বঙ্গ বা বাংলা নামের উৎপত্তি - Origin of the Name of Bangla
'বঙ্গ' বা 'বাংলা' নামের উৎপত্তি Origin of the Name of 'Bangal' or 'Bangla'
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
"বঙ্গদেশ" বা "বাংলাদেশ" অতি প্রাচীন দেশ। মুঘল আমলে এই বঙ্গদেশ 'সুবহ-ই-বাঙ্গালহ' বা 'সুরা বাংলা' নামে পরিচিত ছিল। ফারসি শব্দ 'বসাসহ (Bangalah) থেকে পর্তুগিজ শব্দ 'বেঙ্গলা' (Bengala) এবং ইংরেজি 'বেঙ্গল' (Bengal) শব্দ এসেছে। বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা করা হয়, যে এলাকায় 'বং' (Bang) গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করত, তাই-ই এ নামে পরিচিত। সংস্কৃত 'বঙ্গ' শব্দ 'বং' বা 'বন্ধ' গোষ্ঠীর নাম।
পণ্ডিত ও গবেষকদের মতে, বঙ্গ থেকে 'বাংলা' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল সম্রাট আকবরের অমূল্য রত্ন ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে 'বাংলা' নামের উৎপত্তি সম্পর্কে দেখিয়েছেন যে, অতীতকালে বাংলাদেশকে 'বঙ্গ' বলা হতো।
এ 'বঙ্গ' শব্দের সাথে 'আল' (সংস্কৃত আলি, পূর্ববঙ্গীয় আইন) যুক্ত হয়ে 'বাঙ্গাল' বা 'বাঙ্গালা' নামের উদ্ভব হয়েছে। আল' বলতে শুধু আইল বা সীমা নির্দেশক গণ্ডি রেখাকেই বুঝায় না, ছোট-বড় বাঁধকেও বুঝায়। ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, এই নদীমার্তৃক বারিবহুল দেশে বৃষ্টি, বন্যা এবং জোয়ারের স্রোত ঠেকাবার জন্য ছোট-বড় বাঁধ- বাঁধা ছিল কৃষি ও বায়ুভূমির পার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য।
যে সব ভূখণ্ডের বারিপাত কম, ভূমি সাধারণত উর্বর, সেখানেও বর্ষার পানি ধরে রাখার জন্য ছোট বড় বাঁধ-বাঁধা প্রয়োজন হতো, এখনও হয়, যেমন : বীরভূম অঞ্চলে। প্রাচীন লিপিতে এ ধরনের বাঁধের পুনঃপুন উল্লেখ দেখতে পাওয়া হয়। যেমন বিশ্বরূপ সেনের মদনপাড়া লিপিতে এবং অন্যান্য অসংখ্য লিপিতে।
আবুল ফজল-এর মতে, চট্টগ্রাম থেকে গর্হি (রাজমহল) পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল 'বঙ্গ'। প্রাচীনকালে এর রাজারা ১০ গজ উঁচু ৩২০ চড়া একা 'আল' বা বাঁধ নির্মাণ করতেন। 'বঙ্গ' শব্দের সাথে এই 'আল' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে এ দেশের নতুন নাম হয়েছে 'বাঙ্গালা' বা 'বাদল'।
ড. নীহার রঞ্জন রায়-এর নিজের ভাষায়, “আমার অনুমান, আবুল ফজলের ব্যাখ্যার অর্থ এই যে, বঙ্গদেশ আল বা আলিবহুল, যে বঙ্গদেশের উপরিভূমির বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে আল, সে দেশই বাঙ্গালা বা বাংলাদেশ। এই আগুলোই আবুল ফজলের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সংস্কৃত গ্রন্থে বঙ্গ শব্দের উল্লেখ আছে। বঙ্গের সাথে 'আল' প্রত্যয় যোগে বঙ্গযুগ পাল (বঙ্গ+ আল্)= বঙ্গাল > বাঙ্গাল হয়েছে।
'বঙ্গ' ও 'আল'-এ শব্দ দু'টির সংমিশ্রণে 'বাঙ্গাল' নামের উৎপত্তিকে আবার অনেক ঐতিহাসিক স্বীকার করেন নি। তাদের মতে, প্রাচীনকালের অনেক শিলালিপিতে বন্ধু ও বঙ্গাল নামে দু'টো পৃথক দেশের উল্লেখ রয়েছে।
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, “খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী এবং সম্ভবত আরও প্রাচীনকাল হতে বঙ্গ বা বঙ্গাল শব্দ দু'টি পৃথক দেশ ছিল এবং অনেক প্রাচীন লিপি ও গ্রন্থে এই দুটি দেশের একত্র উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।
সুতরাং বঙ্গ দেশের নাম হতে 'আল' যোগে অথবা অন্য কোন কারণে বঙ্গাল অথবা বাংলা নামের উৎপত্তি হয়েছে এটা স্বীকার করা যায় না। বঙ্গাল দেশের নাম হতেই যে কালক্রমে সমগ্র দেশের বাংলা নামকরণ হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই ।"
মুসলমান ঐতিহাসিকদের দেয়া তথ্যে জানা যায় যে, 'বঙ্গ' এবং 'বঙ্গালা' একই ভূভাগ, 'বঙ্গ' 'বঙ্গালা' রূপলাভ করে। সোনারগাও অঞ্চল আক্রমণের সময় থেকেই 'বঙ্গালা' নামটি মুসলমান ঐতিহাসিকদের লেখায় স্থান পায় এবং সোনারগাঁও অধিকারের পরেই ইলিয়াস শাহকে 'শাহ-ই-বাঙ্গালা' রূপে অভিহিত করা হয় এবং এরপর থেকেই 'বঙ্গালা' নামটি সারা 'বাংলা'র জন্য প্রযোজ্য হয়।
'বঙ্গালা' নাম 'বঙ্গ'-এর অধিবাসী 'বঙ্গাল' বা 'বাঙ্গাল' থেকে এসেছে অথবা বলা যায় 'বঙ্গাল দেশ' (অর্থাৎ বঙ্গালদের দেশ) কমাটির ফারসি রূপ 'বঙ্গালা' এ কথা ঠিক যে, মুসলিম আমলের পূর্বে 'বঙ্গ' বা 'বঙ্গাল' বাংলার অংশ বিশেষেরই নাম ছিল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বঙ্গ বা বাংলা নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণ দু'দলে বিভক্ত। এক দলের মতে, বঙ্গ নামের সাথে 'আল্' যুক্ত হয়ে বঙ্গাল বা বাঙ্গাল বা বাংলা হয়েছে। আর এক দলের মতে, 'বঙ্গাল' দেশের নাম হতেই বাংলা নামকরণ হয়েছে।
এ দু'দলের কারো মতকেই অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে প্রথমোক্ত দলের মতই অধিকতর গ্রহনীয়। কারন এদেশে আলু বা বাঁধের প্রয়োজন বেশি বলেই, 'আল' যোগে নামের যৌক্তিকতাই অধিক।