তৃষিত স্বপ্ন - এক টুকরো রোদ | A thirsty dream is a piece of sunshine (Part 13)

Mofizur Rahman
0

তৃষিত স্বপ্ন - এক টুকরো রোদ | A thirsty dream - A piece of Sunshine (Part 13)


তৃষিত স্বপ্ন (এক টুকরো রোদ) - ১৩

তৃষিত স্বপ্ন - A thirsty dream

আসিফ টেলিফোনে ওদিকের কন্ঠ শুনে চমকে উঠে। আপনি কাকে চাচ্ছেন? আসিফ নাম্বার কনফার্ম করে আবার। তখন ওপার থেকে জওয়াব আসে, জ্বি নাম্বার ঠিক আছে । আপনাকে তো চিনতে পারলাম না । আসিফ এবার অনেকটা নিশ্চিত হয়ে বলে, আমি যার কাছে ফোন করেছি তার কথায় পরে আসছে, আগে বলুন আপনি মেরিনা কিনা?

জ্বি, আপনার পরিচয় তো দিলেন না ।
তুমিতো বাইরে থাকো, কবে এসেছো দেশে। মাস খানেক হলো। কিন্তু আপনি কে বলছেন আমি ঠিক ধরতে পারছি না।
কেমন আছো তুমি, তোমার ছেলেমেয়ে ক'জন?
ভালো, আপনার নামটা বলুনতো? তোমার ছেলেমেয়ে কি তা কিন্তু বললে না ।
দুই ছেলে এক মেয়ে।

বেশ সংসারী হয়েছো দেখা যায়। সব মেয়েরাতো সংসারী হয়।
তা ঠিকই বলছো তুমি কিন্তু আপনিতো পরিচয় দিচ্ছেন না। সব ক্ষেত্রে পরিচয় কি দেয়া যায়?
নাম বলুন অন্তত।

কোন কোন নাম সময়ে মন থেকে মুছে যায়। সে রকম একটি নাম নতুন করে মনে করিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না দীর্ঘদিন পর বুঝতে না পারাটাই খুব স্বাভাবিক।
মেরিনা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ভাবে লাইনটা কেটে দেবে কিনা । পরক্ষণেই কৌতূহল জাগে আবার।
আচ্ছা বলুনতো আপনি ফোন কেন করেছেন এখানে? নিশ্চয় আমার কাছে করেননি
তোমার কাছে করিনি সত্যি কিন্তু এখনও তোমার কন্ঠ শুনতে ভালো লাগছে ।
আমার কণ্ঠ কেন আপনার ভালো লাগবে। আপনার সাথে আমার জানা নেই।
পরিচয় নেই।

জানাশুনা একসময় বেশ কিছু । এখন নেই আর কি । মেরিনার মনের ভেতর খটকা লাগে। লোকটি পরিচয় দিচ্ছে না কেন বুঝে উঠতে পারি না । শুধু নামটা বলুন প্লীজ ।
তুমি তের বছর আগের দিকে একবার ফিরে তাকাও । আসিফ মেরিনাকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না, হঠাৎ লাইন কেটে দেয় । আসিফ একাএকা চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। এসময়ে অফিসে কেউ থাকে না। সারাদিনের ব্যস্ততা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। অন্যদিন বাসায় ফেরার আগে সবকিছু দেখে নেয় একবার । আজ কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছে না, মনটা ক্ষণিকের মধ্যে ভারী হয়ে গেল।

অতি পরিচিত কণ্ঠ অচেনা হয়ে উঠার কারণ খুঁজে সে সময়ের সাথে সাথে সবকিছু বদলে যায়, এসত্য উপলব্ধি করতে পেরেও আসিফ মেনে নিতে পারে না। মেরিনা কি সত্যি চিনতে পারেনি তাকে। এতক্ষণ কথা বলার পরও সে ধরতে পারলো না এভাবে কে কথা বলতে পারে। হউক না দীর্ঘ তের বৎসর তাতে কি মানুষের কন্ঠস্বর অচেনা হয়ে যেতে পারে। নাকি মেরিনা ইচ্ছা করে এড়িয়ে যেতে চাইছে, এতদিন পর পুরানো প্রসঙ্গ টেনে বিড়ম্বনা বাড়িয়ে লাভ কি।

