বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহ - Ancient Human Habitation of Bengal
বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহ
Ancient Human Habitations of Bengle
প্রাচীনকালে সমগ্র বঙ্গ বা বাংলার কোন সুনির্দিষ্ট নাম ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশে তখন বিভিন্ন নামের জনপদ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। বাংলার বিভিন্ন অংশে তখন বিভিন্ন নামের জনপদ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। বাংলার বিভিন্ন অংশে অবস্থিত প্রাচীন জনপদগুলোর সীমা ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ রাজশক্তির হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে এদের সীমানা বার বার পরিবর্তিত হয়েছে।
বাংলার প্রাচীন জনপদগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, সুহ্ম, বজ্রভূমি, গৌড়, বরেন্দ, সমতট, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্তি ইতাদি। প্রাচীনকালে রাঢ়-পুণ্ড্র- সুক্ষ-বঙ্গ প্রভৃতি শব্দের সাহায্যে বিশেষ জাতি বা উপজাতি বুঝানো হতো। তারপর তাদের বিশেষ বিশেষ বাসস্থানের নাম হিসেবে তা ব্যবহৃত হতো।
প্রাচীনকালে মধ্য-পশ্চিমবঙ্গকে রাঢ়, দক্ষিণ- পশ্চিমবঙ্গকে সুহ্ম, উত্তরবঙ্গকে পুণ্ড্র, পূর্ববঙ্গকে বঙ্গ, পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলকে সমতট হরিকেল বলা হতো। এখনও মধ্য- পশ্চিমবঙ্গকে রাঢ় এবং উত্তর বঙ্গকে বরেন্দ্র বলা হয়। নিচে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জনপদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো:-
বঙ্গ
'বঙ্গ' খুব প্রাচীন দেশ। ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই দেশের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। 'বৌধায়নের ধর্মসূত্র' গ্রন্থে 'বঙ্গ' জনপদের নাম রয়েছে। 'রামায়ণ'-এ অযোধ্যার সাথে মিত্রতা স্থাপনকারী দেশের তালিকায় 'বঙ্গ'-এর উল্লেখ রয়েছে।
'মহাভারত' গ্রন্থেও একাধিকবার বঙ্গ' নামের উল্লেখ আছে। এ উল্লেখ থেকে জানা যায়, বঙ্গ ছিল পুত্র, তাম্রলিপ্তি ৩ সুহ্মের সংলগ্ন দেশ। পরবর্তী অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে মনে হয় গঙ্গা-ভাগীরথীই ছিল বঙ্গের পশ্চিম সীমা। 'বৃহৎ সংসহিতা'-য় উপবঙ্গ নামে একটি জনপদের কথা পাওয়া যায়।
ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে উপবঙ্গ বলতে যশোর ও তার আশপাশের জঙ্গলময় কয়েকটি অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে । ১১ বঙ্গ জনপদটি বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পুণ্ড্র
বঙ্গের প্রাচীনতম জনপদগুলোর অন্যতম ছিল পুর। বৈদিক সাহিত্যে পুত্র জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারতের "দিগ্বিজয় পর্বে বলা হয়েছে, পুত্র জনগন ছিল মুদ্গগিরি বা মুঙ্গোরের পূর্বদিকে এবং কোশী নদীর তীরে।
এই জনপদ ছিল অঙ্গ, বঙ্গ এবং সুক্ষ কোমদের জনপদের ঠিক গায়ে, উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর পুত্র জনপদের আওতাভুক্ত ছিল। বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ই ছিল পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রবর্ধন। রাজমহল গঙ্গা-ভাগীরথী থেকে শুরু করে। করতোয়া পর্যন্ত গোটা উত্তরবঙ্গই পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুরনগর পুত্র রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।
বরেন্দ্র
বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী ছিল উত্তরবঙ্গের একটি প্রসিদ্ধ জনপদ। এটি পুরু রাষ্ট্রেরই অংশবিশেষ। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত 'রামচরিতে' উল্লেখ করা হয়েছে; গঙ্গা ও করতোয়া নদীল মধ্যভাগের উচ্চভূমি বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী নামে পরিচিত। আবার 'তবকাত-ই-নাসিরী' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে,
বরেন্দ্রী ছিল গঙ্গানদীর পূর্বভাগে অবস্থিত লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের অংশবিশেষ। এছাড়া আরও জানা যায় যে, বরেন্দ্রীর অন্তর্গত ছিল আধুনিক রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর ও পাবনা জেলার অনেকখানি অংশ। রাজশাহী জেলার এক অংশ এখনও বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী নামে অভিহিত হয়।
রাঢ়
