নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার প্রয়াস| Attempts to reform Islam in favor of women

Mofizur Rahman
0

নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার প্রয়াস

Attempts to reform Islam in favor of women

নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার প্রয়াস, নারীর অধিকার নারীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সন্তান হত্যার প্রতিরোধ কন্যার প্রতি সদাচারের উপদেশ মীরাসে নারীদের অংশ, Attempts to reform Islam in favor of women

(toc)

বর্বর জাহেলিয়াতের কৃষ্ণমেঘের ঘনঘটার মধ্যে ইসলামের বিশ্ব আলোকিত সূর্যোদয় ঘটলো। ইসলাম তার জ্যোতির্ময় আলো দ্বারা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীকে সুপ্রভাতে রূপান্তরিত করলো। নিঃশেষিত ও ভূলুণ্ঠিত মানবতাকে উর্ধে তুলে ধরলো। সৌহার্দের বন্ধন সৃষ্টি হলো। মযলুম মানুষেরা শির উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ ও সন্ধান পেলো।


সকল অনাচার, বাড়াবাড়ি বিলুপ্ত হলো। সাম্যের স্বাভাবিক কেন্দ্রবিন্দুতে ইসলাম মানব জাতিকে এনে দাঁড় করালো। যার যা প্রাপ্য ছিলো, তাকে তাই দেয়া হলো। চির অবহেলা ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট নারী জাতীকে ইসলাম পূর্ণ শক্তিতে তার বক্ষপুটে আশ্রয় দিলো। নারী চরিত্রের মূল্যমান সত্ত্বীব করা হলো। এক্ষেত্রে কোনো রকমের শৈথিল্যেরই প্রশ্রয় দেয়া হয়নি।


ব্যভিচার ও বেহায়াপনার যত রকম উৎসমুখ ছিলো, এক এক করে তার সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। বিবাহ সংক্রান্ত বিধি-বিধান রচনা করে যৌনাচারকে নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করা হলো। মানব বংশ বৃদ্ধির সুষ্ঠ পদ্ধতি চালু করা হলো। পারিবারিক জীবনযাত্রা সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিবেশের ছাঁচে ঢালা হলো। বোঝা ও অভিশাপের পরিবর্তে নারীকে শান্তি ও আরামের ফোয়ারা করা হলো। বিবাহ বর্জনের বৈরাগ্যবাদী মতবাদকে নিরুৎসাহিত করে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সুখী সুন্দর জীবনের ওপর গুরুত্বারোপ ও অপরিহার্য করা হলো।


নারীর অধিকার

নারী জাতির অধিকার সম্বন্ধে সর্ব প্রথম 'কুরআনী উপদেশ' ঘোষিত হয়েছে। মহান আল্লাহর ঘোষণা নিম্নরূপ।


بابها الناس اتقوا ربكم الذي خلقكم من نفس واحدة وخلق منها زوجها وبث منهما رجالا كثيرا ونساء.

“হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তাঁর থেকে তাঁর জীবন সংগিনী সৃষ্টি করেন আর যিনি তাদের দু'জন (আদম ও হাওয়া হতে) বহু নর-নারী সৃষ্টি করেন।” (-সূরা আন নিসা : ১)


আসল কথা হলো, পুরুষ এবং নারী একই ঝরনার দুটি তরঙ্গ মালা। 'মানুষ' হিসাবে দুয়ের আকাশ-কুসুম পার্থক্য করা বাস্তব ভিত্তিক নয়, বরং কল্পনাপ্রসূত।


আলোচ্য আয়াতে এ সত্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে যে, পুরুষ যে নারীকে মানব-বহির্ভূত ভাবার চেষ্টা পাচ্ছিলো, তার সবই ভ্রান্তিপূর্ণ। তারা উভয়ই একই বস্তু হতে সৃষ্ট। অতঃপর তাদের মধ্য থেকেই সারা দুনিয়ার নর-নারীর বংশ বিস্তার। নারী সম্প্রদায় পৃথক কোনো জীব নয়। তারাও মানুষ, যেমনি মানুষ পুরুষ সম্প্রদায়। নারী-পুরুষ উভয়ের এক ও অভিন্ন। সুতরাং এতদুভয়ের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য সৃষ্টি কি করে সম্ভব? বরঞ্চ এদিক থেকে নারী-পুরুষ উভয়কেই উভয়ের নৈকট্যে গর্ববোধ করা উচিত। একে অপরের জন্য গৌরবের কারণ মনে করা উচিত। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন :


بابها الناس إنا خلفكم من ذكر وأنثى وجعلتكم شعوبا وقبائل لتعارفوا ط إن أكرمكم عند الله أتقاكم .

“হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক আল্লাহভীরু।” (-সূরা আল হুজুরাত : ১৩)


আলোচ্য আয়াত থেকে অন্যান্য বিষয়ের সাথে এ বিষয়টিও প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে, কোনো পুরুষই এমন নেই, যার অস্তিত্ত্বের ব্যাপারে নারী সমান অংশীদার নয়। নারী ব্যতীত শুধু পুরুষ দ্বারা বংশবৃদ্ধির দাবী কেউ কি করতে পারে? তাহলে পুরুষের কি অধিকার আছে পুরুষকে সম্মানিত ও নারীকে ঘূর্ণিত মনে করার? মানবদেহ গঠনে পুরুষের চেয়ে নারীর ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নারীর অবদানই অধিক। কি আশ্চর্য, নারী মা হয়ে সন্তান গর্ভে ধারণ করে এবং অনেক কষ্টে তাকে প্রসব করে। লালন-পালন করে দুধ পান করায় এ বিষয়ে একটু চিন্তু করুন, পুরুষরা সে তুলনায় সন্তানের জন্য কতোটুকুই বা করে?


নারীর উদরেই আমরা আকার-আকৃতি লাভ করি। নারীর উদরে নারীর অস্তিত্ব লাভ কী করে লজ্জা, ঘৃণা ও শরমের বিষয় হতে পারে? আমরা যখন অসহায় ছিলাম চলা-ফেরা করতে পারতাম না, কথা বলতে এবং দুঃখ-বেদনা ও অনুভুতি প্রকাশ করতে পারতাম না, তখন নারীরাই অর্থাৎ মা আমাদের লালন-পালন করেছে। নারীই আমাদের চলন-শক্তি যুগিয়েছে। কথা বলা শিখিয়েছে। জন্ম-থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি পরিচর্যা করেছে। এতো কিছুর পরও কি নারী নিকৃষ্ট ও নীচাশর হয়ে গেলো? শতধিক এমন বিদ্যা-বুদ্ধির ওপর, যা এমন চিন্তা করে! শত ধিক এমন মনের ওপর, যা এরূপ চিন্তা প্রকাশ করে! শত ধিক এমন ব্যক্তির ওপর, যে তার আপন মনে এরূপ অবাস্তব কল্পনা স্থান দেয়!


যা হোক, উক্ত আয়াত এবং এ সম্পর্কে অন্যান্য কুরআনী আয়াতে মহামহীম আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে এ কথাই ঘোষণা করেছে যে, নারী সমাজ ঘৃণার পাত্রী কখনো নয়। জাতিগত মান-মর্যাদায় কোনো ক্রমেই খাটো বা কম নয়। কাজেই নারীদেরকে পশুর ন্যায় অপব্যবহার করা এবং তাদের মান-সম্ভ্রমকে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার বানানো মানবতার চরম অবমাননা ছাড়া অন্য কিছুই নয়


নারীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

মানব প্রকৃতিতে পূর্ণ অভিন্নতা সত্ত্বেও নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর মধে কিছু আঙ্গিক পার্থক্যে সৃষ্টিকর্তার যে বিধান ক্রিয়াশীল রয়েছে, এমনিতেই তা কেউ অবিদিত নয়। পরন্তু সৃষ্টিকারী তার শিল্প-রহস্য সম্পর্কে যত বেশী অবহিত, অন্যরা তার মর্মস্থলে কিরূপে পৌঁছতে পারে? আল্লাহ পাক সত্যই ঘোষণা করেন :


يله ملك السموات والأرض يخلق مايشاء ويهب لمن بما إنا ناويهب لمن يشاء الذكور ، أو يزوجهم ذكرانا وإناثا ويجعل من يشاء مماط إنه عليم قدير.