সেতো এখনো এতদুর পৌছেনি যে, আসিফের মত ছেলের সাথে একসময় পরিচয় ছিল সেকথা অন্য কাউকে জানাতে অসম্মান বোধ করবে। তবে সে ফোন ছাড়তে চায়নি, কথা বলার অনিচ্ছা তার মাঝে ছিল না । হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে, আসিফ রিসিভ করে ভুল নাম্বার বলে বিরক্তি সহকারে নামিয়ে রাখে। তারপর অফিস থেকে বের হয়ে যায়।
বাসায় এসে কিছুক্ষণ টিভির সামনে বসে থাকে । রাত আটটার বাংলা সংবাদ শুনে । পুর্বা প্রতিদিনের মত আজও চা করে দেয় আসিফকে নিজেও এক কাপ খায়।

আসিফ পুর্বার দিকে তাকিয়ে বলে, বিকেলে চা খাওনি আজ । খেয়েছি তবুও তোমার সাথে খেতে ভালো লাগে। আসিফের দৃষ্টি এবার স্থির হয় পূর্বার দিকে কি দেখছো, পুর্বা প্রশ্ন করে।

আসিফ কোন জওয়াব না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। খবর শেষ হওয়ার পর সে কাপড় চোপড় পাল্টে বাথ রুমে ঢোকে। হাত-মুখ ভালো করে পানিতে ধুয়ে নেয় । বাথ রুম থেকে বের হতে পুর্বা টাওয়েল বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তোমার মুখ ধোয়া মানে হাফ গোসল । এই কথাটা শুনে সে হাসে না। হাত মুখ মুছে বিছানায় আধ-শোয়া হয়ে কি যেন ভাবে। পূর্বা পাশে বসে 'সানন্দা'র পাতা উল্টায় একের পর এক। দ্রুপদীর পাতায় এসে থেমে যায় সে। এসংখ্যার কবিতাগুলি পড়েছো তুমি।

আসিফ মাথা নেড়ে সায় দেয় তুমি কথা বলছো না কেন? তোমার শরীর খারাপ লাগছে ?
না, এমনে ।
অফিসে কোন অসুবিধা হয়েছে নাকি।
অফিসে আবার কি অসুবিধা।
কোন ঝামেলা?
ঝামেলাতো লেগেই আছে।

পুর্বা কপালে হাত দিয়ে দেখে। জ্বর-টর নাই। তারপর বলে, টিভিতে নাটক শুরু হয়েছে, চল ওখানে গিয়ে বসি। আজকের নাটকটি খুব জমবে। দেখবে মনটা তখন হালকা হয়ে গেছে। না, আমার ভালো লাগছে না, তুমি গিয়ে দেখ।
পূর্বা যায় না, পাশে বসে থাকে। এবার আসিফ বলে, তুমি যাও আমি একটু পরে আসছি।

পূর্ব যাওয়ার পর আসিফ টিভি দেখতে যায় না। বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় পূর্বা আরেকবার এসে সাদাসাদিও করে খুব রোমান্টিক নাটক, সংলাপ শুনে বুঝতে পারছো না তুমি । আসিফ মাথা নেড়ে সায় দেয়।
তুমি পাশে থাকলে মনে হয় সংলাপগুলো আমাদের দুজনের মাঝে হচ্ছে আর আমি পাশে না থাকলে? আসিফ অন্য মনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
তুমি পাশে না থাকলেও আমি তোমার সাথে কথা বলি। তবে সেই সংলাপের
স্বাদ অন্যরকম। কি রকম তা বলতে পার ? তা অনুভব করা যায়, বলা যায় না।

রাতের খাওয়া শেষে আসিফ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে
অনেকক্ষণ । পূর্বা পাশে এসে বলে; কি দখছো বাইরে? না, কিছু না শোবে না, সকালে তোমার অফিসে যেতে হবে তো।

