জাতিসংঘে বাংলাদেশের শান্তির সংস্কৃতি প্রস্তাব ও বিশ্বশান্তি - Bangladesh's culture of peace proposal and world peace at the United Nations

Mofizur Rahman
0

Bangladesh's culture of peace proposal and world peace at the UN - জাতিসংঘে বাংলাদেশের শান্তির সংস্কৃতি প্রস্তাব ও বিশ্বশান্তি

জাতিসংঘে বাংলাদেশের শান্তির সংস্কৃতি প্রস্তাব ও বিশ্বশান্তি - Bangladesh's culture of peace proposal and world peace at the United Nations

জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রস্তাব ও বিশ্বশান্তি লেখক ড. দেলোয়ার হোসেন

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আবারও গৃহীত হলো বাংলাদেশের শান্তির সংস্কৃতি' প্রস্তাব। এর মাধ্যমে বিশ্বশান্তির জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি ও ভূমিকা নতুন করে স্বীকৃতি পেল। আন্তর্জাতিক শান্তি, উন্নয়ন ও সহযোগিতার জন্য নিরলস প্রচেষ্টার বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ১৪ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রক্ষে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত।

উল্লেখ্য, এই প্রস্তাব ১০০টি দেশের সমর্থন নিয়ে উত্থাপন করা হয়, যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রতি ব্যাপক আস্থার প্রতিফলন দেখা যায়। বরাবরই বাংলাদেশ বৈশ্বিক ঐক্য, সংহতি ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, সেখানে তিনি বিশ্বশান্তি, মানবতা ও সমৃদ্ধির প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও চেষ্টার কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানবতা বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।


শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও অত্যাচার-নিপীড়নের ইতিহাস, ২৫ বছরের পাকিস্তানের নিষ্পেষণ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশবাদ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আধিপত্যবাদ, বৈষম্য ও সংঘাতের বিরুদ্ধে দেশটির ঐতিহাসিক অবস্থানের পরিচয় বহন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) শান্তির সংস্কৃতির ধারণাটি উপস্থাপন করেন এবং ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।


বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে এবং পৃথিবীকে সংঘাতমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের সবব দেশ ও সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির সঙ্গে এই শান্তি সংস্কৃতির প্রস্তাবটি দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। কারণ বাংলাদেশ চায় বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টা ও প্রয়াসের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সবাই এগিয়ে আসুক।


জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সংকট ও সংঘাত নিরসনের জন্য শান্তি সংস্কৃতির প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


শান্তির সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সংঘাত নিরসন ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাই তিনি সংঘাত ও বিরোধের পরিবর্তে সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও এ নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং কীভাবে এই শান্তির ধারণার মাধ্যমে বিশ্বে ন্যায়বিচার, সাম্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া যায় এবং এর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে ব্যাপারে মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

আমরা জানি, জাতিসংঘের মহাসচিব প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘকে মানুষের জন্য অর্থবহ করা এবং এটিকে সক্রিয় রাখার জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে শান্তি সংস্কৃতির প্রস্তাবটি নিরোধমূলক কূটনীতিকে (preventive diplomacy) শক্তিশালী করা এবং সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত ও বিরোধ নিরসনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এখানে নারীদের একটি বিশেষ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সংঘাত নিরসনে নারীদের বিশেষ ভূমিকা আছে, কারণ নারীদের পূর্ণ ও অর্থবহ অংশগ্রহণের মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক পর্যায়ে ফলপ্রসূ অগ্রগতি সম্ভব হয় এবং এই প্রস্তাবের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের সংঘাত ও সংকটের পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির যুগে শান্তি প্রক্রিয়া কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে এবং সংঘাতের ক্ষেত্রে যোগাযোগপ্রযুক্তি কীভাবে ভূমিকা রাখছে, সেটির বিষয়েও এই প্রস্তাবে আলোকপাত করেছে। এই প্রস্তাবের সূচনা ১৯৯৯ সালে হলেও আজকের দিনেও এটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং প্রতিনিয়তই এর গুরুত্ব বাড়ছে।

বর্তমানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের আলোচ্যসূচিতে এই প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পাচ্ছে। ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই প্রস্তাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সনদে যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।