"আল্লাহরই জন্য আকাশরাজ্য ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব; তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন । যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা ছেলে দান করেন অথবা দান করেন ছেলে ও মেয়ে উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছা, তাকে করে দেন বন্ধ্যা। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।”( -সূরা শূরা : ৪৯-৫০)


কাজেই কন্যা-সন্তান জন্মানোয় ভ্রূ উঁচানো এবং মুখ-বিকৃতি মূর্খতারই শামিল। এতো মানুষের বুদ্ধির অপরিপক্কতা যে, সে আল্লাহর করুণাকে স্বীয় দুঃখ-বেদনার কারণ মনে করে নিয়েছে। এই কন্যারা বড় হয়ে যদি স্ত্রী না হয়, আর তোমাদের বিয়ে-শাদী না হয়, তবে বলো, এই সব ছেলে এইসব বীর নও জওয়ান কোত্থেকে আসবে? হযরত মারইয়াম আলাইহাস সালামের মাতা যখন মসজিদের খাদেম হিসেবে মারইয়াম (আ.)-কে মানত করলেন এবং তাঁর আকাঙ্খিত পুত্রের স্থলে কন্যা ভূমিষ্ঠ হলো, তখন দুঃখ করে বলতে লাগলেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়ঃ


قالت ربي إني وضعتها أنثى

" (ইমরানের স্ত্রী বললেন) হে আমার রব! আমি কন্যা প্রসব করেছি।" (-সূরা আলে-ইমরান : ৩৬)


হে আমার রব! "আমি কন্যা সন্তান প্রসব করেছি।” আমার বাসনা সিদ্ধ হলো না। আমি যে পবিত্র কাজের জন্য মানত করেছিলাম, তাতে তো পুত্র-সন্তানের প্রয়োজন ছিলো- কন্যা-সন্তান দিয়ে এ মহৎ কাজ পূর্ণ হবে না। রাব্বুল 'আলামীন মারইয়াম-মাতার এই ফরিয়াদ শুনে বললেনঃ


الله أعلم بما وضعت ط وليس الذكر كالأنثى - 

“যা প্রসব করেছে, আল্লাহ তা সম্যক অবগত। পুত্র এই কন্যার সমতুল্য হতে পারতো না।” (-সূরা আলে-ইমরান:৩৬)


মহান আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তিনি তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী জানেন যে, এ কন্যার সমকক্ষ পুত্র হতে পারে না। যে কল্যাণ-মাহাত্ম্য ও বংশ গৌরব ও আলৌকিকত্ব এই কন্যা দ্বারা হাসিল হবে, পুত্র দ্বারা তা হতো না। তোমরা তোমাদের মানবীয় জ্ঞান থেকে চিন্তা করে ঘাবড়ে গেছো! মহান রাব্বুল 'আলামীন এই কন্যা দ্বারা যে কাজ আঞ্জাম দিতে চান, তা তোমরা কল্পনা ও অনুমান করতে পারো নি। হযরত মারইয়াম আলাইহাস সালামের অস্তিত্ব খোন তাঁর মাতৃ-গৌরব ও বিশ্ব-কল্যাণের পক্ষে কতটুকু শুভ প্রমাণিত হয়েছে, তা তাঁর পরবর্তী ইতিহাসই সাক্ষ্য এ মারইয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভে হযরত ঈসা রূহুল্লাহ (আলাইহিস সালাম) জন্ম নেন এবং শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবীকে সত্যের পয়গাম শুনিয়ে অনেক ব্যক্তির মুক্তির কারণ হন।


সন্তান হত্যার প্রতিরোধ

অতঃপর ইসলামী শরীয়ত কন্যা-হত্যা বন্ধ করে। দারিদ্র্যের ভয় তাদের অন্তর থেকে দূরীভূত করে। জীবিকাদানকারীর 'দৃঢ় ক্ষমতা'য় আস্থাশীল করে ঘোষিত হয় আল্লাহ বলেন-


ولا تقتلوا أولادكـم مـن امـلاق و نحن نرزقكم وإياهم .

“দারিদ্রের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিযিক দান করবো।” -সূরা আল-আন'আমঃ ১৫১ কুরআনের অন্য স্থানেঃ


ولا تقتلوا أولادكم خشية إعـلاق - نحن نرزقهم واياكم ، أن قتلهم كان خطبا كبيرا.

