ট করার মত সময় নেই। রিক্সায় আগুন লাগিয়ে দে।

বলতে না বলতে কয়েকটা পটকা ফাটে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন দ্রুত সরে যেতে শুরু করে । চালক রিক্সা নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু দুজন পিকেটার তার ঘাড় ধরে ধাক্কা মেরে রাস্তার ওপর ফেলে দেয়। মেয়েটি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

শাতিলের রিক্সাটি এ পর্যন্ত আসার আগে চালক বুঝতে পারে। মুহুর্ত বিলম্ব না করে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, স্যার নাইমা পড়েন, আমি কাইটা পড়ি । সে রিক্সা থেকে নেমে দু'কদম আগাতে মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়। মেয়েটি নিজ থেকে বলে আপনার রিক্সাটি পালিয়ে বেঁচেছে। আমারটার চালককে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে রেখেছে। ততক্ষনে দাঁড়ানো রিক্সাটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়।

শাতিল মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, আপনি দাড়িয়ে আছেন কেন? যে কোন কিছু করতে পারে আপনাকে আমি মতিঝিল যাওয়ার জন্য বের হয়েছি । আমার অফিসও মতিঝিলে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ নয়, আপনি সরে পড়েন । শাতিলের কথায় মেয়েটির যেন বোধোদয় হয়, সে হাটতে শুরু করে। শাতিল এলাকাটি নিরাপদ নয় ভেবে ডানে-বায়ে না তাকিয়ে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যায় । মেয়েটিও শাতিলকে অনুসরন করে লোকজন তেমন নেই ফাঁকা, ফাঁকা। শাতিল কিছু দূরত্বে এগিয়ে থাকলেও দৃষ্টির বাইরে যেতে পারে না।

জায়গাটিতে এতক্ষন অনেকগুলি লোক দাঁড়িয়ে যেন তামাশা দেখেছে। কেউ একটি কথাও বলেনি, সত্যই যেন অপেক্ষা করেছে কিছু একটা ঘটুক তারপর উপভোগ করা যাবে। কিন্তু অপরিচিত এই লোকটি নিজে থেকে সাবধান করেছে। কখনো কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারে না, স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে ।

ঠিক লোকের মত দেখায় না এখনও। যেন বছর খানেক আগে ভার্সিটির পড়া শেষ করে চাকরী নিয়েছে। তাই হয়ত সাহস আর সহানুভূতি দুই-ই রয়ে গেছে এখনও। অন্য লোকেরা দূরে দাঁড়িয়ে কেমন নির্লিপ্তভাবে কি ঘটেছে অবলোকন করেছে, সাহস করে কেউ এগিয়ে আসেনি ।

ফার্মগেটের ওভার ব্রীজের নীচে এসে শাতিল পেছনে ফিরে তাকায়। মেয়েটি একেবারে কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। কিছুক্ষন আগে একটি বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও সাহস হারায়নি। কিছুটা নার্ভাস হয়েছে সত্যি। কিন্তু মতিঝিল যাওয়ার ইচ্ছাটা পুরাপুরি রয়ে গেছে ।

এসময়ে এত পথ হেঁটে যেতে একজন কেউ সাথে থাকলে খানিকটা সুবিধাভোগ করা যায় । লোকজন সহজে আর একা ভাবে না। আড় চোখে তাকিয়ে কেটে পড়ে । আজে বাজে কমেন্ট পাস করতে সাহস পায় না । মেয়েটি দ্রুত পা ফেলে শাতিলের পেছন থেকে এগিয়ে এসে পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। শাতিল নিজের গতি একটু বাড়িয়ে দেয়, মেয়েটিও আর পেছনে হাঁটতে চায় না। শাতিল হাঁটার গতি যতই বাড়ায় মেয়েটিও ততই দ্রুত পা ফেলে সমান তালে এগিয়ে যায় শাতিল এরি মধ্যে কয়েকবার তাকিয়ে দেখে