অধিকন্তু বৈশ্বিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে বাংলাদেশের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। বলা যায়, এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরেকটি ম্যান্ডেট পেয়েছে। বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে গভীর আস্থা আছে, তার প্রতিফলন হলো এ প্রস্তাব।

এই প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে জাতিসংঘ একটি বার্তা দিয়েছে। শক্তির রাজনীতির মাধ্যমে প্রভাব প্রতিষ্ঠায় ভূরাজনীতির যে খেলা বর্তমান বিশ্বে চলছে, সেটি নিরসনে এই বার্তা। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের কারণে অনাহারে আছে ও অপুষ্টিতে ভুগছে এবং বিভিন্ন সংকটে আছে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর অকার্যকারিতার কারণে এই মানুষগুলো নাজুক পরিস্থিতিতে আছে।

বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থের প্রাধান্য ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার হোঁচট খাচ্ছে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতির ফলে সৃষ্ট ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ ফলাফলের কারণে বিশ্বে দ্বান্দ্বিক ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে। শক্তিশালী দেশগুলো সমগ্র বিশ্বে তাদের প্রভাববলয় তৈরির প্রয়াস চালাচ্ছে। এগুলোর কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।

এর ফলে দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের জন্য অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ ও বঞ্চনার অবসানের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি নিশ্চিতকরণে শান্তি সংস্কৃতির প্রস্তাবটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘গ্লোবাল সাউথ' নামে পরিচিত এই অঞ্চলে এখন আমরা শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাব অনুভব করি। এই অঞ্চলে যে ধরনের আত্মঘাতী ভূরাজনীতির খেলা .


চলছে, সেটির রাশ টেনে ধরা বা রুখে দেওয়ার জন্য যে ধরনের নেতৃত্বের প্রয়োজন, তার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মুখে থেকে তার নেতৃত্বে উন্নয়নশীল বিশ্বের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলছে ।

এই প্রস্তাব শক্তিশালী একটি উপায়, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলে। এর ফলে মানুষ ও সমাজের মধ্যে সহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার, সাম্য ও মানবতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে।


অধিকন্তু রাষ্ট্রের নীতি ও আচরণে এটি ইতিবাচক ও কার্যকর পরিবর্তন সাধন করে। এই প্রস্তাব একদিকে যেমন বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার গুরুত্বের কথা বলে, তেমনি শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে করণীয় উপায় বাতলে দেয়। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন এই প্রস্তাব সর্বপ্রথম উত্থাপন করেন, তখন এর শিরোনাম ছিল ‘ডিক্লারেশন অ্যান্ড প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন অন অ্যা কালচার অব পিস' (Declaration and Programme of Action on a Culture of Peace) |

এখানে বিশেষ কতগুলো বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তির সংস্কৃতিকে লালন করা; দ্বিতীয়ত, টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করা; তৃতীয়ত, নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ; চতুর্থত, সাম্য ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা; পঞ্চমত, সকল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং অংশগ্রহণমূলক যোগাযোগকে সমর্থন করা; ষষ্ঠত, বিশ্বে জ্ঞান ও তথ্যের অবাধ প্রবাহকে মুক্ত করা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করা। অর্থাৎ এসব কার্যক্র যখন বিভন্ন ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্থা সমন্বিতভাবে করবে, তখনই বিশ্বে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি, সংঘাতের পরিবর্তে সম্প্রীতি এবং অন্যায় ও বৈষম্যের পরিবর্তে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

আজকের ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে তথ্যের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, আধিপত্যের দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিচ্ছে এবং অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে উন্নয়নকে ব্যাহত করা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জান-মালের ক্ষতি করা হচ্ছে এবং সর্বোপরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি নষ্ট করা হচ্ছে, এ অবস্থায় শান্তির সংস্কৃতির ধারণা ও এর চর্চা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ২০২৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে শান্তির সংস্কৃতির প্রস্তাব অনুমোদনের মাধ্যমে বিশ্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বের বৈশ্বিক স্বীকৃতি আরেক বার প্রমাণিত হলো।

লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) [সূত্র: যুগান্তর, ২১ জুন ২০২৩]

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!