“আর তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করো না। আমিই তাদেরকে রিযিক দান করি এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মহাপাপ।” (-সূরা বনী ইসরাঈল : ৩১)


আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়ালা সন্তান হত্যা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করেছেন। পুত্র হোক বা কন্যা-কারো হত্যাকাণ্ডই শরীয়ত বৈধ রাখেনি। অভাব-অনটনের কাল্পনিক আতংক তাদের মন থেকে দূরীভূত করেছে । রূযী-রোযগারীর যিম্মাদার আল্লাহ তায়ালা এরূপ বিশ্বাস জন্মিয়েছে। বর্তমান অবস্থায় তোমরা কোথা থেকে আহার করছো, কী ভাবে খাদ্য যোগাচ্ছ, একটু ভেবে দেখো না। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন জীবিকার ব্যবস্থা করেই ভবিষ্যৎ বংশধরদের সৃষ্টি করে থাকেন।


সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তাঁর বাজেটে ঘাটতি রেখে অপর্যাপ্ত মানুষ সৃষ্টি করে চলার অর্থ হলো, তিনি এমন কোনো অকর্মণ্য অবিবেচক আমীর, নওয়াব কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান (আল্লাহ ক্ষমা করুন) যাঁর কোষাগারে বেতন দেয়ার টাকা নেই, অথচ অগনিত কর্মচারী নিয়োগ করেই যাচ্ছেন। সরাসরি জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণের কুরআনের ঐশী বাণী যখন অবতীর্ণ হলো-


وما من دابة في الأرض إلا على الله رزقها.

“পৃথিবীর প্রতিটি জীবের রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহরই।” (-সূরা হুদ : ৬)

তখন এর বিপরীতে যে যা-ই চিন্তা করুক না কেনো, আল্লাহকে অস্বীকার করারই নামান্তর।


কন্যার প্রতি সদাচারের উপদেশ

ইসলাম নারী সমাজকে কেবল তার সঠিক স্থান প্রদান করেই তার কর্তব্য সম্পন্ন করেনি, কন্যা হত্যা বন্ধ করেছে। আল্লাহর উপর নির্ভরতা শিক্ষা দিয়ে মানুষকে তার জীবিকার দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত করেছে। উপরিউক্ত সময়-সুযোগ পেলেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কন্যাদের প্রতি সদ্ব্যবহারের উপদেশ দান করতেন।


আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : কেউ যদি সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত দুটি কন্যা-সন্তান লালন পালন করে, তবে সে কেয়ামতের দিন আমার সাথে থাকবে এবং এই আঙ্গুলগুলোর ন্যায় সে আমার নিকটবর্তী থাকবে- এ কথা বলে তিনি তাঁর হাতের অঙ্গুলিসমূহ সংযুক্ত করে দেখান।


রিয়াদুস সালেহীন উন্মুল মোমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, একদা এক স্ত্রীলোক দু'টি কন্যা সন্তানসহ আমার নিকট আসল। স্ত্রীলোকটি দরিদ্র ও নিঃসহায় ছিল। সে আমার নিকট ভিক্ষা চাইল । আমার নিকট তখন একটি মাত্র শুকনো খেজুর ছিল। আমি খেজুরটিই তাকে দিয়ে দিলাম। সে খেজুরটি দু টুকরো করে দুই কন্যাকে দিল। সে নিজে কিছুই খেল না। তারপর উঠে চলে গেল। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ (স.) ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি তাঁর নিকট এ ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি বললেন, যে-কেউ তার কন্যাদের জন্য কষ্ট সহ্য করবে, তাদের সাথে সদ্ব্যব্যহার করবে, তার জন্য এ কন্যারা জাহান্নামের ঢাল হবে। -বুখারী, মুসলিম অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন কন্যা লালন-পালনকারীদের স্পর্শ করতে পারবে না।


উপরিউক্ত হৃদয়গ্রাহী বর্ণনাটি পাঠ করুন এবং ভাবুন। ইসলাম এ কন্যা -সন্তানদের প্রতিপালন ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কতখানি উৎসাহ যুগিয়েছে! মানুষকে কতো উত্তম উপায়ে এ বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করেছে।