রাঢ় জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় 'আচারঙ্গ সূত্র' নামে এক প্রাচীন জৈন পুঁথিতে। এই জনপদের উত্তরতম সীমায় গঙ্গা-ভাগীরথী এবং পূর্ব সীমায়ও নদী ছিল। 'আচারগ সূত্রে' পশ্চিমবঙ্গবাসীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচয়। পাওয়া যায়। জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মহাবীর তার কয়েকজন শিষ্যের সাথে ধর্মপ্রচারের জন্য রাঢ় জনপদে এসেছিলেন।
কোর্টাবর্ষ ছিল রাঢ়ের রাজধানী, যার অবস্থান ছিল দিনাজপুর জেলার বানগ্রাম নামক গ্রামে। রাঢ় জনপদ সুহ্মভূমি ও বল্লভূমি এ দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। আর এই দু'ভাগের মাঝে সীমারেখা টেনেছিল অজয় নদ ।
সুহ্মভূমি ওবজ্রভূমি
গঙ্গ ভাগীরথীর পশ্চিমে দক্ষিণতম ভূখণ্ড অর্থাৎ বর্তমান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলির বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা- এ নিয়ে ছিল প্রাচীন সুক্ষভূমি বা সুগ্ধ জনপদ। পরবর্তীতে এই অঞ্চল দক্ষিণ রাঢ় নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। শ্রীধরাচার্যের 'ন্যায়কাদালি' নামক গ্রন্থে-এর উল্লেখ রয়েছে।
অন্যদিকে, রাঢ়ের উত্তরাংশ বন্ধভূমি নামে খ্যাত। পরে এ অঞ্চল উত্তর বাঢ় নামে পরিচিত হয়েছিল। বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ, অর্থাৎ কান্দি মহকুমা, সময় বীরভূম জেলা (সাঁওতাল ভূমিসহ) এবং বর্ধমান জেলার কাচৌয়া মহকুমা এই নিয়ে ছিল বজ্রভূমি বা উত্তর বাঢ়। মোটামুটি বলা যায়, অজয় নদী ছিল উত্তর রাঢ়ের দক্ষিণ সীমা এবং দক্ষিণ রাঢ়ের উত্তর সীমা।
সমতট
চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ লিপিতে সমতট নামক জনপদের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে 'বৃহৎসংহিতা'র আলাদাভাবে এই জনপদের উল্লেখ দেখা যায়। পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিচরণ হতে জানা যায়, সমতট ছিল আর্দ্র নিম্নভূমি। এটি ছিল কামরূপের দক্ষিণে।
বর্তমান ত্রিপুরা সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমতটেরই অংশ ছিল। সমতটের পশ্চিম সীমা এক সময়ে চব্বিশ পরগণার ঘড়ি পরগণা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীর থেকে শুরু করে একেবারে মেঘনা মোহনা পর্যন্ত গোটা কূলবর্তী ভূখণ্ডকেই খুব সম্ভবত সমতট বলা হতো। ত্রিপুরা জেলার বড় কামতা সপ্তম শতাব্দীতে সমতটের রাজধানী ছিল।
হরিকেল
হরকেল ছিল প্রাচ্য দেশের পূর্ব সীমায়। এ জনপদটি চন্দ্রদ্বীপ বা বাখরগঞ্জ অঞ্চলের সংলগ্ন ছিল। চীনা পরিব্রাজক ইৎ সিং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের প্রান্তসীমায়। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে দশম- একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত হরিকেল বহু সমতটের সংলগ্ন রাজ্য হলেও, এটি ছিল স্বতন্ত্র রাজ্য।
কিন্তু রৈলোক্যচন্দ্রের চন্দ্রদ্বীপ অধিকারের পর হতেই হরিকেলকে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়। হেমচন্দ্র বলেছেন, বঙ্গের সাথে এ জনপদ অভিন্ন। হরিকেল শ্ৰীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তাম্রলিপ্তি
মহাভারতে ভীমের 'দিগ্বিজয়' প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রচীন বাংলার প্রসিদ্ধ ও সুবৃহৎ নৌ-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে 'জাতকের গল্প' বা 'বৌদ্ধ পুঁথি'তে রারবার তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে। পেরিপ্লাস গ্রন্থ, টলেমি, ফাহিয়ান, হিউয়েন সাত ও ইংসিং-এর বিবরণে তাম্রলিপ্তি বন্দরের বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
সপ্তম শতাব্দী থেকেই দণ্ডভুক্তি জনপদের নামেই তাম্রলিপ্তি জনপদের পরিচয়। তবু বর্তমান মেদিনিপুর জেলার তমলুক এলাকাই তাম্রলিপ্তি জনপদের কেন্দ্রস্থল ছিল।
গৌড়
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ গৌড় নামে পরিচিত ছিল। মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে গৌঢ় জনপদ গড়ে উঠেছিল। তবে গৌড় রাজ্যের সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করে বলা কঠিন। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাংকের শাসনামলে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত গৌড় রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত ছিল।
গৌড়ের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কর্ণসুবর্ণ। অনেকে মুর্শিদাবাদ জেলার কানসোনা গ্রামকে প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ বলে ধারণা করেন। বাংলায়। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্বে পশ্চিম বাংলার মালদহ জেলার লক্ষ্মণাবতী 'গৌড়' নামে পরিচিত ছিল। রাজা শশাংবেনা তিরোধানের পর গৌড় জনপদের গৌরব রবি অস্তমিত হতে থাকে।