আসছি বলে সে দাঁড়িয়েই থাকে । পূর্বা হাত ধরে বলে, এসো শোবে বিছানায় এসেও আসিফ চুপচাপ শুয়ে থাকে নড়া-চড়াও করে না। পুর্বা জিরো পাওয়ারের নীল লাইট জ্বালিয়ে টিউব লাইট অফ করে দেয়। আসিফকে এত গম্ভীর হয়ে থাকতে সে আর কখনও দেখেনি। তাকে দেখতে রাশভারী মনে হলেও তার ভেতরটা খুব সহজ প্রকৃতির, খুব কাছ থেকে না দেখলে তা সহজে বুঝা যায় না। কিন্তু আজ তার কি হলো। সে নির্লিপ্ততার মাঝে ডুবে আছে কেন? এমন কি হয়েছে সে আমাকেও বলতে পারছে না।

পূর্বা আসিফের বুকের উপর হাত রেখে ডাকে, আসিফ।
হু।
তোমার কি হয়েছে আমাকে বলো।
আসিফ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে। পুর্বার কোমল হাতের স্পর্শ ওকে একটু তরল করে তোলে। সে বলতে পারে কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে ভালো লাগতো, বলেছিলাম না? হ্যাঁ বলেছো, ওরাতো বাইরে থাকে ।
এখন দেশে এসেছে ।
তোমার সাথে দেখা হয়েছে?
দেখা হয়নি, ফোনে কথা হয়েছে।
কি বলেছে?
তেমন কিছু বলেনি, কিন্তু আমাকে চিনতে পারেনি।

অনেকদিনের ব্যাপার, হয়তো তাই ভুলে গিয়েছে। আমার মনে হয়, সে ইচ্ছা করে আমাকে না চেনার ভান করেছে।
ওভাবে চিন্তা করছো কেন তুমি ?
ডা অবশ্য ঠিক, আমার পরিচয় আমি ওকে দিইনি । নামও বলিনি তাহলে ও কিভাবে চিনবে তোমাকে।
আমি ওর কন্ঠস্বর শুনে ঠিকই চিনে ফেলেছি।

তুমি ওর কণ্ঠস্বর মনে রেখেছো এতদিন, ওকে যে রাখতে হবে এমন কথাতো নেই । আসিফ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোমার কথাই ঠিক হতে পারে। এজন্য তুমি এতক্ষণ মন খারাপ করে আছো, যেন কি হারিয়ে গেছে তোমার জীবন থেকে।

আসিফ পাশ ফিরে শুয়ে পূর্বার কপাল স্পর্শ করে। পূর্বা মন্তব্য করে আবার, তোমার বাইরে যত কঠিন ভেতরে তার চেয়ে বেশী কোমল । পরের দিন আসিফ অফিস শেষে ঐ নাম্বারে টেলিফোন করে । আজও মেরিনা রিসিভার তোলে বলে, হ্যালু, আপনি কাকে চাচ্ছেন?
মেরিনা, তুমি কেমন আছো।

আজ কিন্তু নাম আর পরিচয় দুই চাই, নইলে আমি রিসিভার রেখে দিচ্ছি এখনও টের পাওনি, এতদিন পর এভাবে তোমার সাথে কে কথা বলতে পারে। তা পেয়েছি তবে ফোনে কথা বলতে নামটাতো অন্ততঃ বলা চাই আমার ধারণা, আমার কণ্ঠ এখনও তোমার কাছে পরিচিত। সেই আমার অক্ষমতা। আর তোমার মত করে আমিতো এত সুন্দর করে কথা বলতে পারি না।

তুমি সাজিয়ে বলতে না পারলেও তোমার কণ্ঠ আমি মনে রেখেছি। আমি যে এখানে তা কিভাবে জানলে? তোমার কন্ঠ শুনে । ফোন নাম্বার কোথায় পেলে।
এই নাম্বার আমার এক ক্লাইন্ট থাকে।
তোমার ক্লাইন্ট।
আশ্চর্য্য হলে মনে হয় । হবো না, কি কর তুমি?
আমাদের আর কি, মধ্যবিত্তের চাকরী ছাড়া গতি আছে।