উন্মুল মোমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) অন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করেন: একদিন এক দরিদ্র মহিলা এলো। তার সাথে তার দুটি কন্যা ছিলো। এবার আমি স্ত্রীলোকটিকে তিনটি খেজুর দিলাম। মমতাময়ী মা মেয়ে দু'টিকে একটি একটি করে দিয়ে নিজে তৃতীয় খেজুরটি নিজে খেতে চাইল। মহিলা মুখের কাছে নিতেই মেয়ে দু'টি আবার চেয়ে বসলো। মহিলাটি নিজে খেলো না। নিজের খাবার খেজুরটিও দুই ভাগ করে কন্যা দু'টিকে দিয়ে দিলো। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন- স্ত্রীলোকটির এই কান্ড দেখে আমি তো একেবারে অবাক হলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গৃহে তশরীফ আনলে আমি স্নেহময়ী মাতার এ বিস্ময়কর কাহিনী তুলে ধরলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বললেনঃ


إن الله قد أوجب لها يها الجنة واعتقهابها من النار

"এ কন্যাদের কারণেই আল্লাহ তায়ালা এ মহিলাটির জন্যে বেহেশত অনিবার্য করেছেন আর তাদের জন্যই তিনি তাকে দোজখ থেকে মুক্তি নিয়েছেন। (- মুসলিম)


এসব বাণী ছিলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহাত্ম্য, আর এ ছিলো ইসলামের দৃষ্টিতে নারী সমাজের মান-সম্ভ্রম। রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একেবারে শেষের দিকে এসে বলেছেন : হে লোক সকল, সাবধান! আমি তোমাদেরকে দুই দুর্বল শ্রেণীর অধিকার সম্পর্কে তাকীদ দান করছি এবং তাতে কোনো রকম কার্পণ্য ও ত্রুটি সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি। এক ইয়াতীম আর দ্বিতীয় নারীজাতি।" (-রিয়াদুস সালেহীন)


এতো সব উদ্যোগ, আয়োজনের কারণ ছিলো, নারীর সতীত্ত্ব ও ইযযত-আবব্ধ রক্ষা করা এবং পরিবার ও সমাজে তাদের উপযুক্ত স্থান দেয়া, যাতে মানুষ তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান না করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমীপে এক ব্যক্তি জানিয়েছিলো, বর্নর জাহেলী যুগে আমি দশটি কন্যা-সন্তান নিজ হাতে জীবন্ত কবর দিয়েছি।” কেউ বললো, “আমি আমার মেয়েটিকে কাছে ডাকলাম। সে হাসতে ও খেলতে খেলতে আমার সাথে চলে এলো। একটি কূপের কাছে পৌঁছে আমি তার হাত ধরে কূপের মধ্যে হত্যার উদ্দেশ্যে ফেলে দিলাম। কন্যাটি 'আব্বু' 'আব্বু' করে চীৎকার করতে লাগলো।” কাহিনী শ্রবণ করে রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাদতে কাদতে তাঁর দাড়ি মোবারক ভাসিয়ে দিলেন। (সীরাতুন্নবী)


এ সব প্রমাণ করে যে, দয়াল নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল পুরুষদেরই নন, বরং নারী তথা সমগ্র বিশ্ব জাহানের পয়গাম্বর। তিনি কেবল পুরুষদের জন্যেই ক্রন্দন করতেন না; বরং নারী নির্যাতনও তাঁকে কাঁদিয়ে দিতো।


মীরাসে নারীদের অংশ প্রদান

কুরআন মজীদে এই ঘোষণা :


بوصيكم الله في أولادكم و للذكر مثل حظ الأنثيين ج فإن كن نساء فوق اثنتين فلهن ثلنا ماترك ج وإن كانت واحدة فلها النصف

“আল্লাহ তোমাদের সন্তানদেরকে মীরাস সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন: এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ। কিন্তু কন্যা দু'য়ের অধিক হলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ। আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ ।” (-সূরা আন-নিসা : ১১)


নারীকে সম্ভবতঃ প্রথম বার এই সুযোগ দান করা হলো যে, সে ইচ্ছা করলে তার বিষয়-সম্পত্তি দ্বারা পুরুষের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই আরাম-আয়েশের জীবন যাপন করতে পারে। যে নারীরা যুগ যুগ ধরে মীরাস থেকে বঞ্চিত ছিলো, ইসলাম তাদেরকে মীরাসে শরীক করেছে। চিন্তা করুনঃ “এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমপরিমাণ।" এখানে মূল কন্যাকে স্থির করা হয়েছে। মাপকাঠি পুত্রের অংশ নয়- কন্যার অংশ। ইসলাম কন্যাদের যখন এই স্বত্ব দান করলো, তখন অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলছে, যে মেয়েরা যুদ্ধ করতে অক্ষম, তারাও সম্পত্তির অংশ পাবে! আর তা'ও এতো বড় অংশ !


