বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় - Emergence of Bangali Nation and Bangladesh
বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়
বাংলাদেশ নামে যে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের আমরা অধিবাসী তা বাংলা ভাষাভাষী, জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত জনপদের একটি অংশ মাত্র। প্রাচীনকালে বাংলাদেশ বলতে কোন নাম ছিল না। বাংলাদেশ বলতে এখন যে অঞ্চলটি বুঝায়, তখন সে অঞ্চলে কোন অখণ্ড রাজ্যও ছিল না। এদেশ তখন অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং এ রাজাগুলো বিভিন্ন জনপদ বা রাষ্ট্র নামে অভিহিত হতো। বিভিন্ন জনপদের সমষ্টিই হলো এই বঙ্গ বা বাংলাদেশ।
প্রাচীনতম ঐতিহাসিক কাল থেকে আরম্ভ করে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন বাংলাদেশ বিভিন্ন স্বতন্ত্র জনপদে বিভক্ত ছিল। জনপদগুলোর মধ্যে বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, ধরেন্দ্র, সমতট ও হরিকেল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম শাসক রাজা শশাংক (৬০৬-৬০৭ খ্রিঃ) এই জনপদগুলোকে 'গৌড়' নামে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার পরে বাংলাদেশ- 'পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন, গৌড় ও বঙ্গ' এই তিন জনপদে বিভক্ত ছিল।
রাজা শশাংকের আমলে বর্তমান মালদহ, মুর্শিদাবাদ হতে আরম্ভ করে উৎকল পর্যন্ত ভূ-খণ্ড এক রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হনয়। এ সময় হতেই গৌড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। অষ্টম শতাব্দীতে এসে সব জনপদ ও বিভাগ বঙ্গ জনপদের সাথে একীভূত হয়ে যায়। পাল ও সেন যুগে এক রাষ্ট্রীয় ঐক্যে বঙ্গের বিভিন্ন জনপদকে সংযুক্ত করা সম্ভব হলেও, বঙ্গ জনপদটি তখনও গৌড়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিগণিত হতো।
কিন্তু তথাপি বঙ্গের বাইরে বাঙালি বলতে গৌড়ীয় বা গৌড়দেশীয় বুঝাত। হিন্দু যুগের শাসকবর্গ বাঙালি ছিলেন সত্য, কিন্তু তারা নিজেকে বাঙালি অপেক্ষা গোঁড়ায় কিংবা গৌড়েশ্বর হিসেবেই পরিচয় দিতে অধিকতর গর্ববোধ করতেন। ইলিয়াস শাহের শাসনামলের পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থাই প্রচলিত ছিল। মোটকথা, মুসলিম শাসন পূর্ব যুগে বঙ্গে যেমন সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় সীমারেখা গড়ে উঠে নি, তেমনি একট পরিপূর্ণ জাতি হিসেবেও বাঙালিদের আত্মপ্রকাশ ঘটে নি।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দশক পর্যন্ত 'বাঙ্গালা' বলতে পূর্ব ও দক্ষিণ বদকে বুঝাত। ঐতিহাসিক মিনহাজ মুসলিম শাসনামলে লখনৌতিতে আগমন করেন (১২৪২-১২৪৪ খ্রিঃ)। তার বর্ণনানুযায়ী লক্ষ্য করা যায় যে, "ব" (Bang) বা '' (Bangla) এবং খনৌতি (গৌর) দু'টি আলাদা দেশ ছিল। আবার ঐতহসক বারাণীর বিবরণেও এ সমর্থন পাওয়া যায়। স্বীয় বিবরণে বাধানী বলেন, সুলতান বলবন তার পুত্র লখনৌতির গভর্নর সুঘরা স্থানকে নির্দেশ নিয়েছিলেন বা খ করার জন্য। এ থেকে স্পষ্টতই মুক্তা যায় যে, বাঙ্গালা ও লখনৌতি দু'টি পৃথক দেশ ছিল।
প্রখ্যাত ভূ-পর্যটক ও ঐতিহাসিক ইবনে বতুতা ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে এতদঞ্চলে আগমন করেন। তিনি পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের সমন্বয়ে বাঙ্গালার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লখনৌতির শাসক আলী শাহের সাথে বাঙ্গালার সুলতান ফখরুদ্দীনের সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনে বক্তৃতার বিবরণে জানা যায় যে, এতোদিন যে বাঙালিরা নিজেদেরকে 'গৌড়ীয়' বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতো, তারা মুসলিম শাসনামলে বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে।
তবে বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের সূচনাক্ষণে বঙ্গের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তিনি ছিলেন, তিনি হচ্ছেন ইলিয়াস শাহ্ । প্রথমদিকে ইলিয়াস শাহের আবির্ভাব ঘটে লখনৌতি বা লক্ষণাবতীর শাসক হিসেবে। পরে তিনি লখনৌতি ও বাঙ্গালাকে তার কর্তৃত্বাধীনে আনয়ন করেন এবং উভয় দেশকে একীভূত করে 'বাঙ্গালা' নামে আখ্যায়িত করেন। এ সম্মিলিত ভূ-খণ্ডে জনগণ নাতালি নামে পরিচিত ছিল।
ইলিয়াস শাহ্ নিজেকে বঙ্গের স্বাধীন ও সার্বভৌম সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। এতে করে একদিকে যেমন দুই ভূ-খণ্ডের স্বাস্থ্য বিলুপ্ত হয়, তেমনি অন্যদিকে "বাঙ্গালা' বা 'বঙ্গ' নামটি এককভাবে আত্মপ্রকাশ করে