কোথায় কাজ কর তুমি?
সে পরে হবে, আগে বলো, তুমি ওখানে কেন?
এটা আমার শাশুড়ীর বাসা। মিসেস সালমা চৌধুরী তাহলে তোমার শাশুড়ী।
হ্যাঁ, উনার মেজ ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
তোমার বর ইঞ্জিনিয়ার না। কি করে জানলে?
বিয়ের কার্ডটা দিয়েছিলে না আমাকে, মনে পড়ছে? হ্যাঁ, তা পড়ছে, অনার্স পরীক্ষা শেষে বের হওয়ার সময়।

এইটুকু স্মরণ করতে পারার জন্য ধন্যবাদ তুমি কি আমার স্মৃতি শক্তি খুবই দুর্বল মনে করো। থাক সেসব প্রসঙ্গ।
তোমার মেয়ের কি নাম রেখেছ। ও কার মত হয়েছে দেখতে? সুমা; কার মত হয়েছে বলতে পারব না। খুব ইচ্ছা হলে দেখে যাও একবার।

কোথায় খুঁজে পাব তোমাদের। আমাদের বাসায়, আমি তো প্রায় ওখানে থাকি। বাসায় তুমি একবার গিয়েছিলে না? তা গিয়েছি, কিন্তু এখন তোমাদের বাসাটা ঠিক ধরতে পারি না। চারিদিকে যেভাবে উঁচু উঁচু দালান গড়ে উঠেছে তাতে মনে হয় তোমাদের বিলাসবহুল বাড়িটিও আবাসিক ফ্ল্যাটে পরিনত হয়েছে। তা হয়নি, তুমি মেইন রোড থেকে নীচের দিকে নামলেই গলিপথের ডানপাশে দ্বিতল বাংলোটি দেখতে পাবে। আর আমাদের বাসার ফোন নাম্বার কি তোমার মনে আছে?

আছে বৈকি?
মেরিনা একটু অবাক হয় । এতদিন মনে রেখেছো। তোমার বিয়ের কার্ড যে এখনও আমার কাছে আছে। ওখানেতো তোমাদের ফোন নাম্বার লিখা আছে । মেরিনা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে, কার্ডটি এখনো তুমি রেখে দিয়েছো । কিছু কথা কিছু স্মৃতি আছে যা ভুলা যায় না । ইচ্ছা করলেও মুছে ফেলা যায় না।

তুমি আমাকে ভালবাসতে তা আমি বেশ বুঝতে পারতাম কিন্তু এভাবে যে মনের গভীরে নিয়ে গিয়েছিল তা বুঝিনি।
বুঝলে কি করতে? কিছুই করতে পারতাম না, তবে তোমার জন্য কষ্ট হতো । এখন ভালো হলো, কষ্টটা শুধু আমার একারই থাকলো।
মেরিনা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে, তোমার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানালে না । তোমাকে জানানোর কি বিষয় থাকতে পারে আমার।

ধর কি চাকরী কর, বিয়ে-শাদী এসব আর কি
হ্যাঁ বিয়েতো করেছি।
নিশ্চয় তোমার বউ খুব সুন্দরী।
আগাম মন্তব্য করলে যে।
তুমিতো একসময় কবিতা লিখতে ।
কবিতায় তো মনের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে হয় । এখন লিখনা ।
মাঝে মধ্যে।
তোমার বউ কবিতা পছন্দ করে।
সে মনে প্রাণে বাঙালী; কবিতা পছন্দ না করে পারে। খুশী হলাম শুনে। তুমি অন্তত মনের মত বউ পেয়েছো ।

তুমি পাওনি মনের মত ।
তা পেয়েছি।
একটু থেমে আবার বলে, তুমি কি এখন আমার কাছে ফোন করেছো নাকি শাশুড়ির কাছে ।
এখন ঠিক বলতে পারছি না। তোমার সাথে আজকের সংলাপে মনে হলো তোমার কাছেও ফোন করা যায়। শাশুড়ি কিন্তু এই মাত্র বাসায় ঢুকেছেন, উনাকে দেবো।
দাও।