দুনিয়ায় ইসলামের আমগন হকদারের হক তার নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্যে, যুলুম নির্যাতনের মূল উৎখাত করার জন্যে । আর এ দ্বীনের উদ্দেশ্যই ছিলো সম্পদের মালিকানা একচেটিয়া পুরুষদের অধিকারে না রেখে নারীদেরকেও তাতে অংশীদার বানানো। এ সত্যটি কুরআনে নিম্নরূপ ভাষায় প্রকাশ করেছে-


للرجال نصيب مما ترك الوالدان والاقربون من وللنساء نصيب مما ترك الوالدان والاقربون مما قل منه او كثر نصيبا مفروضا۔

“পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষেরও অংশ আছে এবং নারীরও অংশ আছে। এক নির্ধারিত অংশ তা কম হোক আর অধিক হোক।” (-সূরা আন নিসা : ৭)


জননী বা মাতা রূপে

নারী যে রূপেই হোক মা, কন্যা, স্ত্রী-নিছক নারী হওয়ার কারণে সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত হতে পারে না। জননী বা মাতার উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :


ولابويه لكل واحد منهما الشدس مما ترك إن كان له ولد - فان لم يكن له ولد و ورثه أبواه فلاته الثلث ج فان كان له إخوة فلامه الشدش

“আর মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার পিতা-মাতা উভয়ের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-ষষ্ঠাংশ। আর সে নিঃসন্তান হলে এবং শুধু পিতা-মাতাই উত্তরাধিকারী হলে তার মায়ের জন্য এক-তৃতীয়াংশ। আর তার একাধিক ভাই কিংবা বোন থাকলে তার মায়ের জন্য এক-ষষ্ঠাংশ।" (-সূরা আন নিসা : ১১)


উক্ত আয়াতে গিতার পাশাপাশি মাকেও উত্তরাধিকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কোথাও এক-তৃতীয়াংশ আবার কোথাও এক-ষষ্ঠাংশ। কিন্তু মাতাকে নারী হওয়ার কারণে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত রাখা হয়নি।


স্ত্রী রূপে

নারী কন্যা হিসাবেও মীরাস পেলো। মাতা হিসাবেও মিরাসের অংশীদার হলো। এবার লক্ষ্য করুন, স্ত্রী হিসাবেও নারী উত্তরাধিকার লাভ করে। এক্ষেত্রেও সে বঞ্চিত নয়। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেন-


ولكم نصف ماترك أزواجكم إن لم يكن لهن ولدج فان كان لهن ولد تلكم الربع مما تركن من بعد وصية يو صبن بها أودين طولهن الربع مما تركتم ج إن لم يكن لكم ولد فان كان لكم ولد فلهن الثمن ما تركتم من بعد وصية توصون بها اودین


“তোমাদের স্ত্রীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধাংশ তোমাদের জন্যে যদি তাদের কোনো ছেলে-মেয়ে না থাকে এবং তাদের সন্তান থাকলে তোমাদের জন্যে তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ। এটা তারা যা ওসিয়ত করে তা আদায়ের পর এবং তাদের ঋণ পরিশোধের পর। আর তোমাদের ছেলে-মেয়ে না থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ এবং তোমাদের ছেলে-মেয়ে থাকলে তাদের জন্য তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক অষ্টমাংশ। অবশ্য তারা এ মীরাস পাবে, তোমরা যা ওসিয়ত করবে তা পূর্ণ করার এবং মৃতেরঋণ পরিশোধের পর।” (-সূরা আন নিসা : ১২)


আপনি দেখতে পাচ্ছেন, স্বামীকে যেরূপ স্ত্রীর উত্তরাধিকারী করা হলো, ঠিক তেমনি স্ত্রীকেও স্বামীর উত্তরাধিকারিণী করা হয়েছে। স্বামীর সম্পত্তি থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই।