প্রতিবারই মেয়েটির নিঃশব্দ দৃষ্টি ভাবিয়ে তুলেছে অচেনা এই মেয়েটিকে আনাড়ী মনে হলেও বেশ আলাপী । একবার বলেই বসলো, আপনি এত তাড়াতাড়ি হাটছেন কেন, আজ কি অফিসে কোন কাজ হবে? জবাবে শাতিল বলতে পারতো, তাতে আপনার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষন আগে মেয়েটির অসহায় অবস্থা দেখে নিজে থেকে উপদেশ মূলক কথা বলেছে। তাই সে সোজাসুজি উত্তর দিলো, আমি হাঁটতে শুরু করলে জোরে হাঁটি। মেয়েটি স্মিত হেসে বললো, কেন আস্তে হাটতে বুঝি পারেন না।

শাতিল একটু থেমে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, ঠিক পারি না যে তা নয়, তবে এই মুহুর্তে আস্তে হাঁটতে ইচ্ছা করছে না । নাকি আমি মেয়ে বলে আমার সাথে হাঁটতে অস্বস্তিবোধ করছেন। তা হবে কেন? আপনার সাথে হাঁটতে অসুবিধার কিছুতো দেখছি না। লোকজন যদি কিছু ভেবে বসে পরে আপনি যদি বেকায়দায় পড়ে যান । কি যে বলেন আপনি, আপনার সাথে হাঁটতে ভালোই লাগছে । আমারও তাই, আপনার কথা মুনে মনে হলো আপনি লোকটি পরোপকারী । আমার মাঝে তেমন কোন গুন নেই ।

কেউ বিপদে পড়লে অন্তত এগিয়ে আসেন । দেখুন না, একটু আগে লোকগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিভাবে তামাশা দেখছিল। সবাই যেন নাটকের দৃশ্য দেখার জন্য সমবেত হয়েছিল। ছেলেগুলি একের পর এক অন্যায় কথা বলে যাচ্ছে অথচ কেউ সত্য কথাটা বলার সাহসও পাচ্ছে না । আপনি সাহসের কথা বলছেন, আমিতো মনে করি ওদের কারো ইচ্ছাও নেই অহেতুক এসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আপনি অহেতুক বলছেন এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া ।

এসবে কে বা ঝুঁকি নেবে নিজের ক্ষতি করে। তাই বলে কি ওরা রাস্তাঘাটে চলার সুযোগ দেবে না। আমাদের নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করবে? হরতাল ওদের গনতান্ত্রিক অধিকার । তাই ওখানে কোন হস্তক্ষেপ চলবে না । হরতাল যেমন তাদের গনতান্ত্রিক অধিকার তেমনি পথচারীর পথ চলাও নাগরিক
অধিকার, গরীব রিক্সা চালকের রাস্তায় রিক্সা চালানোতো ওদের বাঁচার অধিকার। এমন অনেকদিন মজুর আর শ্রমিক আছে যারা দিনে এনে দিনে যায়। তাদের কি অবস্থা একবার ভেবে দেখুনতো? আমাদের ভাবাতে কি এসে যায়, এসব নিয়ে যাদের ভাবনার কথা ওরাতো কখনো মাথা ঘামায় না।

আপনি তাদের কথা বলছেন? যারা বড় বড় বক্তৃতা দেয়, তাদের কথা বলে লাভ নেই । আমরা যারা সাধারন মানুষ তাদের সচেতন হতে হবে । মেয়েটি আর কথার জওয়াব দেয় না। দু'জন পাশাপাশি নিঃশব্দে হাটে। লোকজন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন যেন আড় চোখে তাকায় । কিছুক্ষন আগে শাতিল মেয়েটির সাথে যেচে কথা বললেও এখন পাশাপাশি হটিতে একটু বিব্রত বোধ করে। আবার অচেনা অপরিচিত একজন মেয়ের সহযাত্রী হয়ে পথ। চলার মাঝে এক ধরনের কৌতূহল জড়িয়ে থাকে। শাতিল নিজ থেকে আবার বলে, আপনার কথাবার্তায় মনে হয় বেশ বুদ্ধি রাখেন আপনি ? আসলে আমি কি বুদ্ধিমান নই বলতে চাচ্ছেন? তা বলছি না, তবে ওভাবে ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছিলেন কেন?