এই শোন, তুমি কিন্তু কাল বাসায় ফোন কর, আমি ওখানে থাকবো। আচ্ছা।
মেরিনা শাশুড়ীকে ফোন দিয়ে পাশের রুমে চলে যায় ।
পরদিন আসিফের অফিসে ব্যস্ত দিন কাটে। ফোন করার সময় হয়ে উঠেনি আর ।
বিকেলে আসিফের কাজে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। কখনো কখনো এরকম হয় [ব্যস্ততার মাঝে মাঝে ডুবে থাকতে হয় সারাক্ষণ তখন অবশ্য বেশ ভালো সময় কাটে। ঘড়ির কাটায় কাটায় সব কাজ শেষ করতে পারে। মনটা ভারী থাকে না আর। একবারে হালকা বোধ করে নিজেকে। তাই এই সব অনেকের কাছে বোরিং লাগলো সে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

তারপরদিন আসিফ সকাল দশটার দিকে মেরিনাদের বাসায় ফোন করে। ওপার থেকে নারী কণ্ঠ বেসে আসে। আসিফ একটু অপ্রস্তুত কণ্ঠে জানতে চায় । এটা কি মেরিনাদের বাসা। হ্যাঁ সে তো বাসায় নেই। আপনি কে বলছেন? ও বাসায় ফিরবে কখন? তা ঠিক বলে যায়নি আপনার কোন জরুরী কথা থাকলে বলতে পারেন। ও বাসায় এলে আমি বলব।

তেমন জরুরী কিছু না । তবে একটা ফোন নাম্বার দিতে পারবেন ওকে। না পারার কি আছে। আপনার নামটা বলুন ।
আসিফ।
আপনি একটু ধরুন আমি কলমটা নিচ্ছি ।
জ্বি আচ্ছা ।
একটু পরে বলবেন, হ্যাঁ বলুন ।
আসিফ নাম্বারটা বলে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখে। মেরিনা দুপুর নাগাদ বাসায় ফিরে আসে। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে ভাবী নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, আসিফ নামের একজন ফোন করেছিল।

একটা নাম্বারও দিয়েছে তোমাকে দেয়ার জন্য । দেখি বলে মেরিনা হাত থেকে স্লিপটা নিয়ে টেলিফোনের ডায়াল ঘুরায় ।
আসিফ রিসিভার তুলে বলে, হ্যালো ।
কে আসিফ।
ও, তুমি । কেমন আছো?
ভালো ।
তুমি কেমন আছো?
এইতো
সকালে ফোন করেছিলে।
হ্যাঁ।

আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম। বড় ছেলে কম্পিউটার শিখছে, ওকে নিয়ে যেতে হয় । এখানকার রাস্তাঘাট ভালো করে চিনে না। তাই একা যেতে দিতে
ভয় লাগে ।
ওরা বাংলা কেমন জানে? বেশ বলতে পারে । কিন্তু ভালো লিখতে পারে না ।
বাসায় শেখাতে পার ।
তা হয়ে উঠে না । তেমন সুযোগও নেই ।
তোমার কিছু বলছো না ।
ভালো বাংলা না জানার জন্য ওরা একদিন আক্ষেপ করবে। তা করতে পারে । তোমার খবর কি বলো । তুমি সবসময় আমারটা জেনে নিচ্ছ, আমার যে বলার মত তেমন কিছু নেই। তা আমি ভালো করেই জানি।

তুমি কিসে চাকরী কর, অফিস কোথায় তাও বললে না। আমি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি।
তা বুঝতে পারছি। কিন্তু অফিসটা কোথায়? তা আরেকদিন বলব।
তুমি ঠিকানা দিলেও আমি কখনো যাব না তোমার অফিসে।
তুমি লাঞ্চ করো কোথায় ? কখনা বাসায়, কখনো বাইরে।
আজ কোথায় করবে? বের হচ্ছিলাম তোমার ফোন পেয়ে আবার বসেছি।
তখন মেরিনার দুই বছরের মেয়ে সুমা ঘুম থেকে উঠে মাম্মি মাম্মি করে ডাকতে থাকে। মেরিনা পরে কথা হবে বলে ফোন রেখে মেয়ের কাছে ছুটে যায়। আসিফ মুহুর্ত অপেক্ষা না করে লাঞ্চে বের হয়ে যায়।