নারীরা ক্ষতিগ্রস্থ নয়

গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, মীরাসের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই অধিক লাভবান। অর্থাৎ নারী যখন স্ত্রীরূপে স্বামীর গৃহে প্রবেশ স্ত্রী এবং করে তখন সাথে করে সে পিতালয় থেকে যা কিছুই নিক না কেনো, বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে স্বামী গৃহে প্রবেশ করুক না কেনো, সন্তানের সমুদয় ব্যয়ভার আইন ও শরীয়াত অনুযায়ী স্বামীর উপরই ন্যাস্ত হয়। (স্ত্রীর উপর নয়) এরূপ অবস্থায় স্ত্রী যে পরিমাণ অংশই পাক না কেনো, কোনো ঘটনাক্রমে যদি সে তার স্বামীর সাহায্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়, তবে তখন সে তার সম্পদ দ্বারা উপকৃত হতে পারবে। চিন্তা করলে দেখা যাবে, এ দৃষ্টিকোণ থেকে এক টাকার স্থলে আট আনাও স্ত্রীর জন্য যথেষ্ট। আর এ ধরনের গভীর তাৎপর্য আপনি নারীদের অন্যান্য অংশের বেলায়ও দেখতে পাবেন।


মাতা হিসাবে নারীর মান-সম্মান

মহান আল্লাহ তায়ালা মাতাকে ভক্তি-শ্রদ্ধার নির্দেশ দিয়েছেন। এভাবে নারীর মান সম্মান বৃদ্ধি করা হয়েছে, সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ বাৎসল্যের মহিমা বর্ণনা করেছেন। কুরআন মজীদে পিতার সাথে মাতার উল্লেখ করে স্পষ্টভাবে এ নির্দেশও দান করা হয়েছে : “তোমরা কখনো মাতা-পিতার প্রতি বিরক্তিসূচক 'উহ' শব্দটি ও উচ্চারণ করবে না। প্রত্যক্ষ পরোক্ষ উভয়ভাবেই মায়ের সম্মান করবে। ভাষায়ও নম্র এবং অন্তরেও বিনয়ী হবে।”


ولا تقل لهما أن ولا تنهرهما وقل لهما قولا كريما

“আর তাদেরকে (মাতা-পিতা) বিরক্তিসূচক কিছু বলো না এবং তাদেরকে ভৎসনাও করো না। তাদের সাথে সম্মানসূচক নম্র ভাষায় কথা বলবে।(-সূরা বনী ইসরাইল : ২৩)


এতে মাতা-পিতার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ে সময়ে কোরআনে উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। কখনো বলতেন : তোমাদের মাতাই তোমাদের সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্রী। (-বুখারী)


মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের জান্নাত। মাতা পিতার সন্তুষ্টি ছাড়া জান্নাতের দ্বার উন্মুক্ত হবে না।' এছাড়া আরো অনেক হাদীসে মাতার প্রতি অকুণ্ঠ ভক্তি প্রদর্শনের তাকীদ দান করা হয়েছে। (-তিরমিযী)


সার কথা, ইসলামে নারীর সঠিক স্থান নিরূপণ করা হয়েছে। জাহেলী ভ্রান্ত ধারণার স্থলে এরূপ ধারণা বদ্ধমূল করা হয়েছে যে, নারীর কর্তব্য কেবল বংশ বৃদ্ধি ও পুরুষের সেবা-যত্ন করাই নয়, বরং নারীও পুরুষের মতোই মান-সম্ভ্রমের অধিকারী। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ফিকহের গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। এখানে পটভূমিকা হিসাবে মাত্র কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। আমার এ গ্রন্থ লিখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, 'নারীজাতির সম্ভ্রম ও ইয্যত আবর'র নিরাপত্তা রক্ষার বিধানে ইসলাম যে সব নিয়ম ও নীতিমালা নির্ধারণ করেছে এবং আইনগত সীমার মধ্যে এনে মুসলিম জীবনে তার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে, সে বিষয়সমূহ আলোচনা করা।


নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার, নারীদের সপক্ষে ইসলামের সংস্কার

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!
close