ইলিয়াস শাহ্ নাঙালি অধ্যুষিত সকল অঞ্চলকে তিনি বাঙ্গালা নামে অভিহিত করেন এবং নিজেকে বৃহত্তর বাঙ্গালার জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাতে সচেষ্ট হন। বাঙ্গালার সাথে নিজের অভিন্নতা প্রকাশের জন্য তিনি 'শাহ-ই-বাঙ্গালা' এবং 'শাহ-ই-বাঙালি' উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি তার সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর নামকরণ করেন 'বেয়ান-ই-বাঙ্গালা', লস্করই বাঙ্গালা ও পাইকানি বাঙ্গালা।
অতএব বলা যায়, মুসলিম শাসনামলেই বাঙ্গালা বা বাঙালির সুনির্দিষ্ট অস্তিত্ব প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। ইলিয়াস শাহই প্রথম বাঙালি অধ্যুষিত সকল অঞ্চলের সমন্বয়ে 'বাঙ্গালা বা বঙ্গ' গঠন করেন। এই বঙ্গেনা সীমা ছিল তেলিয়াগড়ি থেকে চট্টগ্রাম এবং হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। এরপর কালের পরিবর্তনের কারণে বঙ্গের সীমারেখার পরিবর্তন ঘটেছে, তবে বাঙ্গালা ও বাঙালি জাতির ঐতিহ্য কখনও নিষ্প্রভ হয় নি।
মুঘল সম্রাট আকবর রাজ্য দখলের পর বাঙ্গালা বা বসকে একটি সুবায় পরিণত করেন। তাই আকবরের আমলে গোটা বঙ্গ বা বাংলাদেশ সুবা বাংলা' বলে পরিচিত হয়।
এরপর ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় আগত পাশ্চাত্যের বণিকদের দলিলপত্রে বঙ্গকে 'বেঙ্গালা' ( Bengali or Bengalis) নামে অভিহিত করা হয়েছে। তবে সর্বপ্রথম ইংরেজ বণিকরাই বঙ্গ বা বাংলাকে 'বেঙ্গল' (Bengal) নামে উল্লেখ করে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে নিয়ে গঠিত হয় 'বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী' (Bengal Presidency) বা 'বাংলা প্রদেশ'। এটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ।
বাংলা প্রদেশের উপবিভাগগুলো ছিল বেঙ্গল প্রপার, বিহার, উড়িষ্যা এবং ছোট নাগপুর। ১৯৫৪ সালে লর্ড ডালহৌসী (১৮৪৮-৫৬) লেঃ গভর্নরের অধীনে নতুন বাংলা প্রদেশের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু শাসনকার্যের সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার এই বিশাল প্রদেশ বিভক্তিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। অতঃপর ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়।
বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারতের আসামসহ গোটা উত্তর-পূর্ব এলাকার রাজ্যগুলো নিয়ে গঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল এন্ড আসাম' বা 'পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। আর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় আর একটি প্রদেশ 'বেঙ্গল'। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে, বিহার-উড়িষ্যা ও আসাম দু'টি পৃথক প্রদেশের মর্যাদা লাভ করে। আজকের বাংলাদেশ (সিলেট বাদে) এবং পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত হয় বঙ্গ বা বাংলা প্রদেশ।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত বর্তমানের বাংলা ভাষাভাষী ভৌগোলিক অঞ্চল দু'টি প্রাচীন আমলে ভিন্ন নামে পরিচিত একাধিক দেশের সংমিশ্রণে গঠিত। ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হলে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, যার নাম দেয়া হয় পূর্ববঙ্গ প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি প্রদেশের মর্যাদা লাভ করে।
১৯৫৬ সালে পূর্ববঙ্গ প্রদেশের নতুন নামকরণ হয় 'পূর্ব পাকিস্তান' (East Pakistan)। কিন্তু ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে । নব্য স্বাধীন এ ভূ-খণ্ড বাংলাদেশ' নাম গ্রহণ করে। আর এভাবেই বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালি জাতি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার পূর্ববঙ্গের 'বাংলাদেশ' নামকরণ করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধিকার ও বিজ্ঞতার প্রশ্ন তুলেছেন । কারণ তার ভাষায়, "পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশ আদিতে মুসলমানদের বাঙ্গালা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না (বেস) ওয়া বাঙ্গালাহ' তার প্রমাণ)।
কিন্তু ড. মজুমদারের এই উক্তি সত্তা এবং তথ্যভিত্তিক নয়। কারণ যে 'বঙ্গ', 'বঙ্গ'-এর অধিবাসী- 'বঙ্গাল থেকে মুসলমানদের 'বঙ্গালা' বা বাঙ্গালা' নামের উৎপত্তি, সে বঙ্গ-এর প্রায় সম্পূর্ণ অংশই বর্তমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সুতরাং 'বাংলাদেশ' নামকরণ মোটেই অযৌক্তিক নয়। বর্তমান বাংলাদেশ নামকরণের মধ্যে অতীতের বাঙ্গালা বা বঙ্গের স্মৃতিই তাই দেদীপ্যমান।