কয়েকদিন আসিফের ঘোরের মাঝে কেটে যায়। অফিসে সময়টা বেশ কাটে; অতীতের কোন স্মৃতিই এই ব্যস্ত সময়ে ভর করতে পারে না। কিন্তু অফিস শেষে সন্ধ্যাটা আর কাটতে চায় না। বিচ্ছিন্ন যতসব ঘটনা একের পর এক মনটাকে ভারী করে তোলে। মনে মনে কয়েকপদ কবিতাও তৈরী করে। কিন্তু কাগজে লেখার মত মানসিকতা থাকে না তখন। মনে মনে আওড়ায় কবিতার পংক্তিমালা । খুব ইচ্ছা করে কাউকে না কাউকে শুনাতে । যাকে নিয়ে এই শব্দমালা, সেতো কবিতা শুনতে চায় না। কবিতা তার ভালো লাগে না।

অবশ্য এরিমধ্যে আসিফ শুনাতে পেরেছে কবিতার কয়েকটি চয়ন। সে প্রথমে বেশ মনোযোগে শুনেছে পরে ধীরে ধীরে কেমন যেন অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছে। ফোন ধরে রেখে ছোট মেয়ে সুমার সাথে কি যেন কথা বলেছে। মেরিনা আগে কবিদের পাগল মনে করতো । তার সে মনোভাব এখনও বদলায়নি তা আসিফ বেশ বুঝতে পেরেছে তবুও মেরিনাকে আজও কেন ভালো লাগে সে বুঝতে পারে না। তার টেলিফোনে কন্ঠ ভারী চমৎকার শুনায়। সে কোন শ্রোতা কন্ঠের প্রশংসা না করে পারবে না। টেলিফোনে তার কন্ঠে আলাদা এক মাদকতা জড়িয়ে যায়। খুব ভালো লাগে তখন আসিফের।

বার বার শুনতে ইচ্ছা করে সেই কণ্ঠের সংলাপ। শুনতে শুনতে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে। মনের ভেতর চেপে রাখা অনেক কথা বলে ফেলে। কোন ফাঁকে অফিসের নাম ঠিকানাও জানিয়ে দেয় টের পায় না। মেরিনা ওপাশ থেকে বলে, পাগলের মত এসব কি বলছো । তখন আসিফের বোধোদয় হয়। সে কিছুটা বিনীত কণ্ঠে বলে, দেখ তোমার সাথে অযাচিত কত কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করো না তুমি মেরিনা ওপাশ থেকে বলে, সত্যি তোমার মনটা এখনো তারুন্যে ভরপুর। সংলাপটা খুব মনপুত হয় আসিফের। বুকের ভেতর জমা বুদবুদ আবার নড়াচড়া দিয়ে উঠে।

আজ বৃহস্পতিবার, হাফ ডে অফিস । পুরো দিনের যত কাজ কর্ম হয় এই অর্ধেক কর্মদিবসে । সকাল থেকে টেলিফোন দুটি বাজতে থাকে একের পর এক কখনো এক সাথে বেজে উঠে। আসিফকে টেলিফানে ব্যস্ত থাকতে হয় অনেকক্ষণ । আজ কিন্তু একটু ব্যতিক্রম ব্যস্ততা অন্যদিনের চেয়ে অনেক কম। সকাল বেলা বেশ কয়েকটি ফোন এসেছে, বলতে গেলে জরুরীই তবে হঠাৎ করে য বের হয়ে যেতে হয় সেরকম না। অবশ্য আসিফ বৃহষ্পতিবার সহজে অফিস থেকে বের হতে চায় না । বাইরের প্রোগ্রাম অন্যদিন সেট করে সে। কাজ একটু হালকা বলে সে বিজেনেস রুলস এন্ড রেগুলেশন এ্যাক্ট এর পাতায় চোখ বুলায় । এমন সময় মেরিনার কন্ঠ শুনে সে চমকে উঠে।