কিসের ঝামেলা, কোন ঝামেলার কথা বলছেন আপনি? এই যে, ফার্মগেইটে । এসবতো আমি পাত্তাই দিই না। ওরকম ছোটখাট ঘটনা থেকে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে । তাই বলে কি মেয়েরা ঘর থেকে বের হবে না, চুপটি মেরে বাসায় বসে থাকবে? আমি তা মিন করিনি, আমি বলেছি অহেতুক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা । ঝামেলা কি আমি মেয়ে বলে করেছে, আপনিতো পুরুষ আপনি কেন রিক্সা ছেড়ে দিলেন? পিকেটারেরা রিক্সা চালাতে দিচ্ছে না। খামাকা রিক্সাচালককে মারধর করবে, বেচারা গরীব মানুষ আমার জন্য মার খাবে, তাই ছেড়ে দিলাম । লোকজনতো অফিস-আদালতে যেতে চায়, কাজকর্ম করতে চায়, এমনকি চলাফেরা বাধা না পেলে গাড়িও রাস্তায় নামতো । ঠিক তাই ।

আরেক জনের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করা কিংবা স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলে অন্যায় নয়? অবশ্যই অন্যায় আমি একজন প্রতিবাদ করে কি করব? আপনার দেখাদেখি অন্যরাও করবে । কই করে নাতো; একা মার খেতে হয় তখন । এখানেই আমাদের ব্যর্থতা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে মানুষকে কাজ কর্মে যাওয়ার পথে বাধা দেওয়া কি যদি অন্যায় মনে করে থাকেন তাহলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন না কেন?

বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ হেটে চলে দু'জন । কথা হয় না তেমন। ভাদ্র মাসের রোদের তেজ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে উঁচু উঁচু দালানের ছায়া রাস্তার এপাশ ছেয়ে রাখলেও এখন আর পারছে না। আলোর ঝলমল সূর্য এখন আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে এসেছে।রোদের মাঝে রাস্তার ওপর একটি শিশু বসে আছে । তার সামনে একটি টিনের থাল; খালে কয়েকটি সিকি রোদের আলোতে চকচক করছে শিশুটির আশেপাশে কেউ নেই তার মুখ থেকে দুটি শব্দ থেমে থেমে বের হচ্ছে, 'ভাত খাইব' পথিকদের কারো তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই ওদিকে শিশুটির গলার শব্দ অনেকের কানে পৌঁছে না।

কারো কানে পৌঁছলেও যেন কানের বাইরে রেখে হাটছে। শাতিল পকেট থেকে একটা টাকা বের করে থালের উপর রেখে বলে, এই মুহুর্ত বিলম্ব না করে পরনের কাপড়ের কাছায় ঢুকিয়ে বলে, থাইকলে কি ভিক্ষা করি । তখন মেয়েটি বলে, মিথ্যা বলছে ও । নিশ্চয় কেউ না কেউ আছে। শাতিল জানতে চায়, আপনি কি করে বুঝলেন? এটা ওদের ব্যবসা। এরকম রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে ভিক্ষা করাবে। কোন এক সময় এসে সব নিয়ে যাবে, শিশুটাকে কিছু খেতে দিবে হয়ত। শিশুটি তখন বলে, আমার মা ঐপাড়ে, আমার ছোড বইনরে লইয়া ভিক্ষা কইরতেছে । বললাম না আপনাকে । চলুন এখানে দাঁড়ালে আরো দেরী হয়ে যাবে ।

দু'জন প্রেসক্লাবের কাছে এসে আর এগুতে পারে না। রাস্তার উপরে ব্যারিকেড দিয়ে লোকজনকে অনেকটা জোর করে আটকে রেখে জনসভার মত করে বক্তৃতা দিচ্ছে কে একজন । রাস্তার ফুটপাত ধরে এমনভাবে সমর্থকেরা দাঁড়িয়েছে যেন। পথচারীরা এস্থানটুকু পার হয়ে সহজে যেতে না পারে। ওখানে শুধু ঢোকার সুযোগ দিচ্ছে ।

ঢুকলে কিন্তু বের হওয়ার পথ করা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। তবুও দু'জন ফুটপাতের পথ ধরে হাটতে চেষ্টা করে। যতই এগিয়ে যায় ততই ভীড় বাড়তে থাকে। বসা লোকজনের কেউ কেউ ওদের দিকে তাকায়। শাতিল ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে অচেনা একটি মেয়ের সাথে এভাবে লোকজন ডিঙিয়ে পার হতে যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। না সেরকম কিছু হয়নি। মেয়েটি নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনদের বলে, প্লিজ আমাকে একটু যেতে দিন। ওরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে একটু গা হেলে দাঁড়ায়।

মেয়েটি ঐ ফাঁকে ভীড়ের ভেতর থেকে বের হয়ে যায় । পিছে পিছে শাতিলও বের হওয়ার সুযোগ পায়। সে কিছুটা গা ঘেঁষে হুড়মুড় খেয়ে বের হয়ে পড়ে। দু'জনই প্রায় ঘেমে যায়। শাতিল বলে, বাপরে, আমি মনে করেছিলাম আজ আর বের হওয়া যাবে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনা ছাড়া আর কোন উপায় নেই । আপনি থাকাতে বের হওয়া সম্ভব হলো । মেয়েটি কথা না বাড়িয়ে বলে, আমার দশটায় রিপোর্ট করার কথা এখন প্রায় এগারটা বাজে।

আমার মনে হয় আপনার ইন্টারভিউ আজ আর হবে না। ধর্মঘটের দিন সাধারনতঃ এসব বাতিল করা হয় । পরবর্তীতে আরেকটা তারিখ দেওয়া হয় । দেখুন এটা প্রাইভেট ফার্মের ইন্টারভিউ । ওদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর সবকিছু নির্ভর করে। তাই আমার দিক থেকে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করতেছি যেন কোনরকম ত্রুটি না হয় একটা চাকুরী আমার বিশেষ প্রয়োজন । আপনি কি পরিবারের সবার বড় ?
হ্যাঁ।

তারপর দু'জন চুপচাপ হাঁটে। আর কথা হয়না তেমন ।শাতিলও ব্যক্তিগত আলাপ বাড়াতে চায় না। মতিঝিল এসে মেয়েটি পার্স থেকে ইন্টারভিউ কার্ডটি বের করে বলে, ১২৫/এ, মতিঝিল কোন দিকে হবে বলতে পারেন । কার্ডটি শাতিল হাতে নিয়ে বলে, ঐতো কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি বিল্ডিং। মেয়েটি একটু আশ্চর্য হয়ে বলে, বুক সোসাইটি । আগে ছিল এখন নেই এখন চকচকে সব প্রাইভেট অফিস জেকে বসেছে।

মেয়েটি শাতিলের দিকে তাকিয়ে বললো, এতটুকু পথ সঙ্গ দেওয়ার জন্য। আপনাকে ধন্যবাদ।
এতক্ষন একসাথে হাটলাম অথচ আপনার নামটা জানা হলো না । মেয়েটি চোখের দৃষ্টি স্থির করে বলে, রোকেয়া, সবাই রুকু বলে ডাকে । তারপর পাতা নামিয়ে বলে, আপনার? শাতিল প্যাকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে বলে, শুধু নাম নয়, ঠিকানা টেলিফোন সবই লেখা আছে এতে। কোন সময়ে প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করলে খুশী হব। আবারও ধন্যবাদ আপনাকে । শাতিল হেসে বলে, আপনার শুভ কামনা করি।

শাতিল অফিসে এসে দশ মিনিটের মত ফ্যানের নীচে ঝিম ধরে বসে থাকে। হাঁটার সময় এভাবে গরম লাগেনি, কথার ভোলে হাঁটতে হাঁটতে শরীরটা ঘেমেছে কিন্তু পুকুরে স্নান করার মত এত জবজবা হয়নি। দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ভেতর থেকে যেন আগুনের ফুলকি দিয়ে গরম বের হচ্ছে। চুলের গোড়ায় গোড়ায় জমে উঠা ঘাম বিন্দু বিন্দু হয়ে কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অফিসে লোকজন তেমন আসেনি যারা এসেছে বসে বসে গল্প করছে কোথায় কি ঘটনা ঘটেছে, অফিসে আসার পথে কে কি দেখছে কিংবা কোন বিপাকে পড়েছে কিনা এসব কথায় মশগুল সবাই ।

যে ক'জন মহিলা আছে এই অফিসে এরাও যোগ দেয়, পথের নানা ঘটনার বিবরন দেয় সবাই । ধর্মঘটের দিন কাজকর্ম তেমন হয় না, তবু হাজিরা দিতে হয় ঘন্টা দু'য়েক অফিসে কাটিয়ে আবার বাসায় ফিরে আসে যায় আজ কেউ বের হতে পারছে না, প্রায় বিকেল হয়ে আসছে। দুপুর থেকে উত্তেজনার খবর কানে আসে। মিছিলের শ্লোগান যেন হটাৎ বোমার আওয়াজের মত মনে হয় কিছুক্ষনের মধ্যে মিছিলের শব্দ কোথায় মিলিয়ে যায়। সহস্র বোমার আওয়াজে কান ঝালা পালা হয়ে উঠে। থেমে থেমে গুলির শব্দও কানে আসে। রাস্তার ওপর জনসভা করা নিষিদ্ধ।

পুলিশ কাদানে গ্যাস আর জলকামান ছুড়ে জমায়েত ছত্রভংগ করার চেষ্টা করছে। বারুদের গন্ধ, কুন্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া আর টিয়ার গ্যাসের সেল খেয়ে মানুষ দিক বিদিক ছুটে পালাতে চেষ্টা করে। এসবের ভেতরেও বোমা আর গুলির আওয়াজ থামে না। সারাদিন ওরা অফিস থেকে বের হতে পারেনি। সন্ধ্যার আগে কেমন যেন চারিদিক থমথমে হয়ে পড়ে। কোন অঘটন ঘটার পর যেভাবে থেমে যায় সবকিছু ঠিক তেমনি করে শাতিলেরা এই ফাঁকে অফিস থেকে বের হয়ে পড়ে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। শংকিত মনে সে পা বাড়ায়। পথে নানা রকম কথা শুনা যায় ।

কেউ বলে পাঁচজন মারা গেছে, কেউ বলে আরো বেশী । পুলিশ নাকি লাশ গুম করে ফেলেছে। প্রেসক্লাবের সামনে এসে সে এদিক ওদিক তাকায়, রাস্তায় কোন পুলিশ নেই । মানুষজনও তেমন চোখে পড়ছে না ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ এখনও রয়ে গেছে। কিছুক্ষন আগের রণক্ষেত্রটি যে হটাৎ এভাবে নিরবতায় ডুবে যাবে শাতিল ভাবেনি । তবুও তার ভয়টা পুরাপুরি কেটে যায় না । কে যেন পেছন থেকে তাকে অনুসরন করছে। ফিরে ফিরে কয়েকবার তাকায় । কাউকে দেখতে পায় না। তবুও মনে হয় কেউ একজন আসছে। সে আবারও পেছনে তাকায়, যদি রুকু নামের মেয়েটি আসে।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!