আমাকে দেখে খুব অবাক হলে বুঝি । গ্লাসের ভেতর দিয়ে মেরিনাকে দেখে সত্যিই আসিফ অবাক হয়ে যায়। সে ভাবতে পারে নি মেরিনা তার অফিসে আসতে পারে। ভেতরে ঢুকতেই আসিফ দাঁড়িয়ে টেবিলের ডানদিকের চেয়ারটি দেখিয়ে বলে, তুমি এখানে বসো।

মেরিনা চেয়ারে বসতে বসতে বলে, কেমন আছো, ভালোতো । আসিফ মাথা নেড়ে জওয়াব দেয় হু, তুমি কেমন আছো ।

এইতো ভালো আসিফ কথা বলতে কেমন যেন জড়িয়ে যায়। সে স্থির দৃষ্টি মেলে মেরিনার দিকে তাকিয়ে থাকে । মেরিনা আগের মত শাড়ীর সাথে ম্যাচ করে ব্লাউজ পড়েছে। আকাশী ব্লাউজের সাথে হালকা প্রিন্টের অপ হোয়াইট রংয়ের কাশফুলের মত শাড়ীটা ওর সর্বাঙ্গ যেন কাব্যময় করে তুলেছে। শরৎ এর স্নিগ্ধ রোদে মৃদু বাতাস কাশবনের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেন আসিফের সমস্ত মন ও হৃদয়কে স্পর্শ করে যাচ্ছে। সে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে মেরিনার অপরূপ বসার ভঙ্গিমায় ।

হাতের কনুই পর্যন্ত ব্লাউজের হাতা এসে থেমে গেছে, ওখান থেকে মায়াবী লোমগুলি কচি ঘাসের মত জড়িয়ে রেখেছে হাত যুগল। এযুগে মেয়েরা চুল কেটে কত রকম ফ্যাশন করে। মেরিনা আগের মত কানের দুপাশে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে উঠা চুলগুলো সযত্নে লালন করেছে। বড় মায়াবী করে তোলে তার অবয়ব এই দুইগাছি চুল। ঠোঁটের প্রান্তদেশ পালিশের ছোঁয়ায় বৃষ্টিস্নাত জবা ফুলের মত সজীব এখনো। চোখের দিকে তাকিয়ে আসিফ থেমে যায়। গহীন গভীর অরন্যে আদি যুগে খুঁজে পাওয়া কোন দীঘির জলের মত স্বচ্ছ আর স্থির পাতা আর ফুলের বেড়ে কোন হরিণী যেন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে নীল আকাশের সীমা রেখায়। মেরিনা নীরবতা ভঙ্গ করে বলে, তুমি কথা বলছো না যে। তোমাকে দেখছি, তুমি ঠিক আগের মত আছো।

এখনও কি তুমি আগের মত স্বপ্ন দেখ?
স্বপ্ন কখনো হারায় না মেরি। মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায়। স্বপ্ন না থাকলে কি নিয়ে বাঁচব বলো ।
মেরিনা পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলে, তুমি স্বপ্ন নিয়ে থাকো। আমি উঠছি আজ । ভাবীরা বাইরে অপেক্ষা করছে। পাঁচ মিনিটের সময় নিয়ে এসেছি। আর একটু বসো না, খুব ভালো লাগছে তোমাকে হঠাৎ মেরিনার দীপ্তিময় চেহারায় অসংখ্য অনুরণ খেলা করে যায়। সে আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলে, সত্যি বলতে কি, তুমি প্রকাশ করতে পার আর আমি পারি না।

আসিফের হৃদয়ে হঠাৎ জলের প্লাবন বয়ে যায়। সে প্লাবন হৃদয়ের কিনারা
উপছে জলমগ্ন করে দেয় আসিফের দু'চোখ।


তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন, তৃষিত স্বপ্